অশোক স্তম্ভ: ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল

অশোক স্তম্ভের খোলনলচে বদলে দেওয়া হয়েছে। কেমন বদল? একটা অংশের মতে, সুপ্রাচীন অশোক স্তম্ভে তিনটি সিংহ থাকে, যাদের মাথা সর্বদা নিম্নমুখী। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নতুন ভারতে তৈরি স্তম্ভে সবক'টি সিংহের মুখ ওপরের দিকে। তাদের মুখ...

নতুন সংসদ ভবনের ছাদে বসবে অশোক স্তম্ভ। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করেছেন এই জাতীয় প্রতীক। আর তার পরেই দেশজুড়ে চলছে বিতর্ক। ট্যুইটারে ট্রেন্ডিং, অন্য সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই। অভিযোগ, অশোক স্তম্ভের খোলনলচে বদলে দেওয়া হয়েছে। কেমন বদল? একটা অংশের মতে, সুপ্রাচীন অশোক স্তম্ভে তিনটি সিংহ থাকে, যাদের মাথা সর্বদা নিম্নমুখী। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নতুন ভারতে তৈরি স্তম্ভে সবক'টি সিংহের মুখ ওপরের দিকে। তাদের মুখ থেকে রাগ আর হিংসা ঝরে পড়ছে। 

উন্মোচিত এই স্তম্ভ বানাতে ব্যয় হয়েছে ১২৫০ কোটি টাকা। স্তম্ভটির উচ্চতা ৬.৫ মিটার। ব্রোঞ্জ দিয়ে নির্মিত এই মূর্তির ওজন প্রায় ৯৫০০ কিলোগ্রাম। আর এটা বসাতে সাড়ে ৬ হাজার কিলোগ্রাম ওজনের স্টিল প্রয়োজন হয়েছে। ক্লে মডেলিং, ব্রোঞ্জ ঢালাই, পালিশ সহ মোট ৮টি ধাপের মধ্যে দিয়ে গিয়ে তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু দেশবাসীর টাকা খরচ করে যা তৈরি হলো, তা কি অশোক স্তম্ভ না কি রুমাল বেড়াল হলো, প্রশ্নটা এই নিয়েই।

কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, "মোদিজি আপনি দয়া করে সিংহের মুখটা দেখুন ! এটা কি সারনাথের মূর্তি না কি গুজরাটের গির জঙ্গলের সিংহের বিকৃত রূপ?" নতুন অশোক স্তম্ভের স্বরূপ দেখে হতচকিত প্রবীণ ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের কথায়, "আমাদের জাতীয় প্রতীকে এমন হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন ছিলই না। কেন সিংহের মুখে হিংসা আর ক্ষোভ থাকবে?"

আরও পড়ুন: ৫জি-র দুনিয়ায় প্রবেশ আদানির, ফের শুরু হবে বিনামূল্যে ইন্টারনেটের দিন?

পুরোনো অশোক স্তম্ভের সঙ্গে যদি নতুন স্তম্ভের তুলনা করি? তাহলে দেখা যায়, সারনাথে অবস্থিত অশোক স্তম্ভে সিংহের মুখ অনেক সৌম্য, শান্ত। তা সামঞ্জস্যের প্রতীক। কিন্তু নব্য উন্মোচিত স্তম্ভে তার কোনওটাই দেখা যাচ্ছে না। বরং সিংহ যেন রণংদেহি। এই প্রেক্ষিত থেকে আম আদমি পার্টি-র নেতা সঞ্জয় সিংহ ট্যুইট করে বলছেন, জাতীয় প্রতীক বদলানোটা কি দেশদ্রোহ নয়? 

বিরোধীদের মতে, জাতীয় প্রতীক দেশের চরিত্র বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। মোদি সরকারের তৈরি প্রতীকে এই সরকারের চরিত্রই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আবার অনেকের মতে, নতুন স্তভের সিংহের দ্বারা মোদি নিজের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তাই সিংহের এই বিকৃত রূপ।

সারনাথের অশোক স্তম্ভ
পুরাণের কাহিনি অনুসারে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোকের জীবনবোধে আমূল পরিবর্তন ঘটে। অত্যাচারী রাজা বলে পরিচিত অশোক বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসার নীতিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। বৌদ্ধ ধর্মে সম্পৃক্ত হয়ে সারনাথে তিনি এক অশোক স্তম্ভ নির্মাণ করেন, যাতে রয়েছে চারটি সিংহ ছিল। সারনাথেই বুদ্ধ তাঁর প্রথম উপদেশ দিয়েছিলেন। কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছিল এই স্তম্ভ। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ আর্কিওলজিক‍্যাল সার্ভে আবার নতুন ভাবে উপস্থাপন করে এই স্তম্ভ। তারও অনেক বছর পর আবার ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি এই সারনাথের অশোক স্তম্ভকে ভারতের জাতীয় প্রতীক বলে মান্যতা দেওয়া হয়।

সারনাথের এই স্তম্ভ ধর্ম-সংঘের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল। চারটি সিংহ রয়েছে এই স্তম্ভে। তার মধ্যে তিনটির মুখ তিনদিকে কিন্তু চতুর্থ সিংহটি সর্বদা দৃষ্টির আড়ালে থাকে। রাজকীয় কিন্তু অনেকটাই নমনীয় এই সারনাথের সিংহ। অন্য দিকে মোদি সরকারের তৈরি স্তভের সিংহগুলি স্বভাব-উগ্র, যেন গিলে খেতে আসছে।

অবশ্য এসব বাকবিতণ্ডায় মুখে কুলুপ বিজেপির। নতুন ভাবে জাতীয় প্রতীক তৈরি করা শিল্পী সুনীল দেওরেও বলেছেন, তিনি নিজের মতো করে মূর্তি বানিয়েছেন। উগ্র মনোভাব থেকে তিনি এই কাজ করেননি। তার আরও মত, নেটে যে ছবি দেওয়া হয়েছে, তাতে নিচের দিক থেকে সিংহের ছবি দেখানো হয়েছে বলে তার শ্বদন্ত দেখা যাচ্ছে, আর সকলে এটাকে উগ্র রূপ বলে ভুল করছেন।

এই স্তম্ভ কেন প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্বোধন করছেন, এই নিয়েও প্রশ্নাতুর বিরোধীরা। তাঁরা স্পষ্টই বলছেন, এই কাজ করে তিনি সংবিধানের অবমাননা করেছেন, কারণ জাতীয় প্রতীকের মতো স্তম্ভ উন্মোচনের দায়িত্ব থাকে রাষ্ট্রপতির। প্রধানমন্ত্রী এই স্তম্ভ উন্মোচনের পর পুজোও করেছিলেন। বহুধর্মের সমন্বয় ভারতের বৈশিষ্ট্য, সেখানে কেন প্রধানমন্ত্রীর ধর্মীয় পক্ষপাত প্রকট হবে, প্রশ্ন এই নিয়েও।

আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ নিজের ট্যুইটারে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে লিখেছেন, "গান্ধী থেকে গডসে, জাতীয় স্মারকে সিংহ থেকে সংসদ ভবনে বসানো সিংহের ক্রোধ আর দাঁত বের করা হিংসার বহিঃপ্রকাশই আমাদের মোদির আধুনিক ভারত।" প্রশান্ত ভূষণের ট‍্যুইটারের জবাবে একজন মশকরা করে বলেছেন, "সারনাথের সিংহের কেশরগুলি দেখুন কীরকম ব্যারিস্টারের উইগের মতো আর নতুন সিংহেরটা যেন নাগা সাধুর জটা।"

উল্লেখ্য, এই নতুন অশোক স্তম্ভ সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টের অংশ। প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠেছে এই প্রোজেক্টের বরাদ্দ নিয়ে। ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই প্রজেক্টের জন্য। ২০২০ সাল থেকে অতিমারীতে জড়িয়ে ছিল গোটা দেশ। ২০২১-এ দিল্লিতে শবদেহ দাহ করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। গণচিতা জ্বলতে দেখেছিল সারা দেশ। ভেবে দেখতে হয়, ২০০০-এর পর ঠিক কটা শূন্য বসলে ২০০০ কোটি টাকা হয়। আর এই টাকা দিয়ে কী করা যেত, আর কী করা হচ্ছে।

কী হচ্ছে
দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট এই সুবিস্তৃত ৩ কিমি রাস্তাকে বরাবরই সেন্ট্রাল ভিস্তা বলা হয়। বর্তমান দিল্লিতে প্রায় ৯০ একর জায়গাজুড়ে আছে নর্থ আর সাউথ ব্লক। আর এই এলাকাতেই ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন মন্ত্রী ভবন, দফতর আরও অনেক কিছু। এখানেই তৈরি হবে প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাসভবন। থাকবে ভাইস প্রেসিডেন্টের থাকার জন্য মহল। একটা সুন্দর পার্ক। আগের মতো গোলাকার সংসদ ভবন হয়তো আর থাকবে না, তার বদলে আসবে ত্রিকোণ আকৃতির চারতলা ভবন। নতুন ভবনের ইন্টিরিয়রেও আছে অনেক চমক। এর থিম হবে তিনটি প্রতীকে। লোকসভায় থাকবে আমাদের জাতীয় পাখি ময়ূর, রাজ্যসভায় আমাদের জাতীয় ফুল পদ্ম আর সেন্ট্রাল লাইঞ্জের থিম আমাদের জাতীয় বৃক্ষ বট। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সব বিল্ডিংগুলি ভেঙে ফেলা হবে।

এই প্রোজেক্ট নির্মাণের দায়িত্বভার যারা পেয়েছেন তারা আগে গুজরাটের সবরমতি রিভারফ্রন্ট, কাশী বিশ্বনাথ করিডোর বানানোর বরাতও পেয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মতে, ভোট মাথায় রেখে, ২০২৪ সালের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চাইছে মোদী সরকার। সুপ্রিম কোর্ট থেকে নির্মাণে স্থগিতাদেশ দিলেও তাই তড়িঘড়ি শিলান্যাস করে রাখা।

উল্লেখ্য এই প্রকল্প হলে ভারতের তিনটি হেরিটেজ এবং আইকনিক বিল্ডিং যেমন – দিল্লির ন্যাশানাল মিউজিয়াম, ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার ফর আর্টস, ন্যাশানাল আর্কাইভ অ্যানেক্স ভেঙে যাবে। তালিকা আরও বড় হতে পারে।

কী হতে পারত
২০২০ সালে দেশে অতিমারীতে হাহাকারের মতো অবস্থা ছিল। কোথাও হাসপাতালে বেড নেই, কোথাও অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই। যদি ২০০০ কোটি টাকা সেই সময় পাওয়া যেত, তবে সেই টাকায় ৭ লক্ষ আইসিইউ ভেন্টিলেটর, ১৩ লক্ষ পোর্টেবল ভেন্টিলেটর কেনা যেত। তৈরি করা যেত অক্সিজেন প্ল্যান্ট। যদি একটি হাসপাতাল তৈরিতে ১৫০ কোটি টাকা লাগে সেই হিসেবে সারা দেশে মোটামুটি ১৩০টি হাসপাতাল তৈরি হয়ে যেত।

বিরোধীরা বলছে, এক সময় দেখা যাবে জাতীয় পতাকার রঙও বদলে যাবে। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কি কিছুই করার থাকবে না!

More Articles