মানুষ বড় সস্তা! ফের প্রমাণ করল ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোট
Panchayat Poll 2023: বছরের পর বছর ধরে এমন অসংখ্য ভোট পার করে এসেছে বাংলা। রাজায় রাজায় লড়াই বেঁধেছে। আর রাস্তায় কেটে ছড়িয়ে পড়ে থেকেছে হাজার হাজার 'সস্তা' মানুষের শরীর। এ দৃশ্যের কোনও বদল নেই।
আজ থেকে নয়। গত এক দশক ধরেই রাজ্য-রাজনীতিকে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করেছে পূর্ব মেদিনীপুরের একটি জায়গা। মানুষের ক্ষোভের আগুন কীভাবে গদি উল্টে দিতে পারে দেখিয়ে দিয়েছিল ২০১০ সাল। পালাবদল থেকে ভোলবদল, অনেক কিছুই লেখা রয়েছে তার ইতিহাসে ইতিহাসে। সেই নন্দীগ্রাম। যাকে বঙ্গ-রাজনীতির ভাগ্যদেবতা বললেও খুব ভুল বলা হয় না।
শিল্প আনার নামে কৃষিজমির জবরদখল, নির্বিচারে গুলি, গড়ে ওঠা প্রতিরোধ, বুদ্ধিজীবীদের একজোট হওয়া বদলে দিয়েছিল ৩৪ বছরের একটা ইতিহাসকে। সরকার পতনের শব্দ শোনা গিয়েছিল বহু দূর থেকে। অস্ত গেছিল বামজমানার সূর্য। 'বদলা নয়, বদল'-এর মন্ত্র নিয়ে ময়দানে এল তৃণমূল। জানিয়ে দিল, তাঁরা নাকি 'মা-মাটি-মানুষে'র সরকার। 'শ্রমজীবীদের সরকার' থেকে রাজ্য পৌঁছে গেল 'মা-মাটি-মানুষে'র সরকারে। তারপর কেটে গিয়েছে তিনটি মেয়াদ। এর মধ্যে ভোট এসেছে, ভোট গেছে। আর ফের প্রমাণ হয়ে গিয়েছে রাজনীতির সেই সারসত্যখানা। 'যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ'। প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, 'রাজা আসে যায়, রাজা বদলায়, লাল জামা গায়ে নীল জামা গায়ে..' কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে হিংসার ছবিটা বদলায় না। ছাপ্পা বদলায় না, গোলাগুলি বদলায় না, খুনোখুনি বদলায় না। রক্তে সেদিনও ভিজেছিল নন্দীগ্রামের মাটি, আজও ভিজছে। ভিজছে গোটা বাংলা।
আরও পড়ুন: হিংসায় শুরু পঞ্চায়েত ভোটের সকাল? বেলা বাড়ছে রক্তপাতে
বাংলার ভোট মানেই ত্রাস। আর তা যদি পঞ্চায়েত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। যারা ভোট দেবেন ভয় তাঁদের, যাঁরা ভোট নেবেন, ভয় তাঁদেরও। ভয় সেসব পরিবারের, যাঁদের ঘরের ছেলেমেয়েরা গণপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে নেমেছে ব্যালটের লড়াইয়ে। প্রতিবছর ভোটের আগে যুযুধান হয়ে ওঠে কেন্দ্র-রাজ্য ও নির্বাচন কমিশন। তৈরি হয় স্পর্শকাতর এলাকার লম্বা তালিকা। একপক্ষ চায় পুলিশ, তো অন্যপক্ষ কেন্দ্রীয় বাহিনী। আদালতে দর কষাকষি চলে তা নিয়ে। ওই পর্যন্তই। তার পর এত বড় রাজ্যে কোনও মতে কয়েকশো কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ভেড়ি বাজিয়ে হাল্লা চলে ভোটযুদ্ধে।
বাম আমলেও পঞ্চায়েত ভোট খুব সুখকর ছিল না। বাম জমানার তৃতীয় বারের ভোট থেকেই শুরু সন্ত্রাসের। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোট তেমন ঘটনাবহুল ছিল না। কারণ প্রধান বিরোধীদল বামেরা তখন বেশ কোণঠাসা। ইতিমধ্যেই রাজ্য-রাজনীতিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল বিজেপি। গত কয়েক বছর ধরেই পঞ্চায়েত ভোট আর আতঙ্ক কথাটি প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। সরকারি হিসেব বলছে, ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে মৃত্যু হয়েছিল ১৮ জনের। কিন্তু বেসরকারি খাতায় সেই সংখ্যাটা পৌঁছেছিল তিরিশে। এ বছরও অন্যথা হল না তার। ভোটগ্রহণের আগেই রাজ্যের নিহতের সংখ্যা ছুঁয়ে ফেল দুই অঙ্ক। তবে বেসরকারি হিসেব যে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি, তা আর নতুন করে বলে দিতে হয় না। ভোটের আগেই ভোট কেড়েছে প্রায় আঠারোটি প্রাণ। জখম বহু। ভোটের দিন সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ডবল।
শনিবার আরও এক রক্তময় পঞ্চায়েত ভোটের সাক্ষী রইল বাংলা। জায়গায় জায়গায় অশান্তি, রক্তপাত দিয়েই শুরু হয়েছিল দিন। এর মধ্যে বারবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল এপিসেন্টার নন্দীগ্রাম। মনোনয়ন পর্ব থেকেই চর্চায় ছিল জায়গাটি। সেটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক নাটকের দেখা মিলেছে এই জায়গা থেকেই। স্বভাবতই এই ভোটেও নজরে ছিল নন্দীগ্রাম। এদিন সেখানকার বেশ কিছু বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী না দেখতে পেয়ে সকাল সকালই বিক্ষোভ শুরু করে দেয় বিজেপি। বহু ভোটকেন্দ্রেই বন্ধ হয় ভোটগ্রহণ। এদিকে বুথের বাইরে গণপ্রতিনিধি বেছে নিতে চেয়ে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে দাঁড়িয়ে মানুষ। তা অবশ্য দাঁড়ানোরই কথা। নিজেদের প্রতিনিধি বাছার মতো কাজ করতে এসেছেন তাঁরা। রাজনৈতিক কোন্দল দেখা এবং হাসিমুখে সহ্য করা তো 'বুরবাক' নাগরিকদের নৈতিক কর্তব্য বটেই। এরই মধ্যে বিষের বোতল হাতে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে বসেন বেশ কয়েকজন ভোটার। দাবি তোলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর। এলাকার স্থানীয় তৃণমূলনেতাকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকে বেশ কয়েকটি বুথে ভোটগ্রহণ। শুধু একটা-দুটো নয়, নন্দীগ্রামের একাধিক বুথের ছবিটা এমনই অশান্তির। কোথাও ভোট বয়কটের ডাক, তো কোথাও ব্যালটবাক্স ফেলে দেওয়ার অভিযোগ। জ্যাংড়ায় বুথ দখলের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে শাসকদলের বিরুদ্ধে। সিপিএম ও বিজেপি এজেন্টদের মেরে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয় বলেও নালিশ। কোথাও আবার কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে পুলিশের পায়ে পড়লেন ভোটাররা। এদিকে, শাসক দল সিভিক ভলেন্টিয়ার দিয়েই ভোট করানোর পক্ষে। কিন্তু আসল সময়ে কী দেখা গেল? অশান্তির বাজারে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ৫০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে রইল সিভিক ভলিন্টিয়ার বাহিনী। আতঙ্কিত পুলিশ বুথ থেকে দূরে গিয়ে মাথা লোকালেন একটি বাড়িতে। প্রাণ বড় বালাই। কিছুদিন আগে উন্মত্ত জনতার যে রূপ দেখেছিল কালিয়াগঞ্জ পুলিশ, তা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা কঠিন! ফলে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। নন্দীগ্রামেরই কোনও কোনও বুথে আবার উঠল ব্যালট চুরির অভিযোগও। সব মিলিয়ে অশান্তি-রক্তে জমে উঠল ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোট।
প্রত্যাশা অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত ভোট এ রাজ্যে অনেকটাই সোনার পাথরবাটি। যার আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই। ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত যজ্ঞে আহূতি হয়েছে তিরিশটির বেশি প্রাণ। এর পরেও গল্প বাকি রয়েছে। ভোট পরবর্তী হিংসাতে সেই সংখ্যাটা কোথায় যাবে বলা মুশকিল। শুধু নন্দীগ্রাম বলে নয়, রাজ্যের প্রায় প্রতিটি আনাচ-কানাচেই ছবিটা কার্যত একই। তারই মধ্যে নন্দীগ্রাম অতিস্পর্শকাতর এলাকা বলেই পরিচিত। সেই ২০১০ সাল থেকেই। এই একটা জায়গাই ধ্বসিয়ে দিয়েছিল বামসাম্রাজ্য। আবার এই জায়গা থেকেই ২০২১ সালের ভোটে নিজের বিশ্বস্ত সেনাপতির কাছে ভোটে হেরেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামে ভোটে হেরে ফের উপ-নির্বাচনে লড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যে শুভেন্দু অধিকারীর কাঁধে ভর রেখে একদিন বাংলার গড় দখল করেছিলেন মমতা, সেই শুভেন্দুই আজ তাঁর দলের প্রধান বিরোধী নেতা। এ বারের ভোটেও মমতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় তোপটি দেগেছেন তিনি। একবার নয়, একাধিক বার। এমনকী রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভও উগরে দিয়েছেন বাংলার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে।
ভোটের ঠিক আগেই রাজ্যের কাছে শান্তিপূর্ণ ভোট করার আবেদন জানিয়েছিলেন রাজ্যপাল। গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের কথাও বারবার তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর বক্তব্যে। রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাতের যে ছবি গত কয়েক বছর ধরে বাংলা দেখে আসছে, তা তো আর নতুন নয়। রাজ্যপাল বদলে তার উপর খানিকটা পলি পড়েছে বটে, কিন্তু ছবিটা একেবারে বদলায়নি। ভোট নিয়ে রাজ্যপালের বিবৃতির পরেই পাল্টা দেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, তৃণমূল শান্তিপূর্ণ ভোট চাইলেও উস্কানি দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। তবে ভোটের দিন কার্যত দেখা গেল, শান্তিপূর্ণ ভোটের পাশে নেই কোনও পক্ষই। তাই দিনভর পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে বিক্ষিপ্ত অশান্তি, রক্তপাত লেগেই রইল রাজ্য জুড়ে।
ভোটপূর্ব প্রচারেই বারবার মমতা বয়কটের ডাক তুলেছেন শুভেন্দু। ভোট রুখে দাঁড়ানোর জন্য মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান তিনি। এমনকী এলাকায় বহিরাগত ঢোকানো হচ্ছে বলেও বিস্ফোরক দাবি করেন বিরোধী নেতা। এখানেই শেষ নয়, বহিরাগত প্রসঙ্গে পাল্টা হুমকিও দিয়েছিলেন শুভেন্দু। এরপরেই বিরোধী নেতার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে তাঁকে নোটিস পাঠায় কাঁথি থানা। সেই নোটিস চ্যালেঞ্জ করে শুভেন্দু অধিকারী তৎক্ষণাৎ হাইকোর্টে যান বটে কিন্তু সেখানেও মেলেনি স্বস্তি। তাই বলে দমানো যায়নি বিজেপি নেতাকে। ভোটের দিনও একই ভাবে মমতার সরকারের দিকে বিরোধিতা শানিয়েছেন শুভেন্দু। এমনকী রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে 'সুপারি কিলার' বলেও তোপ দেগেছেন তিনি। এদিন সকালেই টুইটারে পঞ্চায়েত ভোটকে গণতন্ত্র নয়, 'রাক্ষসতন্ত্রের উৎসব' বলে কটাক্ষ করেন শুভেন্দু । 'আর কত রক্ত চাই আপনার?'শনিবার নির্বাচন কমিশনার রাজীববাবুকে ফোন করে সরাসরি এই প্রশ্নও করে বসেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু।
আরও পড়ুন: দেওয়ালে অধিকার নেই রাজনৈতিক দলের! পঞ্চায়েত ভোটের আগে দাবিতে কেন অনড় রাজ্যের কুড়মিরা?
পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর থেকেই অশান্তি বাড়তে থাকে। এমনকী বহু জায়গাতেই বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমাতেও বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। ভোটের দিন সপ্তমে উঠেছে অশান্তি। বারাসাতে নির্দল প্রার্থীর সমর্থককে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। তুফানগঞ্জে খুন হয়েছেন এক টিএমসি কর্মী। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদিয়া, দুই ২৪ পরগনাতে একের পর এক হিংসার ঘটনা সামনে এসেছে শনিবার সকাল থেকেই। বোমাবাজি, ভোট লুটের অভিযোগ তো রয়েইছে। অশান্তি হয়েছে ভাঙড়েও। বল ভেবে খেলতে গিয়ে বোমা ফেটে আহত হয় দুই শিশু। এমন অসংখ্য মৃত্যু, রক্তপাতের ঘটনা নথিভুক্ত হয়ে চলেছে শনিবার সকাল থেকেই।
গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব ভোট। যেখানে মানুষ বেছে নেন নিজের প্রতিনিধিকে। সামনের পাঁচ বছরের জন্য মানুষের মুখ হয়ে উঠবেন যিনি। আদায় করে আনবেন আম-আদমির দাবিদাওয়া, তুলে ধরবেন তাঁদের কষ্ট-দুর্দশা। কিন্তু সত্যিই কি এই রক্তপাতের ভোট কোনও সুস্থ, গণতান্ত্রিক দেশের লক্ষণ? পৃথিবীর আরও কোনও জায়গায় ভোটের নামে এই বর্বরতা চলে কিনা বলা মুশকিল। তবে এই বাংলা বছরের পর বছর ধরে এমন অসংখ্য ভোট পার করে এসেছে। রাজায় রাজায় লড়াই বেঁধেছে। আর রাস্তায় কেটে ছড়িয়ে পড়ে থেকেছে হাজার হাজার 'সস্তা' মানুষের শরীর। এ দৃশ্যের কোনও বদল নেই এতগুলো বছরে। পঞ্চায়েত পেরিয়ে বিধানসভা, বিধানসভা পেরিয়ে লোকসভা, ভোট আসবে যাবে। সরকার বদল হবে। কিন্তু ভোট বদলাবে না! এ বাংলায় ভোট মানেই কি রক্তপাত। প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও...!