প্রতিষ্ঠার দিকে ছিল তাঁর আড়নজর, ক্ষমতা ছিল ঘেন্নার

পার্থপ্রতিম চান বা না-চান, সাতের দশকের কয়েক বছর ছিলেন— না কি হতে চেয়েছিলেন?— তরুণ কবিদের কুলগুরু। প্রতিষ্ঠার, ক্ষমতার, দিকে সম্ভবত তাঁর ছিল আড়নজর।

 

সরু ঠ্যাং ফেলে ফেলে খাল-বিলে যেমন হাঁটে বক, তেমনই হাঁটতে হতো তাঁকে, কৈলাস বোস স্ট্রিটে, লোহাপট্টিতে। ছড়িয়ে-থাকা লোহালক্কড় ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে। একটু এগিয়েই ডানহাতে ঘোষ লেন। এঁকেবেঁকে ঠেকেছে সেই বিবেকানন্দ রোডে। তার আগে গোঁত্তা খেয়েছে লাল রঙের পেল্লায় যে-বাড়িতে, সেটাই ঘোষবাড়ি। গলি ওদেরই নামে।

বহু পুরনো ঠাকুরদালান। বছরদশেক আগে পুজোর সময় তারই উঠোনে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে বাড়ির এক কর্তা ডা. বাসুদেব ঘোষ। হাত তুলে দালানের মাথায় জোড়া-সিংহ দেখিয়ে— যেন লার্ড ক্লাইভ— গর্বোদ্ধত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ওই দেখুন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোট অফ আর্মস। চেনেন তো?’

তাঁদের ছিল জাহাজের ব্যবসা। চারদিকের পুজো-পরিবেশে দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে— ‘জাহাজ আমাদের আজও ছেড়ে যায়নি কিন্তু। এই-যে আমি, ইন্ডিয়া স্টিমশিপ কোম্পানির মেডিকেল কনসালটেন্ট। হাঃ, হাঃ!’

আরও পড়ুন: ‘দিদি মারা গেছেন, চিঠি দিয়ে গেলাম’

একশো বছর ধরে দেশটাকে লুঠ করার পর খাতাপত্তর নিয়ে চলে গিয়েছে শ-দেড়েক বছর আগেই, ২ অগাস্ট ১৮৫৮; তবু গোটা উত্তর কলকাতার কাক-পক্ষীদের ডানায় আজও রয়ে গিয়েছে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরই জলছাপ!

অত দূর যাব না আমরা। গলিতে ঢুকে ডানহাতি সপসপে যে-কানাগলি, তারই ডানদিকের প্রথম দরজা— ১৩সি ঘোষ লেন। ঢুকেই আবছা সিঁড়ি। দোতলা। লালপাড় সাদাশাড়ি মাসিমা। ফের সিঁড়ি বেয়ে ছাদ। সেই ছাদে দু'-তিন ধাপ কাঠের সিঁড়ি। ভাঙলেই আস্ত একটা ঘর।

পার্থ। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। কবি। মৃত্যুর পর ঔপন্যাসিক হওয়ার অপেক্ষায়। সিঁথির মোড়ের ফ্ল্যাটে, বক্স খাটে, তাঁর একাধিক উপন্যাস দিন গুনছে প্রকাশের।

ছাপান্নটি চিঠি। এই ঠিকানা থেকে। যেত— পার্থর ভাষায়: আলি একরাম/তেঘরিয়া গ্রাম/ডাক দমদমা/জেলা বীরভূম।

ফুটপাথে যেমন টিয়াপাখি, চিঠির স্তূপ থেকে টেনে নিচ্ছি যে-কোনও একটা।

২৬। ৩। ৮৫

একরাম,
পরশু স্টুডেন্টস হল বুক করা হয়েছে। সবারই সম্মতি পেয়েছি। একমাত্র সুতপা ছাড়া। সুতপার মতামত জানতে পারিনি আজ এই ১১/১৫ পর্যন্ত। যদি না পড়েন, ওই জায়গায় গৌতম সেনগুপ্ত আসবেন— যদি তিনি-ও না পারেন তবে মোট আটজনই পড়বেন। প্রসূন, মল্লিকা, একরাম, সংযুক্তা, রণজিৎ, অমিতাভ, নিশীথ, অনুরাধা, সুতপা/গৌতম।

এইটা আমার শেষ সৌজন্য কিছু কিছ কবিবন্ধুর প্রতি। এ নিয়ে নানা উত্তেজনা চলছে; আনন্দবাজার স্টেটসম্যানে বিজ্ঞাপন দিতে রণজিৎ-প্রসূন বদ্ধপরিকর।

২৩শে মার্চ আমি ফের অনুবাদ পত্রিকায় বৈশম্পায়নের ১ বছর ধরে ডাকাডাকির পর। তুমি script কি তুলে নিতে চাও? নাকি কিছু পরিবর্তন ঘটাতে চাও? এ বিষয়ে দ্রুত পোস্টকার্ড দাও।

আকরিক তুমি পড়েছ কিনা জানি না, এর মুখ্য আকর্ষণ এবার গৌতম বসু। এই লেখক (কবি গৌতম বসুকে বাদ দিয়ে বলছি) তাঁর গ্রাম্য স্পর্ধা একটু বেশি জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। এই কারণে বলছি যে, ‘দেবী’ বইটা নিয়ে তাঁরাই কোনো মন্তব্য করতে পারেন যাঁরা হয় কবিতা লেখেন না/ লিখলে ছন্দটা বিশদভাবে জানেন। গৌতম বসু একেবারেই ছন্দ জানেন না। ভাল কথা, সংযুক্তা সম্বন্ধে তোমার পত্রমন্তব্য আমার একেবারেই ভাল লাগেনি। আমার মনে হয়েছে, এই resistance-এর কারণ সংযুক্তার পয়ার, যার আদ্যোপান্ত অভাব ছিলো গৌতম বসুতে— এবং তাতে তুমি ফুল্ল হয়েছিলে। একে তোমার দৃষ্টিসংকীর্ণতাই বলবো। চিঠি দাও।

-পার্থ

অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘চৈত্রশেষের কবিতাসন্ধ্যা’। চিঠিতে কবি সুতপা সেনগুপ্ত, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, মল্লিকা সেনগুপ্ত, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ গুপ্ত, রণজিৎ দাশ, নিশীথ ভড় আর অনুরাধা মহাপাত্রর কথা বলা হয়েছে। অনুষ্ঠানটি হয় ৩০ চৈত্র, ইং ১৯৮৫। এছাড়া, 'অনুবাদ' পত্রিকার সম্পাদক বৈশম্পায়ন ঘোষালের আগ্রহে তাঁর প্রকাশনা থেকে আমার একটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের কথা চলছিল; শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। ‘আকরিক’ ছিল পুরুলিয়া থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন। ‘দেবী’ পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যেটি সময়কে পরাস্ত করে ক্রমশ দীর্ঘজীবী হচ্ছে।

ধূপের মতন রাত। তুমি কি এসেছিলে। তন্দ্রা সংশয়, উৎকর্ণ।
স্বপ্নে জেগেছে ঊষা। যা যায়, সব ভুল। জীবন মনে হয় অধমর্ণ।
নিজের ভুলের কাছে। অজ্ঞ ছিল সেও। কেবল প্রিয়তর, শ্বেতবর্ণ।
অশ্বটি ছুটে গেছে। রাত্রি নতমুখ। উন্মোচিত হলো তমোপর্ণ।...

(দেবী, ২৩ সংখ্যক কবিতার অংশ।)

গঙ্গা এবং গঞ্জিকাপ্রিয়, চরসাচ্ছন্ন, তীক্ষ্ণধী। পার্থপ্রতিম চান বা না-চান, সাতের দশকের কয়েক বছর ছিলেন— না কি হতে চেয়েছিলেন?— তরুণ কবিদের কুলগুরু। প্রতিষ্ঠার, ক্ষমতার, দিকে সম্ভবত তাঁর ছিল আড়নজর। কিন্তু ক্ষমতার নীলিমায়, জীবৎকালে, চিরভাসমান থাকার জন্য যা-যা করার দরকার, সেসব কৃৎকর্ম তাঁর কাছে ছিল চরম ঘেন্নার।

মুশকিল হচ্ছে, পার্থ লিখতেন এতই লম্বা চিঠি, পুরোটা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই একটি চিঠির শুরুর অংশ, তারিখ ২২। ৯। ৮০:

আশা করছি ঘঞ্চুর চিঠিতে আমার কিছু কিছু খবর পেয়ে থাকবে। আজ বাইশ তারিখ অফিসে বসে চিঠি লিখছি— মজ্জাভাঙা পরিশ্রম হয়েছে সমস্ত দিন। এভাবেই চলছে। মাঝখানে শুধু তপনের চাকরি পাওয়ার আনন্দমজলিসে জহরকে দুটি ক্রুদ্ধ চড় মেরেছি ৬ তারিখ। ৭ তারিখ সন্ধ্যায় চারজন ক্রুদ্ধ বন্ধুর পাল্লায় পড়ি। তপন, প্রসূন, অমিতাভ মণ্ডল ও বুঁচু।

ঐ ঘটনা ছাড়াও তাঁদের অভিযোগের তালিকা বেশ দীর্ঘ। তপনের অভিযোগ, অমিতাভ বসু আমার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ করেছেন। অমিতাভর অভিযোগ, আমি ওঁকে বরাবরই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি ১) আমি এর বিরুদ্ধে ওকে তার বিরুদ্ধে একে নানা কথা ব’লে বন্ধুমহলে আমার নেতৃত্ব বজায় রাখি ২) আমি অমিতাভকে ‘কূট, রহস্যময়’ ব’লে অপমান করেছি। বুঁচুর অভিযোগ, আমারই পোলিটিক্সজাত কারণে রণজিৎ দাশ লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। প্রসূনের অভিযোগ অজস্র, তার একটি হলো যে চাকরি পাওয়ার পর আমি প্রসূনদের পরিবারে খাওয়াইনি, আমি জীবনকে নাটকীয় করে থাকি...

জানি না তোমার কতোটা ক্লান্ত লাগছে। পরে ঘনশ্যামের কাছ থেকে জানলাম যে প্রসূন দীর্ঘদিন পূর্বেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘Partha is trying to be a guru; but he does not have the capacity...'

জানানো দরকার: চিঠির ঘঞ্চু আর ঘনশ্যাম হলেন কবি-গদ্যলেখক সোমক দাস, কবি জহর সেনগুপ্ত, তপন, প্রসূন, অমিতাভ মণ্ডল ও বুঁচু যথাক্রমে তপন মুখোপাধ্যায় (কবিদের বন্ধু), কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি অমিতাভ মণ্ডল ও গদ্যলেখক প্রবুদ্ধ মিত্র।

লেখালিখির সেই তারুণ্যে এতই জড়াজড়ির জীবন ছিল- যে মহার্ঘ মদিরার গাম্ভীর্যে যেমন ঢেলে-দেওয়া সোডার তারল্য, একজনের গায়ে লেগে থাকত তেমনই আরেকজন। পৃথক করা যেত না।

তবু বলব, পার্থ ছিলেন গুটিয়ে-থাকা প্রাণী। ১৯৭৭ সাল। সেবারই প্রথম। বেশ রাতে। পার্থপ্রতিম আর আমি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে গিয়েছেন তাঁর প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়ি। ভায়া বেলভেডিয়ার, বোনের বাড়িতে পানভোজনের পর। বসার ঘরে বউদি আসা মাত্র যে-ভাষায় আলাপ করিয়ে দিলেন, মধ্যবিত্ত বাঙালি-বাড়িতে সে-ভাষা অ্যাটম বোমা। ছোট মেয়ে? স্বর্ণকুমারী দেবী। বড়ো মেয়ে তখনো না-আসায় শ্যামলদার ডাক— ললি! ললি!

একটু পরই তিনি দরজায়— কী রোগা ছিল মেয়েটা। স্রেফ তাড়ি খাইয়ে শরীরটা ফেরালাম।

পার্থ ততক্ষণে কুঁচকে এইটুকু। এরকম এক ডাইনোসরের পাল্লায় যে পড়তে হবে, কেউ কি আন্দাজ করতে পারে!

সে-রাতে আমাদের ফিরতে দেননি শ্যামলদা। বসার ঘরে, মেঝেয় শীতলপাটি পেতে ঘুমিয়ে ছিলাম আমরা। মাঝে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। দু'দিকে দুই নন্দী-ভৃঙ্গী।

কিন্তু কফিহাউজে পার্থপ্রতিম সিংহ। অন্তত সিংহের ভূমিকায়। আরেকটা চিঠির অংশ, তারিখ ৮। ৭। ৮২:


বাংলা সাহিত্যের বিজন ভট্টাচার্য, সন্দীপন একদিন বললেন: পার্থ, বলে দিয়ো, আমি আর বেঁচে নেই। এ বছর পুজোয় সন্দীপন ২ গল্প ও ১ উপন্যাস, দেশমহানগরআনন্দবাজারে।...

লিখো। তবে কোনো লেখককে নিয়ে নয়, তাতে চিঠির একটা পণ্য হবার দিকে ঝোঁক এসে পড়ে— না কি?... কবিতা, রাজনীতি ও ধর্ষণ বিষয়ে তোমার মতামত সত্যিই জানতে চাই। শেষ কথা, ৮৩র এপ্রিলে ‘ব্যঞ্জনবর্ণ’ বার করছি, শুধু গদ্য নিয়ে। গদ্যগুলির মান: Risk নেওয়া হয়েছে কি না। এতেও লেখার কথা ভেবো। চিঠি দিয়ো।

এইসব চিঠি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল কখন লিখেছিলেন? তার একটা হদিশ পাই তাঁরই লেখায়:

যদিও আমার বয়স ত্রিশ বৎসর ও ২ মাস পূর্ণ হইয়াছে এবং এক্ষণে আমি রবিবারের মধ্যাহ্নে, ত্রিতলে, খাটে বসিয়া আছি, চারদিক বেশ শান্ত, একটি কাক ডাকিতেছে— কেমন ধারণা হইতেছে যে ইহার মধ্যেই মিশিয়া আছে আমার মরণোন্মুখতা। কোনো-না-কোনো একটি সত্য বলিতে ইচ্ছা করিতেছে। আমার ব্যক্তিগত সত্য।...

More Articles