পৃথিবীর প্রথম নথিভুক্ত রূপান্তরকামী, লিলি এলবির শিকল ভাঙা অজুতের প্রেরণা...

নিজের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছবির আঁতুড়ে একরাশ অপেক্ষা নিয়ে বসেছিলেন গিয়ার্দা। গিয়ার্দা ওয়েগনার। কোপেনহেগেনের শিল্পীমহলে আইনার এবং গিয়ার্দা–স্বামী-স্ত্রী দু'জনেরই বেশ নামডাক। আইনার মূলত পোস্ট-ইম্প্রেশনিষ্ট ধারার ল্যান্ডস্কেপ করেন। গিয়ার্দা আজকাল তেমন সময় করে উঠতে পারেন না। বই আর ম্যাগাজিনের ইলাস্ট্রেশনের কাজ করে সংসার চালাতে হয় তাঁকেই। আইনারের ছবি যে বিক্রি হয় না তা নয়, তবে একটা নিয়মিত রোজগার তো প্রয়োজন। সংসার না হলে চলে কী করে। ফুরসৎ কম। তার মাঝেই যেটুকু ছবি নিয়ে বসা যায়। ক'দিন ধরে অ্যানা লারসেন সময় দিচ্ছেন গিয়ার্দাকে। সে সময় গোটা ডেনমার্ক যাঁর অভিনয়ের ভক্ত, সেই অভিনেত্রীকে মডেল হিসেবে পাওয়াটা কম কথা নয়। অথচ বেলা পড়ে এল। আজ এখনও এলেন না ভদ্রমহিলা। এতটা সময় জলে গেল। ভুরু কুঁচকে বসে এইসব ভাবছিলেন হঠাৎ টেলিফোন এল অ্যানার। অনিবার্য কারণে আসতে পারছেন না। দুঃখপ্রকাশ করে সামান্য একথা সেকথা বলতে বলতেই একটা অভিনব আইডিয়া দিলেন মহিলা। ব্যাপারটা গিয়ার্দারও খুব মনে ধরল। সত্যি তো। আইনারের শরীর অত্যন্ত পেলব। ওকে মেয়ে সাজিয়ে মডেলের কাজ চলতে পারে নির্বিঘ্নে। গিয়ার্দা তখনও জানেন না, এই পরীক্ষা আইনারকে মুক্তির রাস্তা দেখাবে।

ওয়েগনার দম্পতি

ওয়েগনার দম্পতি

আইনারকে মহিলা সাজানো হল। চমৎকার মানাল। একের পর এক ক্যানভাসে শ্যাওলা রঙের তলা থেকে কখনও ফুটে বেরোচ্ছে হলুদ, সেই আভা ছুঁয়ে যাচ্ছে আইনারের পরচুলায়, কখনও উরু অবধি তুলে আনা লাল পোষাকের সর্বত্র সেই রক্তিম ঠোঁটের আবেদন। পিছনের ল্যাণ্ডস্কেপের রং মডেলের মেজাজ অনুযায়ী কখনও গাঢ়, কখনও অত্যন্ত হালকা। দুজনে মেতে উঠলেন যেন নতুন খেলায়। কিন্তু নিজের ছায়ার কথা শুনতে পাচ্ছিলেন আইনার। এক অপরকথা। যেন মুখের উপর থেকে একটা বহুদিনের চটক সরে যাচ্ছে। চিরকাল যে অনুভূতি ভীষণ অচেনা বোধ হত, সেই অনুভূতির সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা ঝলকে ঝলকে ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত যাপনে। ছায়ার গলা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। বহুদিন পরে এ বিষয়ে তিনি লিখবেন, “সেই ছদ্মবেশ যে আমায় মুক্তির আরাম দিয়েছিল, তা নিয়ে আজ আর সন্দেহের অবকাশ নেই। নারী পোষাকের নরম ছোঁয়া, আহা! যেন জীবনে এই প্রথমবার আমি নিজের ঘরে এলাম।”

দু'জনে বিভোর হয়ে মেতে আছেন নতুনত্বের আনন্দে। এমনই একদিন অ্যানা স্টুডিওয় এলেন আচমকা, আগেভাগে কিছু না জানিয়েই। আইনারের নারীবেশ দেখে অ্যানা বিমোহিত। নিজেরই ভাবনার মূর্তরূপ যেন সাক্ষাৎ রূপকথা। তাঁর মনে হল এই নতুন ব্যক্তিত্বের একটা নাম প্রয়োজন। আইনার আর এই নতুন ব্যক্তিত্ব এক নন। তাই তিনি ঐ মানসকন্যার নাম রাখলেন লিলি। লিলির যাত্রাপথ এখানেই শুরু। তখনও একই শরীরে দুই পরিচয়, দুই মনন। সেই নতুন পরিচয়, ওরফে লিলি, গিয়ার্দার মডেলের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে নেমে এল বাস্তব জীবনে। শুরু হল বেড়া ভাঙার প্রথম অধ্যায়। মডেল হওয়ার যে ক্ষেত্র ছিল একান্ত ব্যক্তিগত, সেখানে নারীর বেশ সীমার ওপারে উঁকি দেওয়া মাত্র। কিন্তু সমাজজীবনে তাঁর উত্তরণ লিলিকে সীমার ওপারে এমন এক বিপজ্জনক সরু পথে ঠেলে দিল যার পদে পদে মূলস্রোতের নিষ্ঠুর নখদাঁতের ভয়। তবু মুক্তির আনন্দ। কোপেনহেগেনের পথে পথে শিশুর কৌতূহল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন লিলি। একের শৈশব, অপরের বার্ধক্য। চাপিয়ে দেওয়া বোঝা জরাগ্রস্ত হয়ে উঠলে ভার আরো বাড়ে। অবশেষে একসময় নিজের ভণিতার অতীত, নিজের ‘পুরুষ’ পরিচয়ের মৃত্যুর পথকেই বেছে নেবেন লিলি।

গিয়ার্দের আঁকা ছবিতে লিলি

১৮৮২ সালের ২৮ ডিসেম্বর যে দিনেমার আঁকিয়ে জন্মেছিল আইনার নাম নিয়ে, রয়্যাল ড্যানিশ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে পড়াশোনা করার সময় গিয়ার্দা যার প্রেমে পড়ে, যে সমগ্র ডেনমার্কে সাড়া ফেলে দিয়েছিল নিজের আঁকা ছবি দিয়ে, জীবনের দুই তৃতীয়াংশ পেরিয়ে লিলি জানতে পারলেন সেই মানুষটাই আসলে ছদ্মবেশ। একটা ছায়ামাত্র। বাইরের জগতে নতুন পরিচয়েই আনাগোনা বাড়তে লাগল তাঁর। ১৯১২ নাগাদ ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। গিয়ার্দার ছবির মডেল আসলে তাঁরই প্রিয়তম। মূলস্রোতের পাণ্ডারা উঠে পড়ে লাগলেন। এমন একটা বিচ্যুতি মেনে নেওয়া যায়? পবিত্র পালক ঝরে তখন খেঁকুড়ে শকুন ‘সভ্যতা’। দলা পাকানো গলায় চারিদিকে ছিঃ ছিঃ। ঝড় সামলাতে প্যারিসে পালিয়ে এলেন দম্পতি। দীর্ঘকাল ধরে শিল্পীদের ভাঙাগড়ায় প্যারিস তখন নমনীয়। পরিচিতির অভ্যেস ভয়কে সহনীয় করে। তাছাড়া সেখানে দম্পতির শিকড়ের ভার নেই। তাঁরা দুজনেই মুক্ত। এ পর্যায়েও প্যারিসের শিল্পী মহলে লিলি ও আইনার–দু'জনকেই দেখা যেত। সঙ্গে থাকতেন গিয়ার্দা। লিলির সঙ্গে লোকের পরিচয় করাতেন আইনারের বোন হিসেবে। মুখের মিলে সন্দেহও করত না কেউ।

কিন্তু এই দ্বৈত জীবন টানা ক্রমেই অসহ্য হয়ে পড়ছিল লিলির কাছে। এতটা সময় আইনারের হাত ধরে সমাজ ছিনিয়ে নিয়েছে, লিলির নিজের বলতে কি কিছুই থাকবে না? তখনও আঁকাআঁকি চলছে। সেটুকুই শান্তি। বাকি সমস্ত জীবন হয়ে উঠেছে বিষে বিষে জর্জরিত। স্বীকৃতি নেই। অস্তিত্ব একটানা গুমরে যাচ্ছে। ডাক্তাররা সাহায্য তো করলেনই না, স্ক্রিৎজোফেনিক তকমা লাগিয়ে দিলন। আখেরে তারাও মূলস্রোতের বই তো নয়। গিয়ার্দে পাশে আছেন কিন্তু সম্পর্কে চিড় ধরছে। ছায়ার প্রেমকে কী ভাবে নিজের বলে মেনে নেবেন? অথচ নিজেরই তো ছায়া। সামাজিক নির্মাণ হলেও সমানুভূতিকে অস্বীকার করেন কী ভাবে? তা তো একান্ত ব্যক্তিগত। প্রেম নেই স্পষ্ট, অথচ সম্পর্কের ভূত তাড়িয়ে নিয়ে ফেরে। চূড়ান্ত ঘোলাটে সব কিছু। আইনারকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। চাপিয়ে দেওয়া ‘পুরুষসত্তা’ লিলির গলা টিপে ধরছে ক্রমশ। নারী হয়ে বাঁচার কি উপায় নেই? আড় চোখ সইতে সইতে অপমান সইতে সইতে অত্যাচার সইতে সইতে এক অতল খাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল লিলি। অবলিভিয়ন। ১৯৩০-এর পয়লা মে। আত্মহত্যার দিন হোক তবে। স্বতস্ফূর্ত আত্মহত্যা নয়। মৃত্যুর উদ্দেশ্য থাকা দরকার। পরিকল্পনা মাফিক চলে যাওয়া নিজের ইচ্ছায়। সামাজিক নির্মাণের বিপরীতে নিজস্ব নির্মাণ। ‘মূলের’ বিরুদ্ধে অপরের প্রতিরোধ এক কদম দু'কদম।

ম্যাগনাস হার্সফিল্ডের খবর এসে পৌঁছল লিলির কাছে। জার্মানের এই সেক্সোলজিস্ট তখন কাজ শুরু করেছেন বটে, কিন্তু একেবারেই প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক অস্ত্রোপচার। তা হোক। সীমা অতিক্রমের আরেক অধ্যায় শুরু হল। শরীরী পরিচয়ের বেড় অস্বীকার তার প্রথম ধাপ। ১৯৩০-এর শেষভাগে লিলির সার্জারি আরম্ভ হবে। একটানা চার থেকে পাঁচটি সার্জারি প্রয়োজন। প্রথমবার অস্ত্রোপচার হল বার্লিনে। শুক্রথলি ও শুক্রাশয় বাদ দেওয়া হল। পরেরটি ড্রেসডেনে। লিঙ্গ বাদ দিয়ে ডিম্বাশয় যোগ হল শরীরে। শেষ অস্ত্রোপচারে জরায়ু রোপণ করা হল এবং যোনি তৈরি করা হল কৃত্রিম উপায়ে। অনেকের মতে সার্জেনরা তাঁর শরীরে রুডিমেন্টারি ওভারি পেয়েছিলেন, তবে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

১৯৩০-এর অক্টোবরে ডেনমার্কের রাজা ক্রিষ্টিয়ান এক্স গিয়ার্দার সঙ্গে লিলির বিবাহ খাতায় কলমে ভেঙে দেন। সে বছরই রাষ্ট্র লিলিকে লিলি ইলজি এল্ভিন্স নামের পাসপোর্ট দিতে বাধ্য হয় রাষ্ট্র। যে স্বীকৃতির খোঁজ করছিলেন এতদিন নিজের বলিষ্ঠ লড়াইয়ে তা ছিনিয়েই নিলেন লিলি। একা। ইতিমধ্যে ফরাসি আর্ট ডিলার লুজঁ প্রেমে পড়লেন লিলির। বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হল। বিয়ের পরে সন্তানের জন্ম দেওয়ার ইচ্ছেও ছিল লিলির। পুরোপুরি আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন এই সময়। সম্পূর্ণ আঁকাআঁকির ব্যাপারটাই আইনারের অর্জন বলে অনুভব করেছিলেন। কাজেই সে ‘মূল’ জীবনের প্রসঙ্গ জিইয়ে রাখতে চাননি। গড়ে তুলছিলেন নিজেকে শূন্য থেকে তিল তিল করে। কিন্তু ১৯৩১-এর জুনে শেষ সার্জারির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নতুন জরায়ু প্রত্যাখান করল লিলির শরীর। আর কিছু করার ছিল না। এ হেন  প্রত্যাখ্যান রোধ করার ওষুধ আবিষ্কার হবে আরো অর্ধশতাব্দী পরে। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকার মূল্য কিছু থাকেই। ধীরে ধীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে থাকল লিলির শরীরে। ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩১। ইনফেকশন থেকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। মারা গেলেন সরকারি নথিভুক্ত রূপান্তরকামী অস্ত্রোপচারের পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া প্রথম মানুষটি।

১৯৩০-এ লিলি এলবি

মারা যাওয়ার আগে লিখছেন, “চোদ্দ মাস অনেকের কাছে মুহূর্তমাত্র, জানি। আমার কাছে গোটা একটা জীবন।” কী ভীষণ যন্ত্রণা, মানসিক চাপ, ‘সামাজিক’ অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে পথ হেঁটে এসেছেন লিলি, তা কল্পনার অতীত। অথচ কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। পরিবার, পরিচিত, রাষ্ট্র–স্বাভাবিকভাবে নিজস্বতাকে চুরমার করতে হরবখত উদ্যত যেসব শক্তি, লড়ে গেছেন তাদের সঙ্গে বিলকুল একা। এই সাহস বহু যন্ত্রণার অর্জন। যে সময়ে পাগলাগারদে ভরে শকের পর শক দিয়ে মানবিকতাকে ‘ভদ্রতার’ বুলি শেখান হচ্ছে, দিনের পর দিন করা হচ্ছে মানসিক অত্যাচার–সেই ‘মনোরম সভ্য’ জগতের এক কোণে এক ব্যক্তি নিজের ভাগেরটুকু আদায় করে নেওয়ার জন্যে লড়ে যাচ্ছেন একা। লড়াইয়ের পথকে খ্যাতি মসৃণ করে। সেই খ্যাতিকেও প্রত্যাখ্যান করছেন। ছিনিয়ে নিচ্ছেন চৌদ্দ মাসের একটা জীবন, যা একান্ত নিজের। কী প্রবল আত্মবিশ্বাস। ঘায়ে ঘায়ে জর্জরিত হয়েও মূলস্রোতের প্রতিটি মানুষের থেকে বেশি বেঁচে নিচ্ছেন বাঁচার অকুণ্ঠ আকাঙ্ক্ষায়। প্রায় এক শতক আগে লিলি এলবি নিজের পদবীতে নতুন জন্মভূমি ড্রেসডেনের একটি নদীকে ধারণ করে কিছু নিজস্বতার স্রোত দিয়েছিলেন আলতো। সেই স্রোতের ঘরাণায় এখনও মূলস্রোত নিজের সবটুকু চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মিশিয়ে ফেলতে পারল না—এটাই আক্ষেপের।

 

তথ্যঋণ-

“Biography of Lili Elbe, Pioneering Transgender Woman.” n.d. ThoughtCo. 

“Lili Elbe.” 2022. In Wikipedia.

 n.d. Legacy Project Chicago. Accessed January 19, 2022. 

“Lili Elbe | Biography, Wife, Art, Surgeries, & Facts | Britannica.” n.d. Accessed January 19, 2022.

More Articles