মৃত্যু এবং জীবন, আপতন-সমাপতনের এক চিররহস্য

Ashmandari: আমার জন্ম হতে পারত কোনও পিঁপড়ে কিংবা পাখি কিংবা জলচর জীব হিসেবে। কোথা থেকে আসে এই প্রাণ? বিশেষত মানুষ হয়ে জন্মাবার ঘটনা?

পুরনো কাল আর পুরনো কলকাতার কত গল্প! আমার বাবার মুখে শুনেছিলাম তাঁর এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা। তখন খাদ্য আন্দোলনে কলকাতা উত্তাল। ১৯৫৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর ছাত্র-ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ব্যাপক আকার নিয়েছে। সেদিন ছাত্ররা ছিল উগ্র প্রতিরোধে আক্রমণাত্মক, পুলিশ ছিল হিংস্র। দমনের সেই আবহে বাবা একা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের বাড়ি অর্থাৎ বিডন স্ট্রিটের দিকে আসছিলেন। রাস্তায় তখন অবরোধ এবং টায়ার জ্বলছে। হঠাৎ দূর থেকে দু'টি সশস্ত্র পুলিশের গাড়ি কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে গোলদিঘির দিকে বাঁক খায়। বাবা দেখেন, ওই পুলিশেরা তাঁর গতিবিধি লক্ষ্য করছে। মুখে একটা শিকার পাওয়ার বীভৎস আনন্দ! সেদিন যে ছাত্র বা তরুণ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল তারা করুণ এবং ভয়ংকর পরিণতি পেয়েছিল। কেউ অত্যাচারে পাগল হয়ে গিয়েছিল, কেউ নিপীড়নে জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল, কেউ এমনভাবে জখম হয়েছিল যে বেশিদিন বাঁচেনি। পুলিশের গাড়ি তখন প্রায় হিন্দু স্কুলের কাছে, বাবা দাঁড়িয়ে আছেন ফুটপাথে, পাথরের মতো। হঠাৎ সম্বিত ফেরে একটি ডাক শুনে। হেয়ার স্কুলের দারোয়ান ওই সময় গেটের চাবি দিতে এসেছিলেন। তিনি বাবাকে ডেকে নেন স্কুলের ভেতরে। হয়তো বাবাকে দেখে তাঁর করুণা হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, ওই মুহূর্তটিকে তিনি কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। তখন কড়া নিয়ম ছিল, কোনও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ প্রবেশ করবে না। প্রবেশের আলাদা অনুমতি লাগবে। অপ্রত্যাশিতভাবে বাবা বেঁচে গেলেন এবং গেটের ভিতর থেকে দারোয়ানের সঙ্গে দেখলেন, পুলিশের গাড়ি গেটের সামনে থামল এবং ব্যর্থ মনোরথ আবার চলে গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। একচুল এদিক-ওদিক হলে বাবা পুলিশের হাতে ধরা পড়তেন। গভীরভাবে জখম হতেন এবং হয়তো অচিরেই ফুরিয়ে যেত আয়ু। তখন আমি কোথায় থাকতাম? কে লিখত এই গল্প? জন্ম এবং ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিক মোচড় দেখে বিহ্বল বিস্ময়ে বসে থাকি।

আপতন-সমাপতনের এই অলৌকিক ঘটনাবলি কি শুধু ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? আশ্চর্য সব ঘটনা-দুর্ঘটনা দিয়ে যে কোনও ইতিহাস তৈরি হয়ে ওঠে। নির্ধারিত হয় সাধারণ মানুষ বা জাতির ভবিষ্যৎ। হাওড়া শহরের বহু বিদগ্ধ মানুষকে দেখেছি এই বলে খেদ করতে যে, জোব চার্নক যদি কলকাতার ঘাটে না উঠে ঠিক উল্টোদিকে শিবপুরের দিকের কোনও ঘাটে উঠতেন তাহলে হাওড়াই হতো কালক্রমে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী। শুধু তাই নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে অর্থনীতি কিংবা বাণিজ্য – সবদিক থেকেই হাওড়া পেত ব্রিটিশ শক্তির পূর্ণ সমর্থন এবং সহায়তা। কলম্বাস তাঁর জাহাজ নিয়ে ভারতে যাবার তোড়জোড় করলেন এবং ভুল রুট নিলেন, সাগরে-সাগরে ভেসে নাস্তানাবুদ হয়ে পৌঁছলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভূখণ্ডে। যার নাম আমেরিকা। এ প্রসঙ্গে আমি অন্তত মনে করিয়ে দিতে চাইব যে, শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের চোখেই আজও আমরা ইতিহাস গড়ে থাকি। ওই ভূখণ্ডের পরিচয় নিয়ে সাহেবরা প্রথমে ছিল নিশ্চিত। এ তো ইন্ডিয়া! এ তো ভারত! তবে, অচিরেই সে ভুল ভাঙল। তবু সাহেবদল সে দেশের আদিবাসীদের চিহ্নিত করতে ব্যবহার করল এক অমোঘ শব্দ – ‘রেড ইন্ডিয়ান’। এ ধরনের ভুল নিশ্চয়ই হতে পারে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সারা বিশ্ব জুড়ে আজও মার্কিন দেশের উত্তর ভূখণ্ড জুড়ে আদিবাসীদের চিহ্নিত করা হয় ‘রেড ইন্ডিয়ান’ নামে। আমি বলতে চাইছি, পুরো একটা জনগোষ্ঠীর পরিচয় কীরকম ভাবে শত শত বছর জুড়ে নির্ধারিত হয়ে উঠল জনৈক শ্বেতাঙ্গ নাবিকের ভুলের ওপর নির্ভর করে। আমেরিকার উত্তর ভাগ, যার নাম তখন ইউনাইটেড স্টেটস বা ইউএস তার দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, কত নিষ্ঠুর নির্মম প্রক্রিয়ায় সেখানে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বা আদত আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এমনকী নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব। ছলে-বলে কৌশলে, নানা মারণ ব্যাধি ছড়িয়ে, গণহত্যা এবং গণমৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে সহজ-সরল-সাদাসিধে মানুষগুলির সর্বনাশ করা হয়। সারা বিশ্বজুড়ে গত দু-তিন শতকে উপনিবেশের প্রভুত্ব কায়েম করতে ইওরোপের মানুষের সেনা-অভিযানে কত লক্ষ মানুষ এবং কত বিচিত্র সংস্কৃতি যে ছটফট করতে করতে বিলুপ্ত হয়েছে তার হিসেব নেই। সে কথা আপাতত থাক।

আমি বলতে চাইছিলাম, আপতন আর সমাপতনের গল্প। এই যে কলম্বাসের ভুল দেশ এবং মানুষ চিহ্নিতকরণ, সেটিই হয়ে গেল পুরো জনগোষ্ঠীর একটা পরিচয়। মুহূর্তের ভ্রান্তি, ক্ষমতা এবং প্রতাপের নিষ্ঠুর আধিপত্যে ইতিহাস-ভূগোলকে শুধু বদলে দিল তাই নয়, অপর বা অজানা দেশ মানুষ সমাজের একটা স্থায়ী নির্মাণও পেশ করল। দুঃখ এবং ক্ষোভের কথা হলো, শ্বেতাঙ্গের ‘ভুল’-কে চাপিয়ে দেওয়া হলো পুরো একটা জনপদের ওপর। সারা পৃথিবীর শ্বেতাঙ্গ সভ্যতা অন্তর্লীন আঁতাতে সেকথা মেনেও নিল। আমরা, পোড়া বঙ্গের বাঙালিরা, কখনোই ‘নেটিভ’ আমেরিকান বা মার্কিন দেশের আদিবাসী বা ইউ.এস.এ-র মূলবাসী বলি না, উল্লেখ করার সময় সবসময়ই বলি ‘রেড ইন্ডিয়ান’। এটা ওই জনগোষ্ঠীর পক্ষে কতটা অপমানকর, সেকথা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিই।

আরও পড়ুন- প্রাচীন কলকাতায় এসেছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক!

দু-সপ্তাহ আগে ‘ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট অ্যাংলিয়া’ এবং ‘সেন্‌সবারি সেন্টার ফর ভিস্যুয়াল আর্ট’-এর ‘আর্ট হিস্টরি অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড আর্ট স্টাডিজ’ -এর সারস্বত আমন্ত্রণে ইংলন্ডে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ইংল্যান্ডের নরইচ্‌ (NORWICH/উচ্চারণ নরিচ্‌) শহরের উপকণ্ঠে। লন্ডন থেকে ট্রেনে লাগে এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট। নরিচ বিমানবন্দরে আমাকে নিতে এসেছিলেন অধ্যাপক ড্যানিয়েল রাইব্রফট্‌। যে গাড়িতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলাম, তার চালকের নাম ফিলিপ। নরিচ্‌ শহরে আমি প্রথম এসেছি শুনে সে ড্যানিয়েলকে বলল, ‘এই নতুন অতিথিকে বলেছ নরিচের ইতিহাস? "সপ্তদশ শতকে যখন প্লেগ মহামারী লন্ডনকে কুপোকাত করে দিয়েছিল, তখন প্রায় রাজধানী হয়ে উঠেছিল আমাদের নরিচ্‌। মহামারী শেষে সবাই ফিরে গেল লন্ডনে কিন্তু নরিচের গুরুত্ব এবং মহিমা কমল না। আপনি মশাই এখানে ঘুরে ঘুরে এই শহরের ইতিহাসগুলো দেখবেন মন দিয়ে!" আমি চমকে উঠি। এ তো আরেক সমাপতনের দৃষ্টান্ত। মহামারীর প্রকোপে জনপদের ভাগ্য নির্ধারিত হলো। মনে পড়ে গেল আমার মায়ের কথা।

পার্টিশনের ফলে যে শত সহস্র শরণার্থী বা রিফিউজি ওপার বাংলা থেকে এপারে চলে এসেছিলেন, আমার মা এবং মামার বাড়ি তাদেরই একজন। মা ছিলেন বরিশালের গৈলা গ্রাম আর পটুয়াখালির মানুষ। একটু ভাবলে বোঝা যায়, এক অর্থে এই দেশভাগও একধরনের সমাপতন বা আপতন। দুর্ঘটনা। শান্ত, নিশ্চিন্ত কোনও জনপদ যখন হঠাৎ কোনও উপরমহলের সিদ্ধান্তে উদ্বাস্তু বা রিফিউজিতে পরিণত হয়, তখন ইতিহাসকে নিষ্ঠুর দানব মনে হয়। আমার মা এবং তাঁর পুরো পরিবার পিছনে ফেলে এসেছিলেন বাড়িঘর, স্বচ্ছলতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জিনিসপত্র এবং স্মৃতি।

এ যে কী কঠিন এক অভিজ্ঞতা! তছনছ হয়ে যাওয়া অজস্র পরিবারের মতো তাঁরাও এ শহরে দারিদ্র্য এবং কঠিন বাস্তবের মোকাবিলা করতে করতে বড় হয়েছেন। আমার মামা এবং মাসিরা নানা সমস্যার মধ্যে মেধার জোরে উচ্চশিক্ষার পথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আমার মায়ের নাম আজও লেখা আছে বেথুন কলেজের দেওয়াল জুড়ে। ১৯৫৮ সালের অর্থনীতি বিভাগের কৃতি ছাত্রী হিসেবে। স্নাতকস্তরে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন মা। অধ্যাপক সুমন্ত মুখোপাধ্যায় সেই প্রাচীর বিজ্ঞপ্তিটির ছবি তুলে পাঠিয়েছিলেন। মূল প্রসঙ্গে আবার ফিরে যাই। যখন ঘোষণা হয়েছিল দেশভাগের, মায়ের কাছে শুনেছি, ওদেশের বহু মানুষই কথাটা বিশ্বাস করতে পারেননি। আজকাল তো আমার মনে হয়, বিশ্বাস করতে চাননি। তারপর যখন চাপ বাড়তে শুরু করল, এক এক করে অনেকেই পাড়ি জমাতে শুরু করলেন এপার বাংলা তথা কলকাতার দিকে, তখন যেন আশঙ্কার মেঘ বেশ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। অনেকের চোখেই তখন ঘনাতে শুরু করেছে দুর্মর ভীতি। বেশ কিছু পরিবার এবং তাদের সদস্যরা ক্রমশ সন্ত্রস্ত এবং বিহ্বল। তারপর বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চেপে গভীর রাতে আধো ঘুমন্ত চোখে মা ঢুকেছিলেন এই কলকাতা শহরে। যদি ধরা যাক, দেশভাগ না হতো, উদ্বাস্তুদের চলে আসতে না হতো, যদি সর্বস্ব হারানো মানুষের মিছিলে মাকে এবং আমার মামার বাড়ির মানুষদের এসে যোগ দিতে না হতো, তাহলে কেমন হতো ওপার বাংলায় আমার মায়ের জীবন?

আরও পড়ুন- জীবনানন্দ তৃতীয় নয়নে দেখেন বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা

এক অর্থে ভাবলে কিন্তু মানবজীবনের উৎসে রয়েছে আপতিক এক রহস্যমুহূর্ত। নিজের কথা দিয়েই শুরু করি। এই যে জন্ম হয়েছে আমার কলকাতার কাশী ঘোষ লেনে এক শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত মোটামুটি উচ্চবর্গ, ঐতিহ্যশালী পরিবারে সেটা তো একটা আপতিক ঘটনা! কেননা, এ ব্যাপারে আমার কাছে কেউ কোনওদিন কোনও আবেদনপত্র চায়নি বা নেয়নি। অন্যদিকে, একথাও একইসঙ্গে সত্যি যে, একেবারেই ভিন্ন কোনও পরিবারে, কলকাতা থেকে অনেক দূরে কোনও গ্রাম বা অখ্যাত মফসসলের প্রান্তিক পরিবারে আমার জন্ম হতে পারত। যদি অনিশ্চয়তার মাত্রা আরও তিন-চার গুণ বাড়িয়ে দিই, তাহলে এ কথাও বলা চলে যে, আমার জন্ম হতে পারত কোনও পিঁপড়ে কিংবা পাখি কিংবা জলচর জীব হিসেবে। কোথা থেকে আসে এই প্রাণ? বিশেষত মানুষ হয়ে জন্মাবার ঘটনা? এর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আলোড়িত করে আরও সব গভীর ভাবনা। আমার এই সচেতন মানব মন হঠাৎই একদিন আমার অনুমোদন বা পূর্ব নির্ধারিত ইঙ্গিত ছাড়াই ফুস্‌ করে উড়ে যাবে। মৃত্যু এবং জীবন, এই দুই কি প্রবলভাবে আপতিক নয়? আমি যেমন ভাবি, এই জন্মে নারী হয়েও জন্মাতে পারতাম, হতে পারতাম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। ‘এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা...’

মানবজন্ম যেমন এমন এক অনিয়ন্ত্রিত আচমকা ঘটনা, তেমনই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তও অজানা নানা অঘটনে প্রবাহিত। আমার বিদ্যালয়, বন্ধুরা যেমন সেই আপতনের অংশ, একইভাবে ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন, চাকরি, বিবাহ, সন্তান, দৈহিক গড়ন, মনের গড়ন এমনকী গায়ের রঙ – সবই তো অ্যাক্সিডেন্টাল বা কো-ইনসিডেন্টাল। যাকে বলে কাকতালীয় ঘটনা। মানব জন্মের ঘরে পৌঁছে সবাই হঠাৎ আবিষ্কার করি নিজেকে। অবাক বিস্ময়ে প্রত্যেকটি মানুষ নিজের সঙ্গে নিজের পরিচয় ঘটায়। তার ব্যক্তিত্ব মনের ভেতর থেকে শরীরের বাইরেটাকে বুঝতে চেষ্টা করে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, কোনও বয়ঃসন্ধি বা তার তলার বয়সে মানব কৈশোর বারংবার দর্পণ বা আরশির প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে নিজের দিকে। নিজের নানা মুখভঙ্গি এবং শরীরের নানা অংশ আয়নায় দেখতে চায়। কখনও কখনও উলঙ্গ হয়েও।

এই আত্মআবিষ্কার এবং আত্মখননের সঙ্গে মিশে যায় এক প্রবল প্রেম এবং অনিশ্চয়তা। প্রত্যেক মানুষের নিজের শরীরের প্রতি কমবেশি অসীম ভালোবাসা এবং আগ্রহ থাকে। সেই শরীর কালের নিয়মে একদিন নিষ্প্রাণ হবে, এই চিন্তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংবেদনশীল মানবমনকে আলোড়িত করে। জার্মান কবি রাইনের মারিয়া রিলকে একটি কবিতায় লিখেছিলেন অনিত্য জীবন নিয়ে – ‘দাঁড়ের দুই ধারালো সারির মাঝখানে জিভের মতো’। সত্যিই জীবন আর মৃত্যু নামক দুই শাণিত বাস্তবতার মাঝখানে আমাদের মানবজীবন। কেউ জানে না, কেউ জানি না, কীভাবে শুরু, আর একদম নিশ্চিতভাবে বলা চলে – জানি না, কোথায় কীভাবে কখন শেষ?

সময়ের কথাটাও এ প্রসঙ্গে মনে হয়। যদি ধরা যাক, জন্ম হতো শশাঙ্ক বা চর্যাপদের আমলে, নিদেন উনিশ শতকে? কখনও কখনও মনে হয় আরও পঞ্চাশ বছর পরবর্তী কোনও বছরে যদি জন্ম হতো? যদি জন্ম নাই হতো আদৌ? তাহলে কোথায় থাকতাম আমি বা যাকে বলে ‘আমি’ নির্দিষ্ট এক সত্তাচেতনা? এসব ভাবি আর তীব্র উদ্বেগে পুড়ে যেতে থাকি। হঠাৎই চোখে পড়ল নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় বহু মানুষের নিহত হওয়ার খবর। এ তো আর এক ধরনের আপতন সমাপতনের অভিঘাত। সুস্থ-সমর্থ কিছু মানুষ বিমানে উঠলেন এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন। দুর্ঘটনা বলেই আমরা বেদনার্ত হই। এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে অপার রহস্য। এক্ষেত্রে কোনও রাষ্ট্র বা ক্ষমতার ঈপ্সা বা উদ্দেশ্য পূরণের গুহ্য প্রভাবও নেই। নিছক দুর্ঘটনা।

রাষ্ট্রের ভাগ্য কীভাবে ব্যক্তির ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করে একেবারে আপতিক পরম্পরায়, তার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত সের্গেই ব্রিকালেভ। এই নভশ্চরের কাহিনি চমকপ্রদ। ইনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশচারী হিসেবে স্পেস বা মহাকাশে যান ১৯৯১ সালের মে মাসে। মহাকাশে তাঁর থাকার কথা ছিল পাঁচ মাস। মহাশূন্যে যখন মহাকাশযান মির তার কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে, তখন সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়। তৈরি হয় রাশিয়া। তাঁর কথা ভুলেই গেল সবাই। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ডামাডোলে একা সের্গেই তখন পৃথিবীতে ফিরতে মরিয়া। আশ্চর্য সমাপতন!

More Articles