৪৮৯ দরজা আর ১০০০ অলিন্দ নিয়ে ভুলভুলাইয়া যেন সত্যিই এক গোলকধাঁধা

লখনউয়ের বড়া ইমামবড়ায় বেড়াতে গিয়েছেন ফেলুদা এন্ড কোং। বিস্ময়ের সঙ্গে তাঁরা দেখছেন কীভাবে সারি সারি দরজার গোলকধাঁধা এসে মিলেছে একইরকম দেখতে নানান অলিন্দে। সে ভুলভুলাইয়ায় কোনো বেগানা পথিক পথ হারালে তাঁর ফেরার সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তার কালো ছোপ ধরা অলিগলিতে শুধুই পাক খেয়ে যায় কবুতরের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সত্যজিৎ রায়ের 'বাদশাহী আংটি' উপন্যাসে বড়া ইমামবড়াও যেন হয়ে উঠেছিল রহস্যে ঘেরা প্লটের এক চরিত্র। সে রহস্য আজও ফুরোয়নি। একবিংশ শতাব্দীতেও আওয়াধের একসময়কার রাজধানীতে নির্মিত এই স্থাপত্য যেন পর্যটকদের মনে সমানভাবে রোমাঞ্চ জাগায়। লখনৌর জমজমাট কোনও সন্ধেতে রুমি দরোয়াজার সমস্ত আলোগুলো যখন জ্বলে যায়, ভুলভুলাইয়ার প্রাচীন পাথরও তখন হয়ে ওঠে ইরানি গজলের মতো লজিজ। বড়া ইমামবড়ার ইতিহাসটাও বড় অদ্ভুত। নেহাতই নবাবী শৌর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এ ইমারত তৈরি হয়নি।

সুজা উদ দৌলার মৃত্যুর পর তখন সবে আওয়াধের সিংহাসন আলো করে বসেছেন আসফ উদ দৌলা। হাতে তাঁর অর্থকড়ি বিশেষ নেই। মাসিক খরচ আসে সুজা উদ দৌলার বেগমের কাছ থেকে। সিংহাসন লাভ করার ঠিক পরেই আসফ উদ দৌলা লখনউকে আওয়াধের নতুন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করলেন। ফৈজাবাদ থেকে গোমতী নদীর ধারে অবস্থিত এই শহরে সরিয়ে নিয়ে আসা হল আওয়াধের হেড আপিস। মহা সমারোহে সেজে উঠতে লাগল লখনৌ। সর্বদা ভোগ বিলাসে ডুবে থাকার অভ্যেস আসফ পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। নতুন রাজধানীতে এবার তিনি গড়াতে লাগলেন আলীশান সমস্ত ইমারত। ১৮৩০ সালে লখনৌ শহরের চাকচিক্য দেখে অবাক হয়ে  গেছিলেন বিদেশিনী এমা রবার্টস।  কবি মির তকি মিরের স্মৃতিমাখা এই শহরকে তিনি তুলনা করেছিলেন আরব্য উপন্যাসের কাল্পনিক চিত্রের সঙ্গে।  তা যাই হোক, সে সময় লখনৌ জুড়ে আসফ উদ দৌলার সুনাম। শোনা যায়, দোকানদাররা নাকি সকালে দোকান খুলতে খুলতে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলতেন 'ইয়া আসফ উদ দৌলা ও অলি'।

আসফের রাজপাট বেশ ভালোই চলছিল। নিজের রাজধানীকে ঢেলে সাজাতে প্রতি বছর তাঁর খরচ হত কম করে দশ লাখ টাকা। এ ছাড়াও প্রজাদের দান ধ্যান তো ছিলই। এমন সময় ১৭৮৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সাধারণ মানুষ পড়লেন অর্থকষ্টে। এমতাবস্থায় তাঁরা নবাবজাদার কাছে গিয়ে বললেন, 'হুজুর, আপনি এর একটা প্রতিকার করুন, নইলে আমরা মারা পড়ব।' প্রজাদরদী আসফ উদ দৌলা পড়লেন চিন্তায়। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে তিনি একটা উপায় বের করলেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষজনের বেকারত্ব দূর করতে বড়া ইমামবড়া তৈরির কাজ শুরু হল। নবাব নির্দেশ দিলেন স্থাপত্য নির্মাণের কাজে সকল মানুষকে হাত লাগাতে হবে। তার বিনিময়ে তাঁদের দেওয়া হবে দৈনন্দিন খাদ্যসামগ্রী। যতদিন না অবস্থার উন্নতি হচ্ছে ততদিন এভাবে চললে অন্তত না খেতে পেয়ে কাউকে মরতে হবে না।

কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। নবাবের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কী করা হবে? তাঁদের তো আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো হাতে ছেনি হাতুড়ি ধরিয়ে দেওয়া যায় না। অত ধকল তো তাঁদের সোনার অঙ্গে সইবে না। আসফ তাঁদের বললেন, 'এক কাজ করো। প্রত্যেকদিন যতখানি করে ইমারত তৈরি হচ্ছে, তার কিছুটা তোমরা রাতে এসে ভেঙে দিয়ে যাও। এতে করে যতদিন দুর্ভিক্ষের প্রকোপ চলবে ততদিন মানুষের হাতে কাজ থাকবে।' এভাবেই তিল তিল করে গড়ে উঠতে লাগল লখনৌর এই শানদার প্রাসাদ। একদল রোজ ইঁটের পরে ইঁট গেঁথে তার কারুকার্য তৈরি করেন, আরেকদল রোজ রাতে সেটা ভেঙে দিয়ে যান।

দিন যায়, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে আরম্ভ করে। এমনই একদিন এক বৃদ্ধা এসে ঝামেলা শুরু করলেন। কী ব্যাপার, না ইমামবাড়া তৈরির ঠেলায় নাকি তাঁর বাড়ি ভেঙে ফেলতে হবে, এমনটাই বলছে লোকজন। তাঁর বাড়িখানা এসে পড়েছে ইমামবাড়ার জমিতে, যার ফলে নির্মাণের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।  লাডো সকুম নামে এই বৃদ্ধা নবাবকে জানালেন যে তিনি মরে গেলেও তাঁর বাড়ির কোনও ক্ষতি হতে দেবেন না, কারন ওই বাড়িতে তিনি পবিত্র তাজিয়া রাখেন এবং প্রার্থনা করেন। নবাব জানালেন, 'আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, ইমামবাড়া তৈরি হয়ে গেলে তোমার তাজিয়া আবার ওখানেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এবং শুধু তাই নয়, পালা পার্বনের দিনে তোমার তাজিয়াই তোলা হবে প্রথমে, তারপর অন্য কথা।' আজকের দিনেও মুহরমের সময় লখনউতে এই রীতি মানা হয়।

ইমামবড়ার কারুকার্য যেন হয় সেরার সেরা, এমনটাই চেয়েছিলেন আসফ উদ দৌলা। সেই কথা মাথায় রেখে তিনি সেই ইমারতের প্রধান স্থপতি হিসাবে নির্বাচন করলেন কিফায়াতুল্লা নামে এক ভদ্রলোককে। কিফায়াতুল্লা ঠিক করলেন তিনি এমনভাবে এ প্রাসাদকে গড়ে তুলবেন, যাতে তার সিলিংয়ের ওজন সইতে কোনও স্তম্ভের ব্যবহার না করতে হয়। সেভাবেই তৈরি হল তাঁর মস্তিস্কপ্রসূত ইমামবাড়া। তার উদ্বোধন হতে তখনও হপ্তাখানেক বাকি,  এমন সময় মেজর জেনারেল মার্টিন নামে এক ফরাসি রাজমিস্ত্রি তাঁর কান্ড দেখে বললেন, 'ওহে বোকারাম, এ কী করেছ?  সিলিংয়ের নীচে কোনও স্তম্ভ দাওনি?  ছাদফাদ শুদ্ধু ভেঙে পড়বে তো সব।'

কিফায়াতুল্লা বললেন, 'তাই নাকি? বেশ, সিলিংয়ের নীচে একটা খাট রেখে দিন, আমি এক সপ্তাহ ওতে শুয়ে ঘুমোব।।দেখি কী হয়।'  তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করলেন, এবং অদ্ভুতভাবে তাঁর বিদ্যের জোরেই কোনও অঘটন ঘটল না। কাজের শেষে নবাব যখন তাঁকে জিগেস করলেন, 'বলো, তোমায় কত টাকা সেলামি দেব,' কিফায়াতুল্লা বললেন, 'আমার এক পয়সাও চাই না হুজুর, খোয়াব শুধু একটা। আমি মরলে যেন ওই ইমামবড়ার জমিতে আমায় দফন করা হয়।' মহৎ শিল্পীরা আর কবেই বা অর্থের দাসত্ব করেছেন?

বড়া ইমামবড়ার অন্যতম আকর্ষণ ভুলভুলাইয়া। এ গোলকধাঁধার দরজার সংখ্যা ৪৮৯, এবং ১০০০ অলিন্দ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, প্রত্যেকটা দরজাই একরকম দেখতে। ভুলভুলাইয়ার মধ্যিখানে একটা বিশাল হলঘর। গাইডরা অনেক সময় এই ঘরে নিয়ে গিয়ে পর্যটকদের একটা মজার খেলা দেখিয়ে থাকেন। ঘরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁরা একটা দেশলাই জ্বালান, পর্যটকরা অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে তার বারুদের শব্দ শুনতে পান স্পষ্ট। বলা হয় ইংরেজ আমলে এই ভুলভুলাইয়ার ভেতরে নাকি একটা গোপন কুঠুরি ছিল। তার ভেতর বিশেষ কিছু আসামীকে বন্দf করে রাখতেন ব্রিটিশরা।  বাজি রেখে গাইড ছাড়া ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে আর ফিরতে না পারা মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধায় তাঁরা চিরদিনের জন্য থেকে গিয়েছেন এবং অবধারিতভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলত তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানান ভৌতিক গল্প। ইংরেজদের দ্বারা নির্বাসিত হওয়ার পর আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ লিখেছিলেন, 'যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী, তব হাল অধম পর ক্যায়া গুজরি।' এ শহরের মায়া বড় অল্প নয়। ধরুন ক্লক টাওয়ার দেখে আপনি হোটেলে ফিরছেন, হঠাৎ চোখ গেল ভুলভুলাইয়ার ছাদের সেই সার দেওয়া জানালাগুলোর দিকে। আশেপাশে তাকান, দেখবেন কী বিষণ্ণ তার একাকী মিনারেরা। আর তাদের ঠিক মধ্যিখানে, রহস্যের খাসমহল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড়া ইমামবড়া।

তথ্যঋণ: মেটিয়াবুরুজের নবাব: শ্রীপান্থ

Did You Know About These Five Interesting Stories Around Lucknow's Bara Imambara : Uttara Gangopadhyay

 

More Articles