ঘুঁটের আগুন থেকে এলইডি ল্যাম্প, জগদ্ধাত্রী পুজো পাল্টে দিল চন্দননগরের চালচিত্র
Jagaddhatri Puja: চন্দননগরকে আলোর শহর করে তোলার পিছনে রয়েছে জগদ্ধাত্রী পুজোর একটা বড় ভূমিকা।
কেবল প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ হিসেবেই নয়, আলোর শহর হিসেবেও বিশ্বজোড়া সুখ্যাতি রয়েছে হুগলি জেলার এই ছোট্ট শহর চন্দননগরের। আলোর নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে এই শহর। প্রথাগত ডিগ্রি ছাড়াই কারিগররা যেভাবে কল্পনা, সৃজন এবং প্রযুক্তির সাহায্যে জাদু দেখান, তা অবাক করে সকলকে। জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে সারা চন্দননগর যেন সেজে ওঠে আলোর মেলায়। কলকাতা থেকে শুরু করে সমস্ত বড় নামজাদা পুজোমণ্ডপের বাইরে যত আলো দেখেছেন, সবই প্রায় চন্দননগর থেকেই গিয়েছে। তবে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে চন্দননগরের আলো থাকলেও জগদ্ধাত্রী পুজোতে সবই ফিরে আসে আবারও, নিজেদের সেই পুরনো ঘরে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত সেজে ওঠে আলোতে। চন্দননগর তৈরি হয় মায়াবী আলোর রোশনাইতে।
কিন্তু, এই চন্দননগরকে আলোর শহর করে তোলার পিছনেও রয়েছে জগদ্ধাত্রী পুজোর একটা বড় ভূমিকা। অন্তরা মুখার্জি কর্তৃক সংকলিত 'Chandernagore mon amour: The Citadel of the Moon' নামের বইটিতে প্রকাশিত কিছু লেখা থেকে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা এবং তার সঙ্গে জড়িত আলোর ব্যবসা কিছু ইতিহাসের ব্যাপারে জানা যায়। তবে চন্দননগরের আলোর সেই ফেলে আসা ইতিহাস জানতে হলে অবশ্যই সবার আগে জানতে হবে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো ও শোভাযাত্রার ইতিহাসটা।
জগদ্ধাত্রী পুজো ও শোভাযাত্রার ইতিকথা
ভাগীরথী নদীর পশ্চিমে গঙ্গার একেবারে ধার ঘেঁষে হুগলি জেলায় অবস্থিত এই শহর চন্দননগর। মনে করা হয়, গঙ্গার চাঁদের মতো বাঁকের থেকেই প্রথমে এই শহরের নাম দেওয়া হয়েছিল চাঁদের নগর। পরবর্তীতে এই শহরের নাম পাল্টে রাখা হয় চন্দননগর। এই শহরের ইতিহাস বহু প্রাচীনকাল থেকেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বিদেশি বহু শক্তি এই শহরে তাদের শাসনকালে আধিপত্য চালিয়েছে। তবে শেষপর্যন্ত, দীর্ঘ কয়েক দশক অবধি এই শহর ছিল ফরাসিদের অধীনে। তবে তখনও নিজের জৌলুস কখনওই হারায়নি চন্দননগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো।
আরও পড়ুন: ফরাসি মদ থেকে চোলাই বা ঝলমলে নিষিদ্ধপল্লি! চন্দননগরের অজানা রঙিন ইতিহাস
চন্দননগর শহরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন এর বা প্রবক্তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও, চতুর্দশ শতকে মহামহোপাধ্যায় শূলপাণি-লিখিত, 'ব্রতকালবিবেক' গ্রন্থে, পঞ্চদশ শতকে বৃহস্পতি রায় মুকুট লিখিত 'স্মৃতিরত্ন হার' গ্রন্থে এবং ষোড়শ শতকে শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণি কর্তৃক রচিত 'কৃত্যন্তত্ত্বার্ণব' গ্রন্থে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পুজো তিথি এবং প্রচলনের কিছু পুঁথি-প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সকল তথ্য পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় কালে বাংলার বুকে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ছিল। এছাড়াও অন্তরা মুখোপাধ্যায় সংকলিত 'Chandernagore mon amour: The Citadel of the Moon' নামক বইটিতে প্রকাশিত পূর্বা চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'জগদ্ধাত্রী পূজা: ঔপনিবেশিক পুরাণকথা' নামক প্রবন্ধটি থেকে জানা যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চম উত্তরপুরুষ মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের সময়কার কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেওয়ান তথা বিখ্যাত কবি এবং নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় মহাশয় নিজের 'ক্ষিতিশ বংশাবলী চরিত' গ্রন্থে লিখেছিলেন, 'রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় জগদ্ধাত্রী ও অন্নপূর্ণা পূজো প্রচলন করেন।'
তবে, পূর্বের তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ঘটানো হয়েছিল ১৭৬২ সালে। অন্যদিকে, কৃষ্ণনগরে প্রচলিত জগদ্ধাত্রী পুজো চন্দননগরেও এই একই বছর ১৭৬২ সালে শুরু হয়। ডক্টর বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত, 'জগদ্ধাত্রী পূজা ও চন্দননগর প্রসঙ্গ' বইটি থেকে জানা যায়, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক দেওয়ান দাতারাম সুর চন্দননগরের অন্তর্গত গৌড়হাটি অঞ্চলে তাঁর বিধবা কন্যার বাড়িতে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন ১৭৬২ সালে। ঠিক সেই বছরই, যে-বছর কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে শুরু হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজো। এটি ছিল চন্দননগরের প্রথম পারিবারিক জগদ্ধাত্রী পুজো।
অন্যদিকে আবার চন্দননগরের চাউলপট্টি অঞ্চলে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী জানতে পারা যায়, এই এলাকায় প্রচলিত 'আদি মা' ছিলেন জগদ্ধাত্রী। অর্থাৎ, সেই দিক থেকে বিচার করলে কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলন এর অনেক আগেই চন্দননগরের শুরু হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজো। চন্দননগর শহরের এক ইতিহাস-অনুসন্ধানী অভিজিৎ সিংহরায়ের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেমস দার্মেস্তেতের নামের এক ফরাসি লেখক তাঁর বইতে ১৮ শতকের আটের দশকে উল্লেখ করেছিলেন, এই শহরে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তৈরি করতে মোট ১১ টাকা এবং এই বিশালাকার মূর্তিকে অলংকার দিয়ে সুসজ্জিত করতে মোট ১১০ টাকা খরচ হতো। আজকের দিনে এই খরচ প্রায় লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
শহরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, এই শহরের আলোর ইতিহাসের সঙ্গে যে বিষয়টি সবথেকে বেশি জড়িয়ে, তা হলো জগদ্ধাত্রী পুজোর বিখ্যাত শোভাযাত্রা। অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, চন্দননগর শহরে মোটামুটি জগদ্ধাত্রী পুজোর নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৮ শতকের মধ্যভাগে। ১৮৫৪ সালে রেলপথ চালু হওয়ার পর এই শহরের জগদ্ধাত্রী পুজো এবং প্রতিমা নিরঞ্জন দেখার জন্য সেই সময় বাইরে থেকে বহু মানুষ আসতেন। ফলত, এই শহরের জগদ্ধাত্রী পুজো সমৃদ্ধি এবং জৌলুস দুটোই একই সঙ্গে বাড়ে। জনসমাগম বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে ওই চার দিনের জন্য গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন ছোটখাটো স্টল। অর্থনৈতিকভাবে শহরের পুজোকমিটিগুলি কিছুটা হলেও লাভবান হতে থাকে। আর সেই প্রভাব ধীরে ধীরে প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রাতে প্রতিফলিত হতে শুরু করে।
কিন্তু, সেই সময়ে সারা শহরে পুজোর সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত আর তার মধ্যে আরও সীমিত-সংখ্যক পুজো কমিটি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করত। তাই সেই সময় নিরঞ্জনের শোভাযাত্রাতে বেশি সময় লাগত না এবং বিশেষ সমস্যাও হতো না। তবে সমস্যা শুরু হলো তখন থেকে, যখন চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বারোয়ারি পুজোর আকার ধারণ করল। তখন যেহেতু পুজোর সংখ্যা বাড়তে শুরু করল, স্বভাবতই শোভাযাত্রা এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়ও একই সঙ্গে বাড়তে শুরু করল। তাই দিনের বেলার পাশাপাশি রাতের বেলাতেও শুরু হলো প্রতিমা নিরঞ্জন এবং শোভাযাত্রার কাজ। তবে রাতের এই শোভাযাত্রা শুরু হতেই সমস্যায় পড়ল পুজো কমিটিগুলি। রাত্রিবেলা আলোর অভাবে দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করল নিরঞ্জনের সময়। আর তখনই দরকার পড়ল অতিরিক্ত আলোর।
চন্দননগরের আলোর ইতিহাস
শোভাযাত্রার প্রাথমিক পর্বে রাতের এই শোভাযাত্রায় আলোর অভাব পূরণ করার জন্য পিতলের গামলায় ঘুঁটের আগুন জ্বালিয়ে সেগুলি মাথায় বা হাতে করে প্রতিমার সামনে সামনে সারিবদ্ধভাবে রাখা হতো। কিন্তু, ঘুঁটের আগুন বেশি জোরালো হতো না, সঙ্গেই, এই আলো বেশিক্ষণ টিকেও থাকত না। দিন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের মাথায় কাপড় লাগিয়ে কেরোসিনে ভিজিয়ে মশালের মতো করে জ্বালিয়ে তৈরি করা হতো শোভাযাত্রার আলো। এই মশাল মূলত তৎকালীন জমিদারদের পাইকদের হাতে ও কাঁধে থাকত। তবে এই ধরনের মশাল রাতের আলোর অভাব ঘোচাতে পারেনি কখনোই।
মশালের আলোর পরে শোভাযাত্রায় আলোর অভাব পূরণ করতে নিয়ে আসা হলো পেট্রোম্যাক্সের আলো। তারপর পরবর্তী সময়ে অ্যাসিটিলিন গ্যাস এবং ডে লাইটের আলোর ব্যবহার শুরু হলো। তবে এই শোভাযাত্রায় এই দুই ধরনের আলোর ব্যবহার খুব একটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অ্যাসিটিলিন এবং ডেলাইট আলোর পরিবর্তে শোভাযাত্রার আলোকসজ্জায় প্রচলন হল হ্যাজাকের। এই হ্যাজাক-বাহকরা শুধুমাত্র এই অনুষ্ঠানের জন্য উড়িষ্যা থেকে আসত কিছু অতিরিক্ত পয়সা উপার্জনের জন্য। প্রাথমিকভাবে প্রত্যেকে একটি করে এবং তার পরবর্তী ক্ষেত্রে বাঁশের খাঁচা তৈরি করে তাতে হ্যাজাক আলো বেঁধে সেই খাঁচাগুলি কাঁধে নিয়ে সারারাত মাতৃপ্রতিমার পাশে পাশে চলতেন বাহকরা। এই আলো নিয়ে সারারাত শহর প্রদক্ষিণ করত এই হ্যাজাক-বাহকরা।
সেই যুগে শোভাযাত্রায় বর্ণনা দিতে গিয়ে সুধীরকুমার মিত্র লিখেছিলেন, "সন্ধ্যার পর গ্যাসের আলোয় সজ্জিত হইয়া প্রতিমাগুলি স্ট্র্যান্ড রোডের বারদোয়ারি তলায় সমবেত হইত এবং বাহকেরা নিজে নিজে প্রতিমাগুলি ঘুরাইতো এবং নাচাইতো।" তবে, তখনও কিন্তু বিদ্যুতের প্রচলন হয়নি চন্দননগরে। ১৯৩৪ সালে চন্দননগর শহরে প্রথম বিদ্যুৎ আসে। আর ১৯৩৯ সালে শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর মণ্ডপে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার। ১৯৪৮ সালে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক টিউবের আলো। এই টিউব ছিল হল্যান্ড ফিলিপসের টিউব, যা সেই সময় ছিল যথেষ্ট মূল্যবান। বাঁশের খাঁচা তৈরি করে সেই টিউব স্থাপন করে চলত শোভাযাত্রা।
এরপর এই শোভাযাত্রাকে আলোকিত করতে আবির্ভাব হয় ২০০ ওয়াটের ল্যাম্পের। সেই সাদা ল্যাম্পের ওপরে জড়ানো থাকত রঙিন কাগজ, যার আলোয় আলোকিত হয়ে প্রতিমাগুলি হয়ে উঠতে অপরূপা। তৎকালীন সময়ে টিউব এবং ল্যাম্পের বৈদ্যুতিক সংযোগ ঘটাত শহরের আলোকশিল্পীরা। এই আলোক শিল্পীদের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য হলেন প্রভাস কুণ্ডু, দেবেন সরকার, বাবু পাল এবং শ্রীধর দাস।
এর কয়েক দশক কেটে যাওয়ার পর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে শুরু হয় ৬.২ টুনি বাল্বের কাজ। এই ধরনের টুনি বাল্ব প্রথম নিজেদের শোভাযাত্রায় ব্যবহার করে চন্দননগরের চারমন্দিরতলা জগদ্ধাত্রী পুজোকমিটি।
তখন ট্রলিতে বা লরিতে বাঁশের খাঁচা তৈরি করে টুনি বাল্ব দিয়ে পুরো খাঁচা সাজানো হতো। এছাড়াও নির্দিষ্ট স্ট্রাকচারে টুনি বাল্ব সারিবদ্ধভাবে লাগিয়ে শোভাযাত্রায় প্রতিমার সামনে রাখা হতো। এই টুনির আলো ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং উজ্জ্বল। এই আলোর কারসাজি দেখতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করেন দর্শকরা। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যায় চন্দননগরের আলোকসজ্জা। আর টুনি বাল্বের তৈরি সেই আলোকসজ্জার ওপর ভর করেই শুরু হয় চন্দননগরের আলোর ব্যবসা।
ধীরে ধীরে এই ব্যবসায় আসতে শুরু করেন প্রাথমিক কারিগরদের পরিবারের অনেকেই। ব্যবসা বাড়তে শুরু করে। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে পৌঁছে যায় চন্দননগরের আলো। লাভ হতে থাকে দেদার। ফলে এই ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বহু মানুষ যোগদান করেন চন্দননগরের এই আলোর ব্যবসায়। বাঁশের খাঁচা পরিবর্তিত হয়ে তৈরি হয় ইলেকট্রিক বোর্ড। তার উপরেই টুনি বাল্ব বসিয়ে তৈরি হয় রঙিন আলোর বিভিন্ন কারু কাজ। কিন্তু, এই টুনিবাল্ব জ্বলার সময় খুব বেশি উত্তপ্ত হতো এবং তাপ বিকিরণ করত। ফলস্বরূপ, এই বাল্বের বেশি কাছে যাওয়া যেত না। এটাও পরবর্তীতে একটা সমস্যার বিষয় হয়ে ওঠে চন্দননগরের আলোক-শিল্পীদের কাছে।
২০০৩ সালে এই সমস্যারও সমাধান করে ফেলেন শিল্পীরা। নিয়ে আসেন আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এলইডি ল্যাম্প। ব্যাটারি চালিত এলইডি আলো দিয়ে তৈরি হয় ইলেকট্রিক বোর্ড। পুনরায় সেই চারমন্দিরতলা জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি কর্তৃক জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত হয় সেই বৈদ্যুতিক আলো। সেই থেকে আজ অবধি একইরকম জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে চন্দননগরের আলোকসজ্জা। আলোকসজ্জার এই মিনিয়েচার কলাকৌশল চন্দননগরের নিজস্ব সম্পদ। বহু সমস্যার সম্মুখীন হলেও, সেই সম্পদকে কখনও হারিয়ে যেতে দেননি চন্দননগরের শিল্পীরা। তাই তো আজকেও দেশ-বিদেশে উল্লেখযোগ্য উৎসব অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে চন্দননগরের আলোকশিল্পীদের। ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটে আধুনিকতার।
আলোর ইতিহাস ও আলোর জনক
দেশ-বিদেশে চন্দননগরের আলোর যে এত জনপ্রিয়তা, তার পিছনে একজন মানুষের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন চন্দননগরের আলোর জনক শ্রীধর দাস। এই শিল্পী হাতে তৈরি আলো দেশজুড়ে শুধু নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। হাওড়া ব্রিজের আলো থেকে শুরু করে আইফেলটাওয়ার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর হাতে তৈরি আলো। মস্কো, ব্রিটেন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি-সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে চন্দননগরের শ্রীধর দাসের হাতের শিল্প।
এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আলোকশিল্পী শ্রীধর দাস জানান, ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আলো তৈরির প্রতি তাঁর বিশেষ একটা ঝোঁক ছিল। চন্দননগরের প্রথম তিনি নিয়ে আসেন টর্চের ল্যাম্প থেকে তৈরি আলো বা ৬.২ টুনি বাল্বের আলো। সেই বছর প্রথমবার সারা কলকাতার মানুষ দেখেছিল কলেজ স্কোয়ারে দুর্গাপুজোয় জলের নিচে আলো জ্বলছে। তিনি আরও বলেন, ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি আলো তৈরির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চন্দননগরের আলোর সবথেকে বড় ঐতিহ্য, আলোর বোর্ড এবং আলোর তৈরি গাছ, সবই গড়ে উঠেছিল শ্রীধর দাসের হাত ধরেই।
তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করলে, প্রথমেই দেখা যায় দেয়াল ভর্তি দেশ-বিদেশের খ্যাতি। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত কারণে নিজের হাতে আলো তৈরি করার কাজ বন্ধ রাখলেও, পরামর্শ দিতে এখনও তার ডাক পড়ে দেশ-বিদেশে। শেষবার দ্বিতীয় হুগলি সেতুর আলো তৈরি করার জন্য ডাক পড়েছিল তাঁর। যদিও এই মুহূর্তে যে-সমস্ত আলো পাওয়া যায়, সেই সবই চায়না আলো। তবে শিল্পী যা তৈরি করেছেন, সেসবই কিন্তু তাঁর নিজের হাতে গড়া। কখনও ভাঙা টিউবলাইট দিয়ে নতুন করে আলো তৈরি করা, আবার কখনও বাঁশের কঞ্চি কেটে তার মধ্যে টর্চের বাল্ব লাগিয়ে আলোর ডিজাইন। তাই যতবারই চন্দননগরকে আলোর শহর বলা হবে, ততবারই চন্দননগরের আলোর জন্মদাতা হিসেবে উঠে আসবে শ্রীধর দাসের নাম।