বই সরিয়ে হাতে উঠছে অস্ত্র! জ্বলন্ত মণিপুরে যেভাবে বিপদের মুখে শৈশব
Manipur Unrest: দীর্ঘ দু'বছরেও বেশি সময় ধরে অশান্তির পর অশান্তিতে জেরবার মণিপুর। মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্ন নেই। এখন নতুন করে সঙ্কটের মুখে পড়েছে ছোট ছোট ছেলেদের শৈশব।
উত্তরপূর্বের ছোট্ট একফালি রাজ্য মণিপুর। যেখানে গত দু'বছর ধরে অশান্তির শেষ নেই। কখনও সাময়িক ভাবে শান্তি ফেরে। আবার ক'দিন যেতে না যেতে অশান্ত হয়ে ওঠে মাতৃতান্ত্রিক এই রাজ্যটি। নামেই মাতৃতান্ত্রিক। মণিপুরে যেভাবে নারীদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন চলেছে বছরের পর বছর ধরে, তা কার্যত নজিরবিহীন। সরকার তেমনভাবে কোনওদিনই মাথা ঘামায়নি মণিপুরের শান্তি ফেরাতে। ভোট এসেছে, ভোট গিয়েছে। কেন্দ্রের সরকার যে তাঁদের কথা ভাবে না, তা বারবার টের পেয়েছে মণিপুরের মানুষ। প্রথম বার মণিপুরের থেকে প্রতিনিধি পেয়েছে লোকসভা। কিন্তু পরিস্থিতি তাতেও বদলায়নি। আসলে যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত। জাতিহিংসার উন্মত্ত খেলায় কখনও বলি হয়েছে নিরপরাধ মহিলারা। তাঁদের শরীর খুবলে খেয়েছে পশুর দল। আর এবার মণিপুরের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নতুন দাবার তাস সেখানকার শিশুরা। বয়স বড়জোর এগারো থেকে চোদ্দোর মধ্যে। সেই সব নাবালকদের শৈশব কার্যত ছিনিয়ে নিয়ে তাদের লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। ছোটবেলা থেকেই জঙ্গিদলের ক্যাডার তৈরি করার মিলছে প্রশিক্ষণ। প্রয়োজনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন হামলা-অভিযানেও। কার্যত সবদিক থেকেই জ্বলছে মণিপুর।
গত বছরের মে মাস থেকেই অশান্তি লেগেই রয়েছে সেখানে। মাস কয়েক আগে কিছুদিনের জন্য শান্ত হয়েছিল মণিপুর, তবে সেই শান্তি ছিল সাময়িক। তার পর দিন ঘুরতে না ঘুরতে ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে মণিপুর। অশান্তি-খুন-জখম লেগেই রয়েছে তার পর থেকে। মণিপুরের পাঁচ জেলায় ইতিমধ্যেই জারি হয়েছে আফস্পা। ইম্ফল পশ্চিম, ইম্ফল পূর্ব, জিরিবাম, কাঙ্গপকপি এবং বিষ্ণুপুর। এই পাঁচ জেলায় আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত 'আফস্পা' জারি থাকবে বলেও জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: মণিপুরের বুকে এখনও জমাট চাপ চাপ অন্ধকার
মণিপুরে মূলত বাস দুই সম্প্রদায়ের মানুষের, মেইতেই ও কুকি। আর এই দুই সম্প্রদায়ের জাতি হিংসার জেরে সেই ২০২৩ সাল থেকে অশান্তি লেগেই রয়েছে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যে। দিন কয়েক আগেই জিবিরাম জেলায় সিআরপিএফের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিহত হয় ১১ জন কুকি জঙ্গি। মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলেও জানানো হয়েছিল। ওই লড়াইয়ে এক সিআরপিএফ জঙ্গি নিহত হয় বলেও জানা যায়। সেই জঙ্গিমৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই মণিপুরে বেশ কয়েকজন মেইতেইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে।
অসম-মণিপুর সীমান্তে একটি থানায় এর কয়েকদিন আগেই হামলা চালিয়েছিল কুকি জঙ্গিরা। ওই থানার পাশেই ছিল একটি রিলিফ ক্যাম্প। অনুমান করা হচ্ছে ওই ক্যাম্পটিও জঙ্গিদের নিশানায় ছিল। এর পর থানা থেকে এক কিলোমিটার দূরে জাকুরাডোর কারংয়ে হামলা চালায়। সেখানে একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখনই ছুটে আসে সিআরপিএফ। শুরু হয়ে যায় গুলির লড়াই। আসলে গত সপ্তাহ থেকেই উত্তেজনা বাড়ছিল জিরিবামে।
অবশ্য অশান্তির শুরুটা হয়েছিল আরও আগে। গত ৭ নভেম্বর হামার উপজাতির এক মহিলা খুনের অভিযোগ উঠেছিল মেইতেইদের বিরুদ্ধে। তাঁর স্বামীর অভিযোগ , খুনের আগে নাকি ধর্ষণও করা হয় তাকে। তার পর নাকি জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় ওই জনজাতির মহিলাকে। সেই ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও উঠে এসেছে পৈশাচিক নির্যাতনের প্রমাণ। ওই মহিলা খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছিল জিরিবামে। সেখানে অন্তত ১৬টি বাড়িতে অতর্কিতে আগুন ধরিয়ে দেয় জঙ্গিরা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নির্যাতিতার বাড়ি। ভয়ে গ্রাম ফাঁকা হয়ে যায়। এর পরেও মণিপুরের বিষ্ণপুর জেলায় আরও এক মহিলা খুনের অভিযোগ ওঠে। জমিতে কাজের সময় মেইতেই কৃষক রমণীকে গুলি করে জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। পার্বত্য এলাকা থেকে কুকি জঙ্গির একটি দল এসে এমন করেছে বলে অভিযোগ ওঠে।
তার পর থেকেই পর পর হিংসার খবর আসতে শুরু করেছে মণিপুর থেকে। রাজ্যের পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০ কোম্পানি প্যারামিলিটারি ফোর্স পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি খবর এসেছে, ত্রাণ শিবির থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ৬ মেইতেই সদস্যকে। সব মিলিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে নতুন করে আগুন জ্বলছে মণিপুরে।
মণিপুরে এই অশান্তির বীজ প্রোথিত হয়েছে দীর্ঘ দিন আগেই। মেইতেই আর কুকিদের এই অশান্তির ইতিহাস আজকের নয়। এরই মধ্যে অভিযোগ উঠছে, কুকি জঙ্গিগোষ্ঠীরা নাকি ভবিষ্যতের লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখে বাচ্চাদের সেনা হিসেবে নিয়োগ করা শুরু করেছে। ১১ থেকে শুরু করে ১৪ বছর বয়সী ছেলেদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন অভিযানেও। যাতে আন্দোলনের আগুনকে জিইয়ে রাখা যায়, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করছে না তারা। সম্প্রতি লেইমাখংয়ের বাসিন্দা এক নাবালকের কথা সামনে এসেছে, যাকে কেএনএফ (কুকি ন্য়াশনাল ফ্রন্ট) ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কাঞ্চুপ এলাকায় হামলার ঘটনায় অংশ নিয়েছিল এই ছেলেটি। কেন শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে জঙ্গি সংগঠনে? গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এর নেপথ্যে নাকি বেশ কিছু কারণ রয়েছে। শিশুরা ধরা পড়লে তুলনামূলক ভাবে কম জেলের শাস্তি ভোগ করবে। তার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে প্রশিক্ষণের ফলে ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী ক্যাডার তৈরি করা সম্ভব হবে, এই সব ভাবনা থেকেও ছোটদের শৈশব কেড়ে নিয়ে তাদের লাগানো হচ্ছে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে।
এদিকে নিখোঁজ মেইতেই সদস্যদের মুক্তির দাবিতে সরকারের উপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছে বিরোধী দলগুলি। বন্দিদের মধ্যে তিন মহিলা ও তিন শিশু রয়েছে বলে খবর। যার মধ্যে একটি শিশুর বয়স মাত্র দশ মাস। রাজ্য পার্টির সভাপতি কে মেঘচন্দ্রের নেতৃত্বে মণিপুরের পাঁচ কংগ্রেস বিধায়ক ওই ছ'জন মেইতেই সদস্যের নিরাপদ মুক্তির চেয়ে গুয়াহাটির রাজভবনে রাজ্যপাল লক্ষ্মণ প্রসাদ আচার্যের সাথে দেখা করেন। এদিকে মেইতেইদের গোষ্ঠীগুলোও রাজনৈতিক দলগুলির উপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছে। তাদের দাবি মানা না হলে সমর্থন প্রত্যাহার করে গণআন্দোলনে নামার হুমকি দিয়ে রেখেছে তারা। এ দিকে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে যে এগারো জন আততায়ীর মৃত্যু হয়েছে বলে মণিপুর প্রশাসনের তরফে দাবি করা হয়েছে, তাদের পরিচয় নিয়েও দ্বিধাবিভক্ত মণিপুর। পুলিশের দাবি, তারা সকলেই কুকি জঙ্গি। এদিকে আদিবাসী উপজাতি নেতাদের ফোরাম জানিয়েছে, তাঁরা গ্রামের স্বেচ্ছাসেবক মাত্র। যা নিয়ে নতুন করে দানা বাঁধছে অশান্তি।
আরও পড়ুন: ফোন-ইন্টারনেট স্থগিত, রাজ্য জুড়ে কার্ফু! কেন ফের অশান্ত মণিপুর?
সব মিলিয়ে ক্রমশ জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। নতুন করে অশান্তি বাড়তেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মণিপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার ইন্টারনেট সংযোগ। দীর্ঘ দু'বছরেও বেশি সময় ধরে অশান্তির পর অশান্তিতে জেরবার মণিপুর। মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্ন নেই। এখন নতুন করে সঙ্কটের মুখে পড়েছে ছোট ছোট ছেলেদের শৈশব। গত বছরের মে মাসের অশান্তির পর থেকে হাজার হাজার মণিপুরবাসী ঘরহীন। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই দিন কাটছে এখনও শরণার্থী শিবিরে। কেউ বা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন পড়শি রাজ্যে। তাদের ঘরে ফেরা হয়নি আজও। কীভাবে কাটবে মণিপুরের এই অশান্তির অন্ধকার? তার উত্তর নিয়ে আদৌ কি মাথা ঘামাচ্ছে দেশের সরকার?