লিবিয়ায় লাশ ভাসছে জলে, সর্বস্ব হারিয়ে যে ভাবে বেঁচে আছে ওঁরা

Libya Floods: তছনছ হয়ে গেল ডেরনা। শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃতদেহ।আর সেইসব মৃতদেহ ঘিরে ভিড় করছে প্রিয়জনদের আকুতি আর কান্না। কেউ লাশ ব্যাগে মুড়ে ত্রাণের প্রার্থনা করছেন, কেউ কেউ গণকবরে দাফন করছেন প্রিয়জনের দেহ।

M

আফ্রিকার শীর্ষস্থানে থাকা একটা দেশ, দেশের নাম লিবিয়া। সাল ২০১১। পতন হল গদ্দাফির। লিবিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়ে গেল। সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনির ভারি বুটের শব্দে রাত জাগে লিবিয়া। সেই থেকে লাগাতার রাজনৈতিক টানাপোড়েন,মুদ্রাস্ফীতি,কালোবাজারিতে জর্জরিত লিবিয়া। অন্ধকারময় ইতিহাসের নবতম সংযোজন ড্যানিয়েল।

তছনছ হয়ে গেল ডেরনা। শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃতদেহ।আর সেইসব মৃতদেহ ঘিরে ভিড় করছে প্রিয়জনদের আকুতি আর কান্না। কেউ লাশ ব্যাগে মুড়ে ত্রাণের প্রার্থনা করছেন, কেউ কেউ গণকবরে দাফন করছেন প্রিয়জনের দেহ। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। নিখোঁজ নিদেনপক্ষে ১০ হাজার। আর কত অগুনতি মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া, তার হিসেব মেলেনা। চিরকাল এমন দিন ছিল না। একসময়, এই লিবিয়াতেই জনগণের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব বহন করত সরকার। বর্তমানে, গণতন্ত্র শব্দটাই ভুলতে বসেছেন লিবিয়াবাসী। আজকের সংকট আরও একবার উসকে দিয়ে গেল লিবিয়ার দুর্বিসহ স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্রটা। অসংখ্য মানুষকে আজ ডেরনার প্রয়োজন ত্রাণের কাজে। অথচ, কোনও মানুষই হয়তো বাকি নেই, যিনি নিজেও সুস্থভাবে সেই কাজ চালাতে পারেন। কোনও ঘর নেই, যেখানে কারও প্রিয়জন হারায়নি। কিছু অঞ্চলের নেই কোনও চিহ্ন। সেইসব অঞ্চল কোনওদিন ডেরনায় ছিল, তার যাবতীয় চিহ্ন ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেল ড্যানিয়েল।

আরও পড়ুন: ভয়াবহ বন্যায় অস্তিত্বের সঙ্কটে তাজমহল, ৪৫ বছরে প্রথম সৌধ ছুঁল যমুনার জল

ডেরনা: শহরের ইতিহাস

লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে,বেনগাজির পূর্বে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী শহর ডেরনা। ডেরনার ইতিহাসের পরতেই মিশে আছে দাসত্বের কান্না। রয়েছে প্লেগ,কলেরা মহামারির হাহাকার। রয়েছে ব্রিটিশদের অনধিকার প্রবেশ, অত্যাচার, তবু তার পরেও হেরে না যাওয়ার এক লড়াকু অধ্যায়। সমাজের ইতিহাসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন বিপরীতে বুক চিতিয়ে বেঁচে থাকে ডেরনা। ২০১১ সালে গদ্দাফির পতনের পর থেকে ইসলামিক জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল এই শহরে। সেই ডেরনাকেই সমুদ্র এবার টেনে নিয়ে গেল।

ড্যানিয়েল এবং ডেরনা :

সবেমাত্র মরক্কোর ব্যাপক ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য তোড়জোড় ছিল উত্তর আফ্রিকাতে। কিন্তু এর মধ্যেই, ১০ সেপ্টেম্বর, রবিবার বিধ্বংসী বন্যায় ওলটপালট হয়ে গেল ফের। বহুদিন ধরে সংস্কার হয়নি রাস্তাঘাট। বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ছিল নদী বাঁধগুলিও। তারই জেরে কি ভেসে গেল লিবিয়া? প্রতিকার কি সম্ভব ছিল? প্রশ্নগুলো মনে করে আক্ষেপ করারও অবকাশ নেই আজ লিবিয়াবাসীর। তিনটি বাঁধ ভেঙে গেছে ড্যানিয়েলের প্রকোপে। গ্রিস থেকে ক্রমশ লিবিয়ার দিকে এগোতে থাকে এই ঘূর্ণিঝড়। শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতে ঘুম ভাঙা চোখ খুলে ডেরনার বাসিন্দারা দেখেন তুমুল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। কেউ পালিয়ে বাঁচেন। নিরুপায় কিছু মানুষ আশ্রয় নেন বাড়ির ছাতে। তবু শেষরক্ষা হয় না।

ডেরনাই নয়, তছনছ হয়ে গিয়েছে আল-মার্জ, তবরুক,আল-বায়দাও। বন্যায় নিহতদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশি নাগরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে, খবর বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে। নিখোঁজ আরও বহু। ত্রাণকারীদের হদিশ-অভিযান আর ক্লান্ত কান্নায় এখনও দগদগে ক্ষতর সুর। International Rescue Committee লিবিয়ার বন্যা প্রসঙ্গে বয়ান প্রকাশ করে জানিয়েছে, অন্তর্সংগ্রামে ক্ষয়ে আসা লিবিয়া, আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া এই দুর্দিন পেরোতে পারবেনা। চিকিৎসকরা বলছেন দ্রুত শুরু হয়ে যাবে জলবাহিত রোগের প্রকোপ।

আরও পড়ুন: সুতোয় ঝুলছে লাখো জীবন, ধ্বস, বৃষ্টিতে যেখানে দাঁড়িয়ে হিমাচল

জি-২০ সামিট করল ভারত। সারা বিশ্ব, আলোচনায় বসল, প্রকৃতির পক্ষে বসল সভা। আর সেই জি-২০ উপলক্ষেই আটক হল রাস্তার প্রাণীরা। জলবায়ু সংকটের চরমতম নিদর্শন চোখে আঙুল দিয়ে বিশ্বকে দেখাল আফ্রিকার ছোট এই দেশটি। ভেঙে পড়েছে অসংখ্য ব্রিজ, উপড়ে গেছে টেলিফোন নেটওয়ার্কের স্তম্ভ। সারা বিশ্ব দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছে একটা মিরাকলের।প্রার্থনা করছে অদৃশ্য জাদুবলে সেরে উঠুক লিবিয়া। ইতালি হয়ে অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে গ্রেট ব্রিটেন। তেল-সমৃদ্ধ এই দেশ ছিল উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশের সফট-টার্গেট। তবু বারবার ফিরে আসার গল্প বলে নজির গড়েছে লিবিয়া। মাটি কামড়ে থাকা কালোমানুষদের সংগ্রাম নজির গড়েছে বিশ্বজুড়ে। এবার পারবেনা? 

More Articles