ভয় দেখাচ্ছে ঘাতক 'লং কোভিড'! কেন এই হানাদারি, কী ভাবে মুক্তি...

কোভিড (Covid-19) থেকে সেরা ওঠার তিন-চার মাস পরেও অসহ্য ক্লান্তি, গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, কাশি, শ্বাসতন্ত্রে নানান রকম সমস্যা লেগেই আছে বেশ কিছু মানুষের। কারও কারও বা লেগে রয়েছে নানারকম নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, যার মধ্যে ডিপ্রেশন (Depression) এবং অ্যাংজাইটি (Anxiety) অন্যতম। বেশ কিছু রোগীই জানাচ্ছেন, কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন দীর্ঘদিন আগেই; অথচ পার্কিনসনস (Parkinson’s)  রোগীর মত হাত-পা কেঁপে উঠছে কোভিডের পর থেকে, চলছে এত মাস পরেও। অ্যালঝাইমার্স রোগের (Alzheimer’s Disease) মতো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে, কারো আবার সমস্যা হচ্ছে সাধারণ বিষয় বা শব্দ মনে রাখতে, বা  সহজ হিসেব কষতে।

পোস্ট-অ্যাকিউট সিক্যিউয়েলি অফ কোভিড-১৯ ( Post-acute Sequelae  of Covid-19) বা PASC! হ্যাঁ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই নামই রাখা হয়েছে লং-কোভিড বা দীর্ঘদিন ধরে চলা কোভিডজনিত শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলিকে।

 দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন ছিল কারা কোভিড থেকে সেরে ওঠার এতদিন পরেও এই সমস্যাগুলিতে ভুগতে পারেন। উত্তর মিলল অবশেষে। খুব সম্প্রতি বিজ্ঞানের জার্নাল সেলে (Cell) প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, কেউ পিএএসসি-তে ভুগতে পারেন চারটি অবস্থায়। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সংক্রামক ব্যাধি (Infectious Disease) বিষয়ক গবেষক ড: জেসন ডি. গোল্ডম্যান (Dr. Jason D. Goldman)।

আরও পড়ুন-বাংলা কল্পবিজ্ঞান শুরু হয়েছিল তাঁর হাতেই, জগদানন্দকে মূলস্রোত ঠাঁই দেয়নি

কী কী এই চারটি অবস্থা? প্রথমত, যাদের শরীরে প্রচুর পরিমানে অটোঅ্যান্টিবডি (Autoantibody) তৈরি হয়; দ্বিতীয়ত, কোভিড থেকে সেরে ওঠার দীর্ঘদিন পরেও যাদের রক্তে  নোভেলকরোনা ভাইরাসের আরএনএ (RNA) রয়ে যায়; তৃতীয়ত, যারা কোনো এক সময়ে এপস্টেইন বার ভাইরাসে (Epstein Barr Virus)  আক্রান্ত হয়েছিলেন; চতুর্থত, যারা টাইপ-২ ডায়বেটিসে (Type-II Diabetes) ভোগেন।

অটোঅ্যান্টিবডি তৈরি হলে সমস্যা কোথায়? শরীর এই ছোটো-ছোটো প্রোটিন অণু (Protein Molecule) তৈরি করে, যা কিনা শরীরের বিভিন্ন কলা-কোশের বিরুদ্ধে লড়ে শরীরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এদিকে অন্যান্য মাইক্রোবসের (Microbes) মত নোভেল করোনাভাইরাস আক্রমণ করলে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম (Immune System) ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে সাইটোকাইন (Cytokine) নামের ছোটো-ছোটো প্রোটিন তৈরি করে। এরা আমাদের শরীরে ইনফ্ল্যামেশনের (Inflammation) জন্যে দায়ী। কোভিডের অন্যতম লক্ষণই হল ইনফ্ল্যামেশন এবং সাইটোকাইন ঝড় বা সাইটোকাইন স্টর্ম (Cytokine Storm) তৈরি হওয়া। সাইটোকাইন স্টর্মে খুব অল্প সময়ের মধ্যে শরীরে প্রচুর পরিমানে সাইটোকাইন তৈরি হয়। ফলে ইনফ্ল্যামেশন চুড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন কলা-কোশ এবং অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে উল্ল্যেখ্য, ইনফ্ল্যামেশনের ফলেই আমাদের জ্বর, গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। এর পাশাপাশি যদি অটোঅ্যান্টিবডি তৈরি হয়, শারীরিক সমস্যা বহুগুণ বেড়ে যায়।

এদিকে রক্তে যদি দীর্ঘ দিন ধরে নোভেল করোনাভাইরাসের আরএনএ থেকে যায়, তাহলে তো আমাদের ইমিউন সিস্টেম তার বিরুদ্ধে লড়তেই থাকবে। সাইটোকাইনও তৈরি হতে থাকবে ততদিন। ২০২১ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক মাইকেল বি. ভ্যালএলজ্যা়কার (Michael B. VanElzakker)  "ফ্রন্টিয়ার্স ইন মাইক্রোবায়োলজি" (Frontiers in Microbiology) জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখিয়েছেন, লং-কোভিডে ভোগা রুগীদের কোভিড থেকে সেরে ওঠার দীর্ঘদিন পরেও সাইটোকাইন তৈরি হওয়ার ঘটনা। যদিও তখনও অজানা ছিল লং-কোভিড বা পিএএসসি-এর সঠিক কারণ কী কী হতে পারে।

পিবিএস নিউজ়আওয়ারে (PBS NewsHour) দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে গোল্ডম্যান জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন রক্তে নোভেলকরোনা ভাইরাসের আরএনএ থেকে থাকলে অ্যান্টিভাইরাল মেডিসিন (Antiviral Medicine) দিয়ে তার চিকিৎসা করা যেতে পারে এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই যে অ্যান্টিভাইরাল লং-কোভিডের মোকাবিলা করতে পারে।

পিএএসসি-এর তৃতীয় কারণ এপস্টেইন বার ভাইরাস, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় সাধারণত কমবয়সীরা। কিন্তু পরবর্তী কালে এই ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় (Dormant State) চলে যায়। সারা পৃথিবীতে ৯০ শতাংশ মানুষই এর দ্বারা আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে আবার ৯৫ শতাংশই সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক। কোভিডের মতই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ক্লান্তি (Fatigue), ব্রেইন ফগ  (Brain Fog) বা সাইকোনিউরোসিস (Psychoneurosis) , জ্বর, মাথাযন্ত্রণা, ফ্যারিনজাইটিস (Pharyngitis), মায়াগ্লিয়ার (Myaglia) মত সমস্যা দেখা যায়। এর পাশাপাশি, এপস্টেইন বার ভাইরাসে আক্রান্ত হলে টিনিটাস (কানে ঝিঁঝিঁ ধরা) এবং বধির হয়ে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা যায়। লং-কোভিডের ক্ষেত্রেও কিন্তু একাধিক রোগীর ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। 

আরও পড়ুন-ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ঠিক কতটা মান্যতা দিচ্ছে সরকার? জানুন অন্দরের কথা

অন্য দিকে লং-কোভিড বা পিএএসসি-এর চতুর্থ কারণ  টাইপ-টু ডায়াবেটিস থাকলে শরীরের একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ইনফ্ল্যামেশনের সম্ভাবনাও বাড়ে।

সেলে প্রকাশিত এই গবেষণায় গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেন ২০৯ জন রোগীকে, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৮৯-এর মধ্যে। এরা প্রত্যেকেই ২০২০ সালে বা ২০২১ সালের শুরুর দিকে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

এই গবেষণার প্রধান পর্যবেক্ষক এবং সিয়াটলের সংস্থা ইনস্টিটিউট অফ সিস্টেমস বায়োলজির প্রেসিডেন্ট জেম্স হিথ নিউ ইয়র্ক টাইমসে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ওনাদের এই গবেষণা পরবর্তী কালে লং-কোভিডের চিকিৎসার হদিশ দেবে, যার কারণ এতদিন অজানা ছিল লং-কোভিডের আসল রহস্য কী।

এই মুহুর্তে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি মাথায় আসে, তা হল ভ্যাকসিন কি আটকাতে পারে লং-কোভিডকে বা কমাতে পারে এর ভয়াবহতা? নিউজআওয়ারে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গোল্ডম্যান জানাচ্ছেন, ভ্যাকসিন আদৌ তা পারে কি-না সেই বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাঁর মতে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে টিকাকরণ লং কোভিড আটকাচ্ছে, আবার কিছু গবেষণায় ঠিক এর উল্টোটা দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ টিকাকরণে লাভ হচ্ছে না; কিন্তু যে সমস্ত গবেষণায় লাভ হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে, সেখানে অনেকক্ষেত্রেই এমন রোগীদের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে যারা মাইল্ড কোভিডের পর লং-কোভিডের সমস্যায় ভুগছেন।

More Articles