মাছের কচুরি থেকে মৌরি লজেন্স, অবহেলিত হয়েও টিকে আছে কলকাতার যেসব খাবার

হারিয়ে যেতে থাকা খাবারের তালিকার মধ্যে জলখাবারের বিভিন্ন পদ থেকে কিছু বিশেষ লজেন্স অবধি সবকিছুই রয়েছে।

কলকাতায় পাওয়া যায় না, এইরকম খাবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই কলকাতাতেই গত শতকের শেষ অবধি এমন বহু জনপ্রিয় খাবার ছিল, যা বর্তমানে খুব কম দোকানে পাওয়া যায়। তাদের জায়গা নিতে শুরু করেছে নতুন ধরনের বিভিন্ন রকমের খাবার। সেই হারিয়ে যেতে থাকা তালিকার মধ্যে জলখাবারের বিভিন্ন পদ থেকে কিছু বিশেষ লজেন্স অবধি সবকিছুই রয়েছে।

বিভিন্ন রকমের নতুন স্বাস্থ্যকর খাবারের আমদানি সত্ত্বেও সকালের জলখাবারের ক্ষেত্রে কচুরি আজও জনপ্রিয়। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় বহু কচুরির দোকান রয়েছে। সকাল হলেই সেখানে মানুষের ভিড় দেখা যায়। দাঁড়িয়ে অথবা বসে কচুরি খাওয়া থেকে বাড়ির জন্য কচুরি কিনে নিয়ে আসার লোকের ভিড় এই দোকানগুলিতে লেগেই থাকে। গত শতকের শেষ এবং এই শতকের শুরুতে বিকেলের জলখাবার হিসেবে এক বিশেষ ধরনের কচুরির বেশ চাহিদা ছিল। সেই সময় বিকেলে বহু দোকানে মাছের কচুরি পাওয়া যেত। কিছু কিছু দোকানে মাছের কচুরির সঙ্গে পাঁঠার ঘুগনি বিক্রি করা হতো। সেইসব দোকানে ক্রেতার সংখ্যা অন্যান্য দোকানের থেকে একটু বেশি থাকত। উত্তর কলকাতায় কয়েকটি দোকান শুধু মাছের কচুরি এবং পাঁঠার ঘুগনি বিক্রি করার কারণেই বিখ্যাত হয়েছিল। এই দোকানগুলোর বিশেষত্ব ছিল না তেমন, দেখানোর মতো চটক ছিল না মোটেই। বসে খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা তো ছিলই না। রংবেরংয়ের সাইনবোর্ড ছিল না। শুধু ছিল মুখে লেগে থাকার মতো খাবারের মনভরানো স্বাদ। বেশিরভাগ দোকানের নাম সেখানকার সাধারণ মানুষ জানত না। দোকানের মালিক অথবা বিক্রেতা অথবা এলাকার নাম থেকেই মানুষের মুখে মুখে দোকানের একটা নতুন নাম ছড়িয়ে পড়ত। বর্তমানে সন্ধের জলখাবার হিসাবে মাছের কচুরির জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। সেই কারণেই বহু দোকান মাছের কচুরি বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে যেসব দোকানে মাছের কচুরি পাওয়া যায়, সেখানে কচুরির সঙ্গে আলুর দম বিক্রি করা হয়। মূল্যবৃদ্ধি, মানুষের বদলানো চাহিদা সামলে খুব সীমিত কিছু দোকান আজও মাছের কচুরি বিক্রি করে চলেছে। তার মধ্যে বিখ্যাত বাগবাজারের ভূষণের দোকান (কাশিমবাজার স্কুলের থেকে একটু এগোলেই) ও 'নীলাচল' (বসুবাটীর গলিতে ঢোকার মুখেই)। ভূষণের মাছের কচুরি এখন আট টাকা করে, অন‍্যদিকে নীলাচল-এ প্রতি পিস কুড়ি টাকা করে বিক্রি হয়।

কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় আজও বহু ঘুগনি-বিক্রেতা দেখা গেলেও, তাঁদের মধ্যে খুব কম বিক্রেতাই আলুকাবলি বিক্রি করেন। বহু বিক্রেতার মতে, মানুষের মধ্যে আলুকাবলির চাহিদা কমে গিয়েছে। তার বদলে পাপড়ি চাটের, ভেলপুরির মতো খাবারের চাহিদা বেড়েছে। তাই তাদের মধ্যে অনেকেই আলুকাবলি বিক্রি করেন না। এই শতকের শুরুতেও বহু মানুষ, বিশেষ করে পড়ুয়াদের মধ্যে আলুকাবলি খুবই জনপ্রিয় ছিল। আলু, মটর, ছোলা, কাঁচালঙ্কা, নুন, তেঁতুল দিয়ে মাখা আলুকাবলি স্বাদ এবং দামের জন্য হয়তো স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে শীতকালে আচার বিক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ার পিছনেও হয়তো মানুষের পছন্দের পরিবর্তন দায়ী। দুই দশক আগেও শীতকালে বাড়িতে বাড়িতে আচার তৈরি করা হলেও আচার বিক্রেতাদের আশপাশেই ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড় লেগে থাকত। কাচের বয়ামে তেঁতুল, চালতা অথবা কুলের আচার বিক্রি করা বিক্রেতাদের বর্তমানে খুব কম সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: চিকেন স্টু থেকে মালাই টোস্ট, আজও কলকাতার খাবারের সেরা ঠিকানা এই একচিলতে গলি

বর্তমানে লজেন্স বলতে বেশিরভাগ মানুষ ক্যাডবেরি অথবা অন্যান্য সংস্থার চকলেটের কথা বলে। যদিও গত শতকের শেষের দিকেও ক্যাডবেরি এবং নেসলে কোম্পানির বিভিন্ন চকলেট বাজারে থাকা সত্ত্বেও অন্য বহু লজেন্স ছোটদের প্রিয় লজেন্সের তালিকায় ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মৌরি লজেন্স।বেশিরভাগ মানুষ মৌরি লজেন্স প্রস্তুতকারক কোনও সংস্থার নাম জানত না। এই ধরনের লজেন্সের কোনও বিজ্ঞাপন থাকত না। শুধু মানুষের চাহিদা এবং পছন্দ তার জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিল। এই মৌরি লজেন্স বিভিন্ন ভাবে বিক্রি করা হতো। তার মধ্যে অন্যতম আকর্ষক ছিল, আঙুলের মাপের প্লাস্টিকের বোতলে ভরা লজেন্স। এই প্লাস্টিকের বোতলগুলিতে অনেকসময় মানুষের পরিচিত বিভিন্ন ঠান্ডা পানীয়ের সংস্থার নাম লেখা অথবা লোগো আঁকা থাকত। ছোটরা মোটেই অবুঝ ছিল না। তারা জানত যে, ওই ঠান্ডা পানীয়র সংস্থা মোটেই এই লজেন্স বিক্রি করছে না। তা সত্ত্বেও অনেকেই ওই ছোট বোতলগুলি খুঁজত, কারণ লজেন্স শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেই বোতল জমিয়ে বন্ধুদের দেখানো যেত। বর্তমানে বিভিন্ন নামী-দামি সংস্থার চকোলেট এবং লজেন্সের যুগে মৌরি লজেন্স নিতান্তই বেমানান হয়ে পড়েছে। তাদের কোনও বিজ্ঞাপন নেই, কোনও নামী প্রস্তুতকারক নেই, ছোটদের মধ্যে তার চাহিদা নেই। খুব অল্প কিছু দোকানে সে এককোণে অবহেলা সহ্য করে পড়ে থাকে। এই একই দশা হয়েছে ললিপপের। চিকেন ললিপপের যুগে মানুষ লজেন্স-ললিপপকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। এই শতকের গোড়ায় বিভিন্ন দোকানে আলাদা আলাদা স্বাদের ললিপপ বিক্রি হতো। এই শতকের প্রথমে শতকের বেশ কিছু বছর একটি জনপ্রিয় সংস্থা দু'টি ভিন্ন স্বাদের ললিপপ বিক্রি করত। তারপরেই মানুষের পছন্দ এবং চাহিদার বদল ঘটে এবং ক্রমে ক্রমে ললিপপ বিক্রি খুব কমে যায়।

ভবিষ্যতে হয়তো মানুষ আবার কোনও নতুন নতুন খাবারে প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বর্তমানের বেশ কিছু সহজলভ্য খাবারকে তার পছন্দের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেবে। অথবা আবার পুরনো সময়ের কিছু খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। এই বিভিন্ন সময়ে মানুষের পছন্দের তালিকা থেকে বাদ যাওয়া খাবারগুলি এক একটা প্রজন্মের স্মৃতিতেই থেকে যাবে।

More Articles