পেলের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত সেই গোল! বড়ে মিঞার পায়ের জাদু অমলিন আজও

Mohammed Habib: হাবিব ছিলেন একেবারে খেলা পাগল মানুষ। সাতের দশকে যখন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল-সহ প্রত্যেকটি দলের আর্থিক অবস্থা একেবারে শোচনীয়, সেই সময়ও টাকার পরোয়া না করে তিনি নিজের একশো শতাংশ ঢেলেছেন তার দলের জন্য।ছিলেন...

ভারতীয় ফুটবলের বড়ে মিঞা তিনি। একার দক্ষতায় জিতিয়েছেন বহু ম্যাচ। জাতীয় দলের জার্সিতেও রয়েছে সাফল্য। পেলের বিরুদ্ধে ম্যাচে করেছিলেন গোলও। বহু সম্মান, পদক রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। কিন্তু, সেই মানুষটিই আজ হেরে গেলেন জীবনের ম্যাচে। দেশের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে  অভিভাবকহীন হল ময়দান। ৭৪ বছর বয়সে পারকিনসনের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গেলেন তিন প্রধানে খেলা কিংবদন্তি ফুটবলার মহম্মদ হাবিব। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ হায়দ্রাবাদের নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…

শ্যাম থাপা হোক বা সুভাষ ভৌমিক, সবার কাছেই তিনি বড়ে মিঞা। গোলের খরা কাটাতে বড় ম্যাচে তার কাছেই আশা রাখতেন তামাম ফরওয়ার্ডরা। ড্রেসিংরুমের সকলেই সবার আগে খুঁজত বড়ে মিঞাকে। বড় ম্যাচে তিনি পালন করতেন একেবারে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা। সবাই জানতেন, তিনি যদি একটা পাস বাড়িয়ে দেন, তাহলেই ডার্বির নায়ক হয়ে উঠবেন সুভাষ কিংবা শ্যাম। তিনি শুধু গেম মেকার নন, বলতে গেলে তিনি ছিলেন কলকাতা ময়দানের স্টার মেকার। সাতের দশকে যখনই যে টিমের জার্সি পরেছেন, সেই টিম সাফল্য পেয়েছেই। প্রদীপ ব্যানার্জি, অরুণ ঘোষ, অমল দত্ত সবার সাফল্যের চাবিকাঠিই সেই মহম্মদ হাবিব। তিনি ছিলেন সবুজ মাঠের রাজা। এমন অনেক কঠিন ম্যাচে যেখানে বিপক্ষের দুর্গ একেবারে দুর্ভেদ্য, সেখানেও তিনি যেন আক্রমণের বন্যা নামিয়ে আনতেন। চোট পরোয়া না করেও বিপক্ষকে হারাতেন পায়ের জাদুতে। তাই দল বদলে সেই সময়ে তিনি ছিলেন অন্যতম লক্ষ্য।

হাবিব ছিলেন একেবারে খেলা পাগল মানুষ। সাতের দশকে যখন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল-সহ প্রত্যেকটি দলের আর্থিক অবস্থা একেবারে শোচনীয়, সেই সময়ও টাকার পরোয়া না করে তিনি নিজের একশো শতাংশ ঢেলেছেন তার দলের জন্য। তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার পুরো খেলোয়াড় জীবনে আক্ষরিক অর্থে তিনি ছিলেন একজন পেশাদার মানুষ। তবে হাবিবের জীবনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ ছিল মোহনবাগানের হয়ে সফরকারী কসমস ক্লাবের বিরুদ্ধে করা সেই অনবদ্য গোলটা।

১৯৭৭ সালে বৃষ্টি ভেজা ইডেন গার্ডেনে প্রীতি ম্যাচে সেইদিন মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছেন পেলে। মিডিয়া থেকে শুরু করে দর্শক সকলের আকর্ষণ তখন সেই পেলের দিকে। এছাড়াও বিপক্ষ দলে রয়েছেন কার্লোস আলবার্তো, জর্জিও চিনাগলিয়ার মত তাবড় তাবড় ফুটবলার। সকলে ধরেই নিয়েছেন মোহনবাগান এই খেলায় গোলের মালা পরতে চলেছে। কিন্তু মোহনবাগানের পরিকল্পনা ছিল আলাদা। একপ্রকার অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও, হেরে মাঠ ছাড়বেন না মোহনবাগানের তারকারা।

আর সেই মোহনবাগানের একাদশকে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব নিলেন মহম্মদ হাবিব। তারকা-খচিত দলের বিরুদ্ধে ২-২ ব্যবধানে খেলা শেষ করল মোহনবাগান। ভারতের একটা সাধারণ ক্লাবের ফুটবলারদের দক্ষতাদেখে সেদিন চমকে গিয়েছিলেন পেলেও। আর এই গোলদাতাদের তালিকায় ছিলেন হাবিব সাহেবও। ম্যাচ শেষে হাবিবের ভূয়সী প্রশংসা করেন পেলে নিজেও।

১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই তার জন্ম হাবিবের।  দেশের হয়ে ৩৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ভারতের এই প্রাক্তন অধিনায়ক। হাঁকিয়েছেন ১১টি গোল। একটা দীর্ঘ সময় ধরে হলদিয়ায় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার প্রধান কোচ হিসেবেও কাজ করেন হাবিব। ফুটবল মাঠে ৩-৪ জন খেলোয়াড়কে ফাঁকি দিয়ে গোল করার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বড়ে মিঞার। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হওয়ার কারণে খেলাকে পরিচালনার দায়িত্ব থাকতো তার কাঁধেই। হয়তো গোলদাতার তালিকায় তাঁকে খুব একটা বেশি দেখা যেত না, কিন্তু মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করাও কিন্তু সব ফুটবলারের কম্ম নয়! কখনও কখনও নিজে এগিয়ে গিয়েও আক্রমণ হেনেছেন বিপক্ষের তিন কাঠির উপর। কিন্তু অধিকাংশ সময় তাঁকে দেখা যেত ফরোয়ার্ড-দের ব্যস্ত রাখতে। পাশাপাশি তাঁর গতি এবং ড্রিবলিং দক্ষতা ছিল চমৎকার।

১৯৬৭ সালে কুয়ালালামপুরে মেরিডেকা কাপে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে দেশের হয়ে অভিষেক ম্যাচটি খেলেছিলেন হাবিব। প্রথম ম্যাচেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষমতা। ১৯৭০ সালে এশিয়ান গেমসেও ভারতীয় ফুটবল দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ছিলেন তিনি। জাপানকে ১-০ গোলে হারিয়ে সেই বছর ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল ভারত। এরপরে আর কখনওই ভারতীয় ফুটবল দলকে এশিয়ান গেমসে পদক পেতে দেখা যায়নি।

তবে, ঘরোয়া লিগে ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতেই সব থেকে বেশি সাফল্য পেয়েছেন মহম্মদ হাবিব। যদিও জীবনের শেষ দিকে তিনি মোহনবাগানের হয়ে খেলেছিলেন। ১৯৬৬ সালে হায়দ্রাবাদ ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে সন্তোষ ট্রফি ফাইনালে বাংলার হয়ে ৫ গোল করেন তিনি। সেই ম্যাচে সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে ৬-১ গোলে জয় পায় বাংলা, যা এখনও পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে একটা রেকর্ড।

১৯৭১ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাথে পেস্তা সুকান কাপের যুগ্ম বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল হাবিবের অবদান। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে তিনি খেলেন সাতটি সিজন। তিনবার ডুরান্ড কাপ ফাইনালেও ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গোল করেন তিনি। ১৯৭২ সালে একই সঙ্গে আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড কাপ এবং রোভারস কাপ এই তিনটি ট্রফি জিতে ইস্টবেঙ্গলকে কলকাতা সেরা করেছিলেন হাবিব। ১৯৭৭ সালে এই একই জয় তিনি দ্বিতীয়বার হাসিল করেন, তবে এবার মোহনবাগানের জার্সিতে।

ক্যালকাটা ফুটবল লিগ, সন্তোষ ট্রফি এবং ডুরান্ড কাপ, সব লিগেই তার ছিল অবাধ বিচরণ। পড়াশোনার দিক থেকেও ছিলেন তুখোড়। তবে ছোটবেলা থেকেই ফুটবল যেন তাঁকে টানতো। তাই একাধিক চাকরির প্রস্তাব হেলায় ছেড়েছেন।  গোটা জীবনটাই যেন তাঁর ফুটবলের জন্য সমর্পণ। ফুটবলই তাঁর ধ্যান, তাঁর জ্ঞান। ১৯৮২ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ফুটবলের কোচিং শুরু করেন। ভারতের বহু নামজাদা ফুটবল তারকাই তৈরি হয়েছে হাবিবের ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে। টাটা ফুটবল একাডেমিতেও তিনি একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কোচ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মোহনবাগান এবং মহামেডান স্পোর্টিং দলের কোচ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। আইএফএর হলদিয়া অ্যাকাডেমির প্রধান কোচ হিসেবেও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাজ করেছেন তিনি। চেষ্টা করেছেন নিজের ফুটবল শিক্ষা পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে।

আরও পড়ুন: ৬ গোল হজমের শাস্তি! ভক্তদের পাথরবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফুটবলাররা…

১৯৮০ সালে হাবিব পান অর্জুন পুরস্কার। ২০১৮ সালে রাজ্য সরকার তাকে সম্মানিত করেছিল বঙ্গবিভূষণ দিয়ে। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দিয়েছে মহামেডান স্পোর্টিং। ইস্টবেঙ্গল দিয়েছে ভারত গৌরব পুরস্কার। কিন্তু, শুধুমাত্র পুরস্কারের নিরিখে এই অকুতোভয় খেলোয়াড়টিকে বিশ্লেষণ করা যাবে না। হাবিবের ফুটবলের মন্ত্রই ছিল লড়াই। সবাইকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন তিনি। খেলতে খেলতে জুনিয়র সতীর্থদের শেখাতেন কীভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে হয়। ছোটদের কাছে বাড়িয়ে দিতেন পাস। জুনিয়রদের সঙ্গে ছিল অম্ল-মধুর সম্পর্ক। তবে শৃঙ্খলার সঙ্গে কখনও সমঝোতা করেননি।  আজীবন বিশ্বাস রেখেছেন অনুশীলনে। হাবিব বিশ্বাস করতেন, বাংলার ছেলেরা ভালো ফুটবল খেলবেই। তাই হয়তো যখন যে টিমের হয়েই খেলতেন, তার হয়ে একেবারে জান লড়িয়ে দিতেন তিনি। হায়দ্রাবাদে জন্মালেও কলকাতার সঙ্গেই ছিল তাঁর নাড়ির টান। এমনকী, ২০১৯ সালে ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের অনুষ্ঠানেও তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। চলে গেলেন কলকাতা ফুটবলের স্বর্ণযুগের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র।  হায়দ্রাবাদে কেউ তাঁকে চিনুক না না-চিনুক, কলকাতায় তিনি ময়দানের সিংহ। বড়ে মিঞার সঙ্গেই শেষ হল ফুটবলের সেই আলোকিত অধ্যায়। 

More Articles