চিরতরুণী নক্ষত্রের নামে তাঁর নাম! কোনও ঠিকানায় থিতু হননি কবি অনুরাধা মহাপাত্র
Letters of a Bengali poet: অনুরাধা মহাপাত্রর সঙ্গে চিঠিপত্রের সম্পর্ক এক দশকের। এর মাঝে কলকাতা এলে কফি হাউজে, প্রেসিডেন্সির সিঁড়িতে, দেখা।
২৮ সেপ্টেম্বর। সাল ১৯৮৫। স্থান সিউড়ি সার্কিট হাউস। কক্ষটি প্রশস্ত। চারদিকে ছড়ানো নানা আকারের সোফা। সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, সস্ত্রীক পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, অমিতাভ মণ্ডল, কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রভাত সাহা, বাবলি সাহা, উৎপলকুমার বসু, সোমক দাস। বাকিদের নাম মনে পড়ছে না। রাত ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যাচ্ছে। ঘাড়ের ওপর মাথা সবার সোজা যদিও, সেসব মাথার চুলে নৈশশিথিলতা।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আচমকা দূর কোণের এক সোফা থেকে— না কি নিচের ঘোলাটে কোনও নদীতীর থেকে— রাতের তরঙ্গ আর ঝোপঝাড় চিরে ভেসে এল তীক্ষ্ণ আর্তি: ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…।
অনুরাধা মহাপাত্র।
একরাম,
‘পথে চলে যেতে যেতে’— আরও যদি কোথাও চলে যাওয়া যেত! বীরভূম স্মৃতি মনে থাকবে। সেদিন আমরা ভোরে গোপনে দেশত্যাগ করেছি। আপনি ঘুম ভেঙে এসে দেখছেন, পাখিরা উড়ে গেছে। মদ ও গানের মিশে যাওয়া আড্ডা মনে থাকবে অনেকদিন। আর একঝলকে দেখা অজয়, বক্রেশ্বর, বিকেলে আমার একার ভ্রমণে সেই ময়ূরাক্ষী, পথে যেতে একটি অদ্ভুত ফুল, একটি দুটি গাছ— মনে থাকবে অনেকদিন। রাতে পার্থপ্রতিমের গান ‘পথে চলে যেতে যেতে’— প্রায় ময়ূরাক্ষী। উৎপলের নাচ মনে রাখার মতো। বাবলির ‘ওগো আমার চির-অচেনা পরদেশী’— মনে থাকবে অনেকদিন। অমিতাভ (মণ্ডল)-র কথা, সংযুক্তার ঢুলু ঢুলু নয়নে গান, অঞ্জনা বৌদির গান— সব।… ছোট্ট একটি কথা মনোবেদনায় রয়েই গেল, আপনাকে জানাই; সে রাতে আমার নিজের ইচ্ছে করছিল একগ্লাস সিদ্ধি এবং চাঁদের আলোয় ময়ূরাক্ষীর দিকে চলে যাওয়া। চিঠি দেবেন, অবশ্যই।
অনুরাধা।
সেদিন ছিল কবিতা পাঠ। আমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল—
কবিতাপূর্ণিমা
’৯২
২৮/৯/৮৫, শনিবার, বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে শিউড়ির জিলা পরিষদ হলে, পূর্ণিমার প্রতিস্পর্ধী একটি শ্রুতি-অনুষ্ঠান, অর্থাৎ
(এরপর পনেরোজন কবির নাম), কবিতাপাঠ: সদলবলে আসুন।
আয়োজক: স্বপনকান্তি ঘোষ, প্রশান্ত মজুমদার।
যাঁদের নাম ছাপা হয়েছিল, তাঁদের কেউ কেউ যেতে পারেননি। শুধু নিশীথ ভড় চিঠিতে জানিয়েছিলেন— …ক্ষমা কি করবে? পরে যদি আবার অনুষ্ঠান হয়, গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করব।
আরও পড়ুন: যত না জমজমাট গল্প ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল নীরবতা! মনে পড়ে কবি গৌতম বসুকে
কিন্তু এসব অনেক পরের ঘটনা। তিরাশির জানুয়ারিতে অনুরাধার প্রথম চিঠি— ৯৩ পরুইপাকা রোড, ডাকঘর: সরসুনা, কলকাতা ৭০০০৬১ থেকে। তখনও নন্দীগ্রাম-দুহিতার আস্থা ছিল কোনও একটা ঠিকানার প্রতি। আস্থা ছিল নির্ভরযোগ্য কোনও জীবিকার প্রতি। ক্রমে যত দিন গেছে— কলকাতার ফুটপাথে, পথে, চা-কফির আড্ডায়, অসংখ্য সিঁড়ির ঘষটানি খেতে-খেতে সেই আস্থা কবে যেন ক্ষয়ে গেছে। উননব্বইয়ের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত— ছ'-বছরে মোট তিনটে ঠিকানা। শেষ দুটোয় শুধু মিডল রোড আর বকুলতলা। অর্থাৎ, নিছক নিজের অবস্থানটুকু জানানোর চেষ্টা। ঠিকানা নির্ভরযোগ্য ছিল না বলেই কি এমন অস্পষ্ট? যতবার সেই নির্ভরতার স্খলন ঘটেছে, ততবার তাঁকে পালটাতে হয়েছে বাড়ি। আটাত্তর সাল থেকে আজ পর্যন্ত নানা কারণে বাড়ি বদলের সংখ্যা অন্তত বার পনেরো! এবং, কলকাতার চতুর্দিকে। মূল শহরের একটু বাইরে।
আমাকে ছুঁয়ো না সূর্য
অকালব্রত আমার
শেষগ্রহের নারী ক্ষুধা নেই
পাখির নিবিড় উষ্ণতা
শুধু অকূল জল ছেনে তুলি
অনল পিতলপুরুষ
কবিতার নাম ‘খোয়াই’। বইয়ের নাম ‘অধিবাস মণিকর্ণিকা’। ‘ছাইফুলস্তূপ’-এর পর এটি দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। বয়স তখন তিরিশ। পরে তাঁকে বলা হবে— নক্ষত্রনাম্নী এক কবি।
এই লেখাটি তুলতে গিয়ে খেয়াল হলো আপনাকে দেওয়া কবিতাদুটির মধ্যে একটিতে ‘অল্প’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এই কবিতায়ও ‘অল্প লাবণ্য’ কথাটি ব্যবহার করেছি। আপনি লক্ষ করে হয়তো ভাববেন যে ‘অল্প’-র এত আধিক্য কেন? কিন্তু আমি নিরুপায়, আমার যথেষ্ট দুর্বলতা এতে কাজ করছে। আপনার কুশল প্রার্থনা করি।
শুভেচ্ছান্তে
অনুরাধা মহাপাত্র
০১-০১-৮৩ তারিখে লেখা চিঠিটি ৯৩ পরুইপাকা রোড সরসুনা থেকে, যেটি কলকাতা-৬১ বলে বর্ণিত। এটিই প্রথম চিঠি। একই ঠিকানা থেকে ১১-০১-৮৩ তারিখে লেখা পরের চিঠি:
আপনার হাতে দু'টি কবিতা দেওয়ার পরে আমি ডাকে আর একটি কবিতা পাঠিয়েছিলাম। পেয়েছেন কি?...।
শুভেচ্ছান্তে
অনুরাধা মহাপাত্র
পরপর দু'টি চিঠিতে যেসব কবিতা পাঠানোর কথা লেখা হয়েছে, সেগুলো অধুনাবিলুপ্ত ‘পুনর্বসু’ পত্রিকার জন্য।
উনিশশো আটাত্তরে কলকাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়তে, না কি অতিকায় এই শহরটাতে নিঃশেষে বিলীন হতে? উনআশিতে কলকাতা ছাড়ি আমি। এক দশকের জন্য। তাঁর সঙ্গে চিঠিপত্রের সম্পর্ক ওই এক দশকের। এর মাঝে কলকাতা এলে কফি হাউজে, প্রেসিডেন্সির সিঁড়িতে, দেখা। কখনও পার্থপ্রতিমের, কখনও-বা সোমক দাসের সঙ্গে, আড্ডায় সঙ্গী অনুরাধা। খুব-যে গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস ছিল, বা আছে, এমন নয়। অনুরাধার মুখের ভাষাটি তাঁর কাব্যভাষার মতোই।
মধ্যরাতে নীল পদ্মের নির্জনতা ছাই হয় দুজনের অবচেতনেই
দুটি নৌকো মিলে যেতে থাকে শান্ত স্রোতের গহ্বরে
ভ্রমরেরা আনমনে চূর্ণ চূর্ণ নক্ষত্রের আলিঙ্গনে মিশে যেতে চায়।
এইসব দূরশ্রুত তৃষ্ণার জলধ্বনি পাথরের অনন্ত, বিভঙ্গে
একদিন মুছে যাবে প্রেম আর নৈরাজ্যের স্মৃতি
আজ কাম ও মৃত্যুর বাইরে তুমি একক স্বাধীন
তাই নগ্ন বৈরাগ্যের রঙে পদ্মও এত লেলিহান।
‘আর্যভিক্ষুণী’ বইয়ের প্রথম কবিতা— ‘সারল্যও দুরূহ হতে থাকে’।
হজরত রাবেয়া বসরি। অষ্টম শতকের এই তাপসী বিশ্বাস করতেন— পরমকে পেতে গেলে ত্যাগ করতে হবে সব কিছু। এমনকি স্বর্গপ্রাপ্তির কাঙালও তিনি ছিলেন না। বলতেন— হে আল্লাহ্! জান্নাতের লোভে আমি যদি সাধনা করি, তাহলে আমি যেন কখনো জান্নাত না পাই। আর, যদি জাহান্নামের ভয়ে তোমার ইবাদত করি, তাহলে যেন জাহান্নামেই যাই। তোমার নৈকট্য পেতে যদি ইবাদত করি, তাহলে তোমার দর্শন থেকে এক মুহূর্ত যেন বঞ্চিত না হই। আমি চাই শুধু তোমাকে।
সর্বস্ব হারানোর সেই সাধিকা যাচ্ছেন হজে। দ্বিতীয় বার। মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছে, কাবার অদূরে, প্রভুর ধ্যানে হয়ে পড়লেন মগ্ন। হঠাৎ দেখলেন— খোদ কাবা তাঁকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসছে। সাধিকার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল— এ ঘর নিয়ে আমি কী করব? আমি তো চাইছি ঘরের মালিককে। ঘরের মালিক নিজেই বলেছেন— আমার দিকে যে আধ হাত এগিয়ে আসে, তার দিকে আমি এক হাত এগিয়ে যাই। শুধু কাবা নিয়ে আমি কি খুশি হতে পারি?
কিন্তু কবিকে কি সাধক হতেই হবে? রাবেয়া বসরির মতো?
না। তবে তাঁকে আশ্রয় নিতেই হবে ম্যাজিকের, যার প্রধান দু'টি ধারা কাব্যের অন্তর্বস্তুতে অনুসৃত হয়েছে। সে-দু'টির একটি হলো অনির্বচনীয় পবিত্রর চেতনা, অন্যটি অপ্রকাশ্য মন্দের ধারণা।
দেখি গঙ্গা আছে অনন্ত গঙ্গায়
আকাশও ডুবে আছে আকাশের প্রেমে
হৃদয়, যে কোথা থেকে আসে আর কোথায় হারায়…
প্রশ্ন আছে, তবু, প্রশ্নহীন
তোমাকে ভালোবেসে
অপেক্ষায় আছি, তবু, চির অপেক্ষায়…
ছোট্ট লেখাটির নাম ‘একটি সরল কবিতা’, যেটি মোটেই সরল নয়। রয়েছে অনুরাধার ‘শ্রীমায়ের আকাশ’ বইয়ে।
আপনার খোলাখুলি মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আপনার চিঠি অনেকবার আমি পার্থদার কাছে পড়ে মুগ্ধ হয়েছি এবং আপনার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায়। না, আপনার মতামত নিয়ে আমার কোন কিছু বলার নেই। তবে আপনি যদি আমার বই সম্পর্কে আপনার মতামতগুলি আরও স্পষ্ট ভাষায় জানান, তাহলে আমার পক্ষে উপকার হয়। অবশ্য কোন চাপ সৃষ্টি নয়; ইচ্ছে হলেই, তবে। আপনার চিঠিটি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, বন্ধুদেরও পড়িয়েছি। সত্যকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিক দিয়ে দেখারও একটা তাগিদ অনুভব করছি। আমি কি করে আপনার কবি হতে পারি? তবু আপনার মতামত আমায় খুব ভাবিয়েছে। প্রসূনের কাছে আপনার জন্য দুটো বই রেখে দিয়েছি। কবে আসছেন, চিঠি দিয়ে জানাবেন। লিখছেন তো?…
চিঠিটি লেখা ২৪-০৪-৮৪। সরশুনা থেকে। আমার গ্রামের ঠিকানায়। ঠিক কী লিখেছিলাম, জানি না। তবে, অনুরাধা মহাপাত্র যে আমার কবি নন, এই কথাটা লেখা ছিল অবশ্যই। উত্তর পেয়ে সেদিন যেমন আনন্দে মনটা ভিজে গিয়েছিল, চিঠিটা পড়ে আজও তেমনই গর্বের উন্মেষ হলো অনুরাধার জন্য। আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট। কম লম্বা নয় জীবনটা! আর, সে-যে কী জীবন!
মনে আছে, ভোপালে প্রথমবার গিয়েছি, ভারতভবনে কবিতা পড়তে। হোটেলে আমার রুম-পার্টনার অসমিয়া কবি নীলিম, সারা দেশে যাঁকে অবিরাম ঘুরতে হয় কবিতা পড়ে-পড়ে। খানিকটা সংকটে আছি। এমন সময় দরজায় কালো, রোগাটে এক ভদ্রলোক। সাদা হাওয়াই শার্ট। মুখে হাসি। প্যান্টের রং আর মনে নেই। হিন্দিতে জানতে চাইলেন— এখানে একরাম আলি নামে কেউ আছেন কি না।
ইতিবাচক সাড়া পেয়ে বললেন— আনুরাধাজি পাঠিয়েছেন। উনিও আসছেন এখানে।
অনুরাধার পাঠানো ফরিস্তা। উদয়ন বাজপেয়ী। এবং সত্যিই ফরিস্তা! হিন্দি ভাষার অসাধারণ কবি। তাঁর বন্ধু, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিতাইন সঙ্গীতা গুন্ডেচা-সহ আমাদের নিয়ে গেলেন এক কফিখানায়। সামনে লেক। লেকের জলে আলো ভেঙে-ভেঙে যাচ্ছে। আমরা কথা বলছি বাংলা কবিতা নিয়ে। বিনয় মজুমদার তাঁর আগ্রহের বিষয়। কিন্তু অনুরাধাই উদয়নের বিশ্বস্ত সুতো, যেটা ধরে তিনি বাংলা কবিতার পিচ্ছিল সুড়ঙ্গ-পথে এগোতে চাইছিলেন। আমি কখনও-বা কথা জুগিয়ে যাচ্ছিলাম মাত্র।
এই যেমন এখন। সন্ধে হয়-হয়। সূর্য ডুবেছে না কি মেঘের আড়ালে আর-একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, বোঝা যায় না। কিন্তু, এখানে ডুবলেও কোথাও তো উঠছে! সেখানে কচি রোদ। যেমন নাকি বছর বারো আগে, ভোপালে, লেকের জলে, বিচ্ছুরিত হচ্ছিল অনুরাধা-নাম্নী চিরতরুণী এক নক্ষত্রের আলো!