"মুঝে জিন্দা রেহনা হ্যায়," অসুস্থ মধুবালাকে যেভাবে একা ফেলে গিয়েছিলেন কিশোর কুমার

Madhubala Kishore Kumar Relation: নয় বছর ধরে বিছানাতেই পড়েছিলেন মধুবালা, সমস্ত লাবণ্য, মোহ ছেড়ে চলে গিয়েছিল অভিনেত্রীকে।

পর্দায় এক ঝলক চোখ তুলে তাকানো, অল্প ফাঁক করা ঠোঁটে মুক্তোর মতো দাঁতের সারি, অপার্থিব হাসি। ভুবন ভোলানো অমন রূপ আর দেখেনি ভারতীয় সিনেমার দর্শকরা। এক আস্ত প্রজন্মের কাছে, মধুবালা পর্দায় সাক্ষাৎ দেবী। অনেক তাবড় অভিনেত্রী এসেছেন, আসবেন, অনেক নায়িকা এসেছেন, মন জয় করেছেন কিন্তু মধুবালার মতো সম্মোহনী ক্ষমতা সম্ভবত আর কারওই ছিল না, নেইও। পর্দায় মধুবালার জন্নতজয়ী আবেদন আজও তরতাজা, আজও সমান আকর্ষণীয়। এমন মোহিনী রূপ যার, সেই নায়িকা সমস্ত আলো ফেলে চলে গিয়েছিলেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। তাঁর সেই প্রাণবন্ত লাবণ্যই তাই আজও থিতু হয়ে আছে ভারতীয় সিনেপ্রেমীদের চোখে, মনে। মধুবালার বয়স বাড়ে না কোনওকালেই।

মধুবালার পর্দার ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সারাক্ষণ যেন রেষারেষি করে এগিয়েছে, অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। পর্দায় অমন মায়া মাখা হাসি, মুগ্ধতা এবং খুনসুটিময় চাহনি দিয়ে লক্ষ লক্ষ হৃদয় চুরি করেছেন মধুবালা। ক্লান্ত জীবনে তাজা বাতাস হয়ে এসেছেন মধুবালা, আর নিজে সারা জীবন শান্ত প্রেমের জন্য আকুল হয়েছেন, রোম্যান্স তাঁকে ছুঁয়ে চলে গিয়েছে অন্য পাড়ায়। মধুবালাকে আত্মীয় করে নেয়নি। অভিনেতা প্রেম নাথ, পরিচালক কিদার শর্মা এবং কমল আমরোহির সঙ্গে নাম জড়িয়েছে তাঁর, তবে কাঙাল তিনি হয়েছেন একজনেরই প্রেমে, দিলীপ কুমার। জীবনের একমাত্র প্রেম দিলীপ কুমারকে আজীবন ভালোবেসে গেলেন কিন্তু বিয়ে করতে পারলেন না মধুবালা। তারপর সম্পর্কে জড়ালেন কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমারের সঙ্গে, প্রেম করে বিয়েও করলেন। নয় বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তবু সুখের মুখ দেখলেন না মধুবালা।

দিলীপ এবং মধুবালার কেন বিয়ে হলো না তা নিয়ে বলিউডের অন্দরে নানান গুঞ্জন। অনেকেই বলেন, মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান ছিলেন মূল খলনায়ক। মধুবালার বোন জাহিদা ওরফে মধুর ভূষণ দাবি করেছিলেন, নয়া দৌড় সিনেমা তৈরির সময় আদালতের মামলা এবং তাদের নিজ নিজ অহং বোধের ফল ভুগতে হয়েছে এই প্রেমকে। দিলীপ নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছিলেন, আতাউল্লাহ এই বিয়েকে ব্যবসায়িকভাবে দেখতে চেয়েছিলেন। সব মিলিয়ে বিষয় এমন তিক্ত হয়ে যায় যে মধুবালা আর দিলীপের সম্পর্কের সুতো ঢিলে হতে থাকে। তবে কেউ কাউকে না ভালোবেসে থাকতে পারেননি আজীবন। দিলীপের প্রেমের মোহই মধুবালাকে এগিয়ে দেয় কিশোর কুমারের সঙ্গে বিয়ের বাঁধনে বাঁধার পড়ার দিকে। ঝুমরু এবং চলতি কা নাম গাড়ির মতো সিনেমায় মধুবালার সহ-অভিনেতা ছিলেন কিশোর।

আরও পড়ুন- “এই ছেলেকে দিয়ে আমি গান গাওয়াব,” বাথরুমে কিশোরের গলা শুনে বলেছিলেন শচীন কত্তা!

চলতি কা নাম গাড়ি এবং হাফ টিকিটের শুটিংয়ের সময় মধুবালার সঙ্গে কিশোর কুমারের দেখা। কিশোরের সঙ্গে ততদিনে তাঁর প্রথম স্ত্রী রুমা গুহ ঠাকুরতার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। শোনা যায়, মধুবালার বাবা-মায়ের জন্য কিশোর কুমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন করিম আবদুল। তবে মধুবালাকে কিশোর কুমারের পরিবারে কখনই গ্রহণ করেনি। পরিবারের অশান্তি মধুবালার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। শোনা যায়, কিশোর ১৯৬০ সালে মধুবালাকে তাঁর অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তাঁরা বিয়ে করে লন্ডন চলে যান। মধুবালার হার্টে একটি ছিদ্র (চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট) ধরা পড়ে। এই সমস্যায় মধুবালার শরীর অতিরিক্ত রক্ত তৈরি করত, যা তাঁর নাক এবং মুখ থেকে বেরিয়ে আসত। বিদেশে ডাক্তাররা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, মধুবালা গুরুতর অসুস্থ। খুব বেশি হলে বছর দুয়েক বাঁচবেন এই মোহময়ী অভিনেত্রী।

ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে কিশোর ও মধুবালা আলাদা থাকতে শুরু করেন। পরিবার এই হিন্দু মুসলিমের বিয়ে মেনে নেয়নি কখনই। পরিবারের সঙ্গে বাড়ে দূরত্ব, অসুস্থতার কারণে ক্রমেই অস্থির হতে থাকেন মধুবালা, রেগে যেতে শুরু করেন। নয় বছরের বিয়েতে অসুস্থতা এসে বদলে দেয় রাস্তা। ১৯৬৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিশোর মধুবালা বিবাহিত ছিলেন ঠিকই, তবে তাঁদের মধ্যে প্রেমের ছিটেফোঁটাও ছিল না।

মধুবালার বোন মধুর এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন, "মধুবালা নিজেই বলেছিলেন কিশোর আর মধুবালার পথ আলাদা হয়ে যাওয়ার পরেও দিলীপের প্রেমে পাগল ছিলেন তিনি। আসলে, কিশোর যখন মধুবালাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন দিলীপ কুমারের উপর ব্যাপক ক্ষোভ আর রাগ থেকেই খানিক শিক্ষা দিতে কিশোরকে করে নেন মধুবালা। ১৯৬০ সালে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। মধুবালার বয়স তখন ২৭ বছর।"

আরও পড়ুন- ‘হামে কাশ তুমসে মোহব্বত…’, কেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল মধুবালা-দিলীপকুমারের প্রেম?

কিশোর সম্পর্কে বলতে গিয়ে মধুবালার বোন জানান, ডাক্তার জানিয়েই দিয়েছিলেন মধুবালা বেশিদিন বাঁচবেন না। কিশোর তাঁকে মুম্বইয়ের কার্টার রোডের একটি বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে একজন নার্স এবং একজন ড্রাইভার সহ মধুবালাকে একা ফেলে রেখে যান। প্রায় চার মাসে একবার মধুবালাকে দেখতে আসতেন। মধুবালার ফোন ধরতেন না। কিশোর মধুবালার প্রেমে পাগল ছিলেন ঠিকই কিন্তু লন্ডন থেকে ফিরে এসে মধুবালাকে অসুস্থতার মধ্যে ছেড়ে চলে যান। ভাল স্বামী ছিলেন না কিশোর। চিকিত্সকরা জানিয়েছিলেন মধুবালার সঙ্গে কোনও রকম যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা সন্তান গ্রহণ করতে পারবেন না কিশোর। তবুও এই অসুস্থতার সময় মানসিক সমর্থন প্রয়োজন ছিল মধুবালার। কিশোর কখনও দুর্ব্যবহার করেননি মধুবালার সঙ্গে, চিকিৎসার খরচ বহন করেছেন। কিন্তু পাশে থাকেননি মধুবালার।

নয় বছর ধরে বিছানাতেই পড়েছিলেন মধুবালা, সমস্ত লাবণ্য, মোহ ছেড়ে চলে গিয়েছিল অভিনেত্রীকে। শুধু ছিল বাঁচার আকাঙ্খা, তীব্র আকুতি। শেষ দিকে কাঁদতেন, কাঁদতে কাঁদতে বলতেন, "মুঝে জিন্দা রেহনা হ্যায়, মুঝে মরনা নহিঁ হ্যায়, ডাক্তার কব ইলাজ নিকালেঙ্গে"।

 

More Articles