কলকাতার শীতকালের সঙ্গে শত্রুতা! কবি অমিতাভ মণ্ডলের চিঠিতে ধরা অন‍্য এক সময়

Bengali Poetry: চারপাশের অতিসাধারণ সব কথা, এমনকী, পারিবারিক কথা-গল্পও, তার কবিতার বিষয়।

তখন তুষার ছিল না তারা বলে। বৃষ্টি ছিল না তারা বলে। তখন বজ্রপাত হত না। মেঘ বা কুয়াশাও ছিল না। এরই মাঝে ৭১/এ লেনিন সরণি। তবু ওই ঠিকানায় প্রথম যাওয়ার দিনটি আজ আর মনে নেই।

ধর্মতলা স্ট্রিট আর তালতলা অ্যাভিনিউয়ের ক্রসিংয়ে ডানহাতি কোণের ওই-যে চারতলা বাড়িটা? ওরই একতলায় নানান খুচরো দোকান। ভাড়াটেদের। দোতলায় প্যাথল্যাব। অবসরের পর বাবা ডাক্তার নিখিলরঞ্জন মণ্ডল সেটি নিয়েই থাকতেন। তিনতলার দুটো ঘর সে-সময় ছিল, বলতে গেলে, আমাদেরই। চারতলায় তখন বাবা-মায়ের সঙ্গে শুধু সে— অমিতাভ। মণ্ডল।

লম্বা। শ্যামলা। বাড়িতে থাকলে পাজামা আর হাওয়াই শার্টই যথেষ্ট। বললাম চারতলা। কিন্তু তার ওপরে ছিল কিচেন আর ডাইনিং। মূল বাড়ির ওপর দরকারি অংশটি।

আরও পড়ুন: ‘ওয়েদারটা তোর হাসির মতো’, সোমক দাসের চিঠি ও প্রাচীন বটতলা

খুব বেশি ছুটে বেড়াতে হয়নি অমিতাভকে। কাছেই হেয়ার স্কুল। কফি হাউজ। আর-একটু এগিয়ে স্কটিশ চার্চ। ব্যস। আর এদিকে হাঁটাপথে মেট্রো থেকে গ্লোব— নানাবিধ হলিউডি ছবি। দেশের বাড়ি একটা থাকতেই হয়। সেটাও প্রায় নাগালে— ঘাটাল। আমার মেসটাও সিধে নাক-বরাবর। আমহার্স্ট স্ট্রিট। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। সেখান থেকে সোজা দক্ষিণমুখো। ক্রিক রো ক্রশ করে সোজা গেলেই লেনিন সরণি— মানে অমিতাভর বাড়ি।

জন্ম কিন্তু বীরভূমে, লাভপুরে। লাভপুরের সরকারি হাসপাতালে বাবা তখন ডাক্তার। সেইসূত্রে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্টতা। সেইসব পুরোনো কথার মাঝে মাসিমার মুখে একদিন শুনেছিলাম— ‘পার্থর অমিতাভ নামটা তো ওঁরই রাখা।‘ ওঁরই অর্থে তারাশঙ্করের। আর শুনেছিলাম ‘কবি’-র স্রষ্টার শেষযাত্রার বর্ণনা। টালা থেকে নিমতলা। কলকাতার লোকারণ্যে বীরভূমের গাঁয়ের এক সন্তানের আশ্চর্য অতিক্রমণ।

একটু হলেও, সে ছিল আলাদা। অমিতাভ। বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র সে-ই চমৎকার ‘না’ বলতে পারত। দু'-বার ভাবত না।

কোনো চক্ষু নাই
তবু চক্ষু দর্শন করিতেছে
কোনো কর্ণ নাই
তবু কর্ণ শ্রবণ করিতেছে
কোনো নাসিকা নাই
তবু নাসিকা ঘ্রাণ গ্রহণ করিতেছে
কোনো রসনা নাই
তবু বিষ সুস্বাদ ঠেকিতেছে
...
কোনো কথা নাই
তবু কথা বলিতেছে
তবু কথা বলিতেছে

তার ‘রূপশালা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতা।

ইনল্যান্ডে চিঠি লিখতে পছন্দ করত। এক-আধটা খামের ব্যবহার রয়েছে যদিও, পোস্টকার্ড কদাচ না। প্রথম চিঠির তারিখ ১ এপ্রিল ১৯৭৯। অমিতাভ লিখছে—

একরাম,

‘রাম খুব অসুস্থ।‘ রামের জায়গায় ‘আমি’ এই প্রয়োজনীয় সর্বনামটি বসানোই যেত, কিন্তু ফলস্বরূপ বাক্যটির সাথে আমার যে involvement ঘটে যাবে— তা আমার মনপসন্দ্ নয়।

সুতরাং এইভাবেই (অবশ্যই স্বাস্থ্যবিষয়ক কথাবার্তাগুলি) – রাম এখন দিনে চারটে এন্টিবায়োটিকস (Septran), একটা Multivitamin (Cobadex), মাঝেমধ্যে Palmocod, এবং প্রত্যেকদিন Ice ও Lemon সহযোগে রবিনসনের বার্লি খাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড় করে উঠে এলে, Kafka’র সাথে খুব বেশী জড়িয়ে পড়লে, রাস্তায় হাঁটলে, রামের ধারণা, তার এক অমোঘ imaginary হাঁপানি হয়। বাংলায় যাকে বলে শ্বাসকষ্ট। অকারণ ঘরবন্দী হয়ে থাকলে শরীরে শ্যাওলা পড়ে। রাম এখন তিরতিরে শ্যাওলার চাদর গায়ে দিয়ে একরামকে চিঠি লিখছে।

রাম কি এখন বনবাসে আছে?

রামের সংবাদ এখানেই শেষ। আমি এখন Joyce পড়ছি। পাঁচ-ছ পাতা পড়েছি, জয়েসকে সাহিত্যের পয়লানম্বর dress-maker বলা চলে। এখন অব্দি এই। পরে অন্য কথা বলতে পারলে সুখী হব। কারো সম্পর্কে চট করে disillusioned হতে আজকাল ভাল লাগে না। বয়স বাড়ছে না রামের অসুখ বাড়ছে— কে জানে!

পৃথিবীর এই সমস্যাসংকুল Oil-যুগে প্রসূন তার সদাহাস্যময় enterprising moodটি বজায় রেখেছে। পয়সা নিয়ে, বিনে পয়সায় প্রসূন জ্ঞানদান করছে। আমাকে Philosophy পড়াচ্ছে, আর আমি সেইসব জ্ঞান অন্য আরেকজনকে চালাতে গিয়ে দেখছি— সব ভুলে গেছি।

পার্থদা চাকরি পেয়েছে। এবার কোলকাতায় পার্থদার মুখে ‘অফিস আছে’ এটা শোনবার জন্যে আমরা, কমিয়ে বললে, সত্যি সত্যিই অস্থির।

ঘনশ্যামের ধারণা আমি sophisticated, তা ঐ sophisticated আলাপই হয় আর কী। একদিন প্রেসিডেন্সির চাতালে দেখলাম কয়েক ঘণ্টা rural ঘুম দিল।

রামের এখন স্নান করবার ও খাবার সময় হয়েছে।
শুভেচ্ছান্তে,
অমিতাভ

হারালে হারিয়েছে। তারপরও অমিতাভর চিঠি রয়েছে সতেরোটি। প্রসূনের এক কম, ষোলো।

ওই-যে বললাম তিনতলার দুটো ঘরের কথা। ওখানে বন্ধুদের মধ্যে সম্ভবত আমারই সময় কেটেছে বেশি। বেশ কিছু রাত্রিবাসও হয়েছে। আর, দিনের বা সন্ধের কয়েকটা আড্ডা তো বিখ্যাত হয়ে আছে। কে ছিলেন না সেসব আড্ডায়? উৎপলকুমার বসু থেকে জহর সেনগুপ্ত— কে নয়? অমিতাভর আশ্চর্য প্রতিভাবলে ঘরদুটো হয়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং ওড়ার ক্ষমতাবতী। এমনকী, নিচে হাঁক দিলে সুশীল সিগারেটও গুটিগুটি হেঁটে উঠে আসত। অন্য পানীয়দের জন্য লাগত একটুখানি তদবির।

সেই যেদিন নিশীথ ভড়ের বাড়িতে গল্প পড়ে রিফার ধরিয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল, মুগ্ধ-সবার সামনে সেদিনই হল তার ব্যাপটিজম।

এখানে একটা চিঠি। তার বছর পাঁচেক পর, ১০ জানুয়ারি ১৯৮২-তে লেখা।

... কোলকাতার লোকেরা এখন চেন-স্মোকারের মত একটা উৎসবের আগুন থেকে আরেকটা উৎসবের আগুন ধরিয়ে নিচ্ছে। আমরাও বাদ যাইনি, আগুনের হল্কা আমাদেরও বুকে, পিঠে, মাথায়, চোখে এসে লেগেছে। তবে আপনি তো জানেন উৎসবের সাথে আমাদের শত্রুতা, আমাদের অনিশ্চয়তা, ক্লান্তি, বিরক্তি, কোলকাতার শীতকাল। এ সম্পর্কে অন্য কোনো কথা আপনার কোলকাতায় আসা অব্দি মুলতুবী থাকল। কারণ ইদানীং আমাদের কথাবার্তা, ব্যবহারের আনাচেকানাচে যে silence ছড়িয়ে পড়েছে, তা খুবই অর্থবহ।

প্রসূন— একমাস পক্সে ভুগে তারপর এখন WBCS-এর জন্য পড়াশোনা করছে।

অনির্বাণ— প্রায় মাসদেড়েক হল South India-তে P.O.’র training-এর কারণে ব্যস্ত। অনির্বাণ State Bank’এর P.O. পরীক্ষায় All India-তে 4th হয়েছে। অনির্বাণ ওর প্রথম কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরী করেছে। মারাত্মক। March’এ কোলকাতায় এলে আপনাকে শোনানো যেতে পারে।

সূর্য— সূর্য ঘোষ, শঙ্কর বিশ্বাস, শীতল পালিত এই তিন নামে ‘আজকাল’-এ লিখছে। February’তে ওর ছেলে হবে।

পার্থদা— পার্থদার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয় না, কিংবা কথা হয়, দেখা হয় না। সেই tradition.

রণজিৎ- গোদারের একটি ছবি দেখার দিন আমার পেছনে বসেছিলেন। হল থেকে বেরিয়ে জানালেন— অমিতাভ! সিনেমা দেখতে দেখতে এই প্রথম আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।...
শুভেচ্ছান্তে
অমিতাভ
পুনশ্চ- আমি একটা গল্প শেষ করেছি।

পরে গল্প থেকে কবিতায়। প্রথম বই ‘আলো নয় অন্ধকার নয়’। চতুর্থ প্রচ্ছদে লেখা ছিল—

... সমসাময়িক বাঙলা কবিতার অবয়বে, জীবনানন্দ-কথিত মহাকবিতার লক্ষণাক্রান্ত এই শৈলী যদি কেউ অভ্রান্তভাবে চিনে নিতে চান, তবে অমিতাভ মণ্ডলের (জন্ম ১৯৫৬) এই সাম্প্রতিক কবিতাগুলি, সেই নির্জন পাঠকের, একমাত্র নির্ভরস্থল হয়ত হয়ে উঠতে পারে।

দুই জামাইবাবুর একজন তখন লন্ডনপ্রবাসী চিকিৎসক, অন্যজন ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা। এ-হেন বাড়ির পারিবারিক দুশ্চিন্তাগুলো সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অমিতাভ বেছে নিয়েছিল সেই ভয়াবহ পথ, যে-পথ সরল আর বৈচিত্র্যহীন। যে-পথ অতি সাধারণ। কাফকার প্রসঙ্গ চিঠিতে এলেও অমিতাভ ক্রমে কবিতার নীরবতার সান্নিধ্য কামনা করেছে। শ্রবণশক্তিকে একাগ্র করার চেষ্টা করেছে সেই নীরবতার ধ্বনি শোনার জন্যে।

কেহ আসিবে
ইহা তোমার কল্পনা
কেহ আসিতেছে, কেহ আসিতেছে...
ইহা তোমার কল্পনা
কেহ সিঁড়ি ভাঙিতেছে
কেহ উঠিয়া আসিতেছে
ইহা তোমার কল্পনা
পদশব্দ। পদশব্দ।
কল্পনা। কল্পনা।...

এই কবিতাংশটি রয়েছে ‘প্রবাস’ কবিতাগ্রন্থে।

কিন্তু জীবনের এমন একটি পর্বে পৌঁছতে তাকে কম লড়াই করতে হয়নি। ১ জানুয়ারি ১৯৮৬-র একটা চিঠি এরকম:

একরাম,

একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে। যদিও কোলকাতায় আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল আপনি খুবই ব্যস্ত। তাও বিরক্ত করছি এ কারণে যে, কাজটা হয়ত খুব একটা কঠিন হবে না।

আপনার হয়ত মনে আছে যে শান্তিনিকেতনে এ-মাসের (জানুয়ারি, ৮৬) প্রথমে আমার একটা পরীক্ষা দেবার ব্যাপার আছে। পরীক্ষাটা যতদূর জানি ৮-ই জানুয়ারি। যদিও এখনও অব্দি কোনো চিঠি আসেনি। আমাকে যেতে হবে ৭ তারিখ।

৭ তারিখ বেলা ১টা থেকে অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা হিসেবে আমার নামে সস্তা দেখে একটা Single bed ঘর বুক করে রাখতে হবে।... যা হোক যদি পারেন বা না পারেন, তাহলেও ওখানে পৌঁছে কোনো হোটেলে জায়গা পাওয়া যায় কিনা জানাবেন। আপনার দ্রুত উত্তরের আশায় রইলাম।...

ঘর ও বাইরের চিরাচরিত অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাড়া আর বিশেষ কোনো ঘটনার খবর নেই। দেখা হলে কথা হবে।
শুভেচ্ছান্তে,
অমিতাভ

সব কিছু হাতের বা পায়ের নাগালে পেয়ে যাওয়ায় বেশি ঘোরাফেরা তার অভ্যাসে কোনওদিন ছিল না। কেউ বিশ্বাস করবে না-যে সব চেয়ে দূরের জায়গা বলতে অমিতাভ গেছে ওই কাশী পর্যন্তই! বহু শত বছর হল— শত কেন বহু হাজার বছর— বাঙালিদের সেখানে যাওয়া-আসা।

কোথায়-যে ফারঘানা! বহু দেশ ঘুরে ভারতে সাম্রাজ্যের ভিত শক্ত করতে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরছেন তখন। যমুনা, গঙ্গা, সরজূ, গোমতী নদীপথে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে ঘোরার সময় জহির’উদ-দিন মুহম্মদ বাবুর একাদিকবার প্রাচুর্য্যে ভরা এবং শান্তিপ্রিয় বাংলার উল্লেখ করেছেন। হোসেন শাহর ছেলে নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহ তখন বাংলার সুলতান। গঙ্গার ওই অঞ্চলে বাংলার নৌকো মুঘল বাহিনীর চোখে পড়েছে। ওই বছরের ২৮ মার্চ আত্মজীবনীতে (দ্য বাবুর-নামা, তুর্কি থেকে অনুবাদ: অ্যানেট সুসানা বেভারেজ) সম্রাট বাবুর লিখছেন (পৃষ্ঠা ৬৫৮, ১৯২২)—‘টু লুক অ্যাট আওয়ার গ্রাউন্ড অফ আ ইয়ার এগো, ফ্রম হুইচ উই হ্যাড স্টার্টেড ফর জৌনপুর, আই ওয়েন্ট টু অ্যাবাউট আ কুরোহ (ক্রোশ) লোয়ার দ্যান দ্য মাউথ অফ দ্য জৌনপুর-ওয়াটার। আ ফেবারেবল উইন্ড গেটিং আপ বিহাইন্ড, আওয়ার লার্জার বোট ওয়াজ টাইড টু আ স্মলার বেঙ্গলি ওয়ান হুইচ, স্প্রেডিং ইটস সেইল, মেড ভেরি কুইক গোয়িং।

আর আমাদের অমিতাভ! শেষ পর্যন্ত চাকরি হলো তার কলকাতার বাইরে, শান্তিনিকেতনে। ১০ মে, ১৯৮৬ সে লিখছে—

একরাম,
চাকরীটা হয়েছে। সম্ভবত এ-মাসেই Join করতে হবে। বাড়ীটা দ্রুত দরকার এ কারণে যে, appointment letter পাওয়া মাত্রই join করতে হবে।... মহুয়া এখানে একটা কিছু পেয়ে গেলে, আমি এ চাকরীটা নিতাম না। এখন যত দিন ও না পাচ্ছে, তত দিন সমরদার সৌজন্যে শান্তিনিকেতনে একটি মায়ানরক দর্শন করতে হবে, বুঝতে পারছি।...
শুভেচ্ছান্তে,
অমিতাভ

মহুয়া— অমিতাভ-পত্নী। সমরদা (দত্ত)— শান্তিনিকেতনে অ্যাগ্রো-ইকনোমিক রিসার্চ সেন্টারের তৎকালীন ডিরেক্টর। পরে আইআইএম আহমেদাবাদ-এর ডিরেক্টর। পারিবারিক বন্ধু। তুমুল-ব্যস্ত মধ্য কলকাতায় বাড়ি হলেও বিভিন্ন জেলায় কেটেছে জীবনের অনেকটা সময়। জেলায়-জেলায় হয়েছে নতুন সব আত্মীয়।

পুরন্দরপুরে তখন আমার ওষুধের দোকান। অমিতাভ শান্তিনিকেতনে। সুযোগ পেলেই চলে যেত সেই দোকানে। সঙ্গে সঙ্গে সাটার যেত নেমে। আর আমরা ঘুরতাম এলোমেলো। কখনো পৌঁছে যেতাম সেইখানে, যেখানে চারপাশে ছায়াচ্ছন্ন আমবাগান। সামনে কাজল-কালো জল। সারাটা দুপুর ঠাকুরপুকুরের পাড়ে দুজনে কথা বলছি। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। কেউ না, অন্ধকার একসময় আমাদের তুলে দিত।

তার সব বইয়ের প্রচ্ছদ প্রায় একইরকম। যেমন উনিশ-বিশ শতকে হতো। এই জগতের কথা, চারপাশের অতিসাধারণ সব কথা, এমনকী, পারিবারিক কথা-গল্পও, তার কবিতার বিষয়। প্রসাদগুণে সেসব কথা অসামান্য হয়ে উঠে অক্ষরে অক্ষরে বিচরণ করে, ওড়ে, ফিরে-ফিরে আসে নিজেরই সন্ধানে, যাকে আমরা বলি— আত্মানুসন্ধান।

‘প্রবাস’-নামের কবিতাগ্রন্থে অমিতাভ লিখেছে—

পুরন্দরপুরে দু’পাশের শ্যামসমারোহে
লাল পথে, মন্থর রিক্সায়
একরামের পিসতুতো দাদা বলিলেন
দেশ কোথায়?
কোলকাতায়
জমিজমা আছে তো, বন্যা হয়?
শহরের যুবক স্তব্ধবাক হইয়াছিল
কত কিছু ভুলিয়া গিয়াছি
ছোট, বড় জ্ঞানবানের মুখ ভুলিয়াছি
সেই পিসতুতো দাদার
স্নেহার্দ্র মুখখানি ভুলি নাই
ভুলি নাই তাঁহার কণ্ঠস্বরের
ভুবনমোহিনী মায়া
যেমন ভুলি নাই বাংলা ভাষা...

More Articles