মধ্যাহ্নভোজে ইলিশ, যন্ত্রণায় শিশুর মতো কান্না! কেমন ছিল স্বামীজির শেষের সেই দিন?
Swami Vivekananda Death: দেহ দাহ করার অনুমতি মেলেনি, ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি— এমন নানা অপমান বিবেকানন্দকে সহ্য করতে হয়েছে মৃত্যুর পরেও। কিন্তু তিনি মহামানব।
তখন আর কীই-ই বা বয়স স্বামীজির। অথচ রোগে ভুগতে ভুগতে ক্লান্ত। একদিকে অ্যালবুমিন ইউরিয়াতে পেড়ে ফেলেছে। সর্দিকাশি প্রায় লেগেই রয়েছে। ডান চোখ প্রায় অকেজো। সেই চোখ দেখাতে কলকাতাও যাওয়া হচ্ছে না তাঁর। অন্যদিকে ড্রপসির উপদ্রব। তার প্রকোপ যখন বাড়ে, তখন হাঁটা-চলাও করতে পারেন না। কমলে মঠের মধ্যেই পায়চারি করেন। মঠে থাকলে বেশিরভাগ সময় শুধু কৌপিন পরেই দেখা যায় তাঁকে। আবার কখনও দীর্ঘ আলখাল্লায় শরীর ঢেকে পাড়ার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ান।
সারাক্ষণ শারীরিক পীড়ার কারণে মন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কাছের মানুষদের যখন তখন বকে ফেলছেন খুব রুক্ষ-শুষ্ক ভাবে, সেই ধমকে কেঁদেও ফেলছে কেউ কেউ। এই গ্লানি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, সতর্ক-অসতর্ক মুহূর্তে ঠোক্কর দিচ্ছে ভেতরে। মানুষের কাছ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন স্বামীজি। চিনে হাঁস, রাজহাঁস, পাতিহাঁস পুষছেন, গরু, ছাগল, ভেড়া, পায়রা- পুষছেন এসবও। হরিণ জুটছে, জুটছে কুকুর, বেড়াল, সারস। একবার বেড়ালে পায়রা মেরে ফেলায় স্বামীজি এত জোরে বেড়ালটাকে ঘুষি মারতে গেছিলেন, যে তাঁর নিজের হাতই থেঁতলে গিয়েছিল। পশুপাখিগুলো তখন স্বামীজির প্রাণ। একটা ছাগলছানা বড় প্রিয়, নাম দিয়েছিলেন মটরু। সেই মটরুর গলায় ঘণ্টা বেঁধে দিয়েছিলেন। মিষ্টি আওয়াজ হতো। ঘুরতও পায়ে পায়ে। বলতেন, “মটরু নিশ্চয়ই আর জন্মে আমার কেউ হত!” সেইটাও মারা গেল অদ্ভুতভাবে। চৌবাচ্চায় মাছ ছাড়া হয়েছিল। সেই মাছের চৌবাচ্চাতেই পড়ে গিয়ে ডুবে মারা গেল ছাগলছানাটা। স্বামীজি আরও ভেঙে পড়লেন। “কী আশ্চর্য! আমি যেটাকেই একটু আদর করতে যাই, সেটাই যায় মরে!” চাষবাস এবং বাগানের পরিচর্যা চলছে তখন মঠের ভেতরে। প্রিয় কুকুর বাঘা তখন সঙ্গে থাকত সর্বক্ষণ।
এভাবেই কাটছিল। সবাই বুঝতে পারছিলেন, স্বামীজি আর খুব বেশিদিন বাঁচবেন না। তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন। মঠে পায়চারি করতে করতে বেলতলার কাছে দাঁড়িয়ে স্বামী সারদানন্দকে বলেছিলেন, “ওই দেখ শরৎ, সামনেই ঠাকুরের চিতাস্মৃতি শ্মশান। আমার মনে হয় সমস্ত মঠভূমির মধ্যে এই স্থানটিই সর্বোৎকৃষ্ট। আমার দেহ এখানেই সৎকার করবি।”
আরও পড়ুন: তুঘলক থেকে বিবেকানন্দ, ইলিশ মানে মৃত্যু? উত্তর রয়েছে বাংলা সাহিত্যে
শুক্রবার, ৪ জুলাই, ১৯০২ সাল। এল সেই অভিশপ্ত দিন। এইদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বামীজি মন্দিরে গেলেন উপাসনার জন্য। অসুস্থতার কোনও লক্ষ্মণই নেই। একেবারে সুস্থ, স্বাভাবিক শরীর। সকালে জলখাবার খেতে বসে সবার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা চলল অনেকক্ষণ। গরম দুধ, ফলটল খেলেন। স্বামী প্রেমানন্দকে বললেন, আজ প্রাণ খুলে খেতে ইচ্ছে করছে। অনেকরকম খাবারই খেতে ইচ্ছে করছিল। কবিরাজও মাসদুয়েক আগে মাছ, তেল, নুন– এইসব খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।
বর্ষার মাঝামাঝি। রসিয়ে ঝাল ঝাল খাবার খাওয়ার ইচ্ছে সেদিন। ঠিক হলো, সেদিন ভাত, মাছ, তরকারি সবই খাবেন স্বামীজি। চা-কফি শেষ হল। প্রেমানন্দ বেরলেন। গঙ্গার ইলিশের কিছু খোঁজ পাওয়া গেল। সদ্য তোলা সেই ইলিশের জৌলুসই আলাদা। সেই খবর শুনে স্বামীজিও পৌঁছলেন সেখানে। সেই নিয়েও রঙ্গ-রসিকতা হল। মঠের এক তরুণ শিষ্যের সঙ্গে রহস্য করছিলেন, তার বাড়ি ওপার বাংলায়, তাই স্বামীজি বলছিলেন, “তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পুজো করিস? কী দিয়ে পুজো করতে হয়, কর।”
এরপর হাঁটতে বেরলেন। প্রেমানন্দ সঙ্গে ছিলেন। তাঁকে বললেন, “আমায় কেন নকল করবি? ঠাকুর নকল কত্তে বারণ করতেন। আমার মতন উড়নচড়ে হবি নে।” প্রেমানন্দ অবাক! হঠাৎ একথা! সাড়ে আটটা নাগাদ ধ্যান শুরু করলেন। প্রেমানন্দকে বললেন, “আমার আসন ঠাকুরের শয়নঘরে করে চারিদিকের দরজা বন্ধ করে দে।”
সেদিন প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধ্যান করে এগারোটা নাগাদ উঠলেন। নিজে হাতে ঠাকুরের বিছানা ঝেড়ে দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে শোনা যাচ্ছে গুনগুন— মা কি আমার কালো, কালোরূপা এলোকেশী, হৃদিপদ্ম করে আলো।
সাড়ে এগারোটা নাগাদ মঠে দুপুরের খাওয়াদাওয়া হতো। এই ক'দিন তাঁকে নিজের ঘরে আলাদা করে খেতে দেওয়া হতো। সেদিন বসলেন সবার সঙ্গে। প্রেমানন্দকে বলেছিলেন, শুধু ঝোল নয়, গোটাকতক মাছভাজা করতে বলো, ভাজা ইলিশের স্বাদই অপূর্ব। আর একটু মাছের টক করতে বলো। সেদিন মঠের সবার জন্য তাই হয়েছিল। সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে ইলিশের তেল দিয়ে অনেকখানি ভাত খেলেন। ডাল দিয়ে মাছভাজা। ঝোলে তেমন নাকি ঝাল হয়নি। ফলে কাঁচালঙ্কা ডলে নিলেন অনেকটা। তারপর শান্তি। শেষ পাতে মাছের অম্বল। বহুদিন পরে সেই খাওয়া দেখে শিষ্যেরা বেজায় খুশি। বললেন, “একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।”
খাওয়াদাওয়া শেষে মিনিট পনেরো-কুড়ি আরাম করলেন। তারপর উঠে পড়লেন। প্রেমানন্দকে নাকি বলেছিলেন, “আমার আজ ঘুম হল না। একটু ধ্যান করে মাথাটা খুব ধরেছে— ব্রেন উইক হয়েছে দেখছি।” সেদিন দুপুর একটা থেকে চারটে, অর্থাৎ প্রায় ঘণ্টাতিনেক ক্লাস নিলেন লাইব্রেরি ঘরে। সাধু-ব্রহ্মচারীদের পাণিনির ব্যাকরণ পড়ালেন। এই দীর্ঘ ক্লাসের পর স্বামীজিকে বোধহয় একটু ক্লান্তই দেখাচ্ছিল।
আরও পড়ুন- ধূম জ্বর গায়েই পুজো! বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় দ্বিতীয়বার রইতে পারেননি খোদ স্বামীজিই
এককাপ গরম দুধ খেয়ে একটু হাঁটতে বেরলেন ফের। প্রেমানন্দকে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত গিয়েছিলেন সেদিন। প্রায় মাইলদুয়েকের দূরত্ব। এতটা হাঁটতেন না তখন। ঘণ্টাখানেক পরে মঠে ফিরলেন। আমগাছের তলায় বেঞ্চে বসে বলেছিলেন, আজ শরীর যেমন সুস্থ বহুদিন এমন বোধ করি না। তামাক খেলেন। রামকৃষ্ণানন্দের পিতা ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হলো।
সাতটা নাগাদ হঠাৎ অস্বস্তি শুরু হল। সন্ধ্যারতি বাজতেই নিজের ঘরে চলে গেলেন। ব্রজেন্দ্রর কাছে দু'ছড়া মালা চেয়ে নিয়ে কাউকে আসতে বারণ করলেন ঘরে। মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে অস্বস্তি খুব বেড়ে গেল। বললেন, “খুব গরম লাগছে, জানলা খুলে দাও।” জানলা খুলে দেওয়া হলো, মেঝেতে শুয়ে পড়লেন, তখনও হাতে জপমালা। বাতাস করছিল শিষ্যেরা। একটু পরে বললেন, “আর বাতাস করতে হবে না, একটু পা টিপে দে।” ঘণ্টাখানেক এমন চলল। চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন, হঠাৎ বাঁপাশে ফিরলেন। ডান হাত তখন কাঁপছে। মাথায় ঘামের ফোঁটা। সঙ্গে শিশুর মতো কান্না। ধীরে ধীরে শ্বাস উঠল। মিনিটদশেকের মাথায় বালিশ থেকে মাথা পড়ে গেল। বোধানন্দ কিছুক্ষণ নাড়ি দেখে কেঁদে ফেললেন। মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডাকা হলো। ডাক্তার মজুমদার তখন বরানগরে নদীর ওপারে থাকেন। ব্রহ্মানন্দ, সারদানন্দ এবং ডাক্তার মজুমদারের মঠে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। বেশ কিছুক্ষণ হার্ট সচল করার চেষ্টা করার পর রাত বারোটা নাগাদ ডাক্তার স্বামীজিকে মৃত ঘোষণা করলেন।
দেহ দাহ করার অনুমতি মেলেনি, ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি— এমন নানা অপমান বিবেকানন্দকে সহ্য করতে হয়েছে মৃত্যুর পরেও। কিন্তু তিনি মহামানব। একা একটা যুগ নিজের কাঁধে বয়ে নীরবে চলে গিয়েছেন। কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর? এই নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। চোখগুলি নাকি জবাফুলের মতো লাল হয়ে গিয়েছিল, নাক-মুখ দিয়ে অল্প রক্ত বেরনোর চিহ্ন ছিল। বিপিন ঘোষ বলেছিলেন, সন্ন্যাসরোগে মৃত্যু। মহেন্দ্র ডাক্তার বলেছিলেন, হৃৎক্রিয়া বন্ধ হওয়াই প্রধান কারণ। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, “মাথার ভেতর কোনও শিরা ছিঁড়ে গিয়েছে।” ডেথ সার্টিফিকেট না থাকায় এই রহস্যেরও কোনও সমাধান সম্ভব হয়নি।