বাংলা সিনেমা: যেটুকু যা ছিল, আছে, থাকবে
Modern Bengali Cinema : অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা বা প্রযুক্তির সঙ্গে শিল্পের মেলবন্ধন অথবা 'ইজম' সংক্রান্ত চরিত্র বা টাইপ তৈরিতেও অগ্রগণ্য ছিলেন বাংলার পরিচালকরাই।
৬০-এর দশক শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন একটি সময়কাল যখন 'High art''-এর মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গেছে। ইতিহাসবিদ Eric Hobxbawn তাঁর Age of Extreme (১৯৯৪) নামের বইতে দেখিয়েছেন কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের নতুন সমাজে, যেমন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্য শিল্প দখল করেছে বিশ্বকে, তখনই High art যুগের সমাপ্তি ঘটে। তিনি Walter Benjamin-এর ভবিষ্যদ্বাণীকে মেনে নিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে টিভি ও চলচ্চিত্রের যুগে High art-এর মৃত্যু হয়েছে (Benjamin wrote the essay to produce a theory of art that is useful for the formulation of revolutionary demands in the politics of art in a mass-culture society)| চিত্রকলায় পিকাসোর কোলাজ, সাহিত্যে লাতিন আমেরিকার 'ম্যাজিক রিয়ালিজম' ও 'বারবারিজম' চলচ্চিত্রে নবতরঙ্গ বা গোদারের বিশ্বজয় প্রমাণ করে ৬০-এর দশক হলো নতুন শিল্পের যুগ যা বুর্জোয়া High art-এর সমাপ্তি ঘোষণা করে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সামাজিক উৎস হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সমাপতন (coincidence) ও মেলোড্রামার (Melodrama) আঙ্গিকগত প্রাসঙ্গিকতা।
মনে রাখা দরকার, ভারতে চলচ্চিত্র এসেছিল ব্যবসার উদ্দেশ্যে, একইসঙ্গে ভারতে বসবাসকারী ইউরোপিয় ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতীয় এলিটরাও যাতে এই চলমান ছায়াচিত্রের ভোক্তা হয়ে ওঠে সেই কারণে। কিন্তু এই অভিনব মাধ্যমটি অচিরেই ভারতীয় হয়ে উঠল তার কারণ উনিশ শতকীয় পূঁজিভবন। এই সময়ের উপন্যাস - নাটক - ছোটগল্পের একত্রীকরণ ভারতীয় বাস্তবের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে। ঔপনিবেশিক কাঠামোয় তা আরও জোরদার হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন, দাঙ্গা প্রভৃতির ফলে সিভিল সোসাইটির ভাঙন ছিল অনিবার্য আর তারই গর্ভপাত নতুন মধ্য শ্রেণি বা নতুন এলিট স্তর যা মূলত ব্রিটিশদের সহযোগী হিসাবে কাজ করেছিল। ফলে পরিবর্তন এবং নতুনকে গ্রহণ করার সহজাত মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যার মধ্য দিয়ে সিনেমা বা চলচ্চিত্র রেলগাড়ি বা উড়োজাহাজের মতোই নতুন উদ্ভাবনী শক্তির গণমাধ্যম হিসাবে ঢুকে পড়ল ঔপনিবেশিক আধুনিকতার কেন্দ্রভূমি কলকাতাতে।
সুধী পাঠক, মনে রাখুন ১৯৩০ সাল অবধি ভারতীয় চলচ্চিত্র ছিল নির্বাক। মূলত পুরাণ-ইতিহাস এবং কাল্পনিক কাহিনির চলচ্চিত্রায়ন। যদিও তার আগে থেকেই বিভিন্ন শিল্প শাখার প্রবণতাতেই থাকছিল নতুন কিছু হয়ে ওঠার ছাপ। ছবি, থিয়েটার, গান, সর্বোপরি চিত্রশিল্পের নতুন অভিব্যাক্তি যা পরবর্তীকালে রবি বর্মার হাত ধরে ফালকের পৌরাণিক চরিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সিনেমায় প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভারতে চলচ্চিত্রের আমদানিতে ভারতীয়ত্ব না থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই এই মাধ্যমটি ভারতের বস্তুগত সত্যের সঙ্গে মিশে দ্রুত ভারতীয় হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন- সত্যজিৎ, ঋত্বিক নন; মধ্যবিত্ত সমাজকে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন মৃণাল সেনই!
বস্তুত ১৯ শতকে বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্র ছিল শহর কলকাতা এবং ইংরেজি শিক্ষা ও হিন্দু কলেজীয় যুক্তিবাদী বিতর্কের পরিবেশ। সুশোভন সরকার লিখেছেন, যুক্তি সম্মত মানসিকতা, যে কোনও বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার এবং পুরনো প্রথা বর্জন করার একটা মেজাজ গড়ে উঠছিল নব্য শিক্ষার ফল হিসেবে (বাংলার রেনেসাঁস দীপায়ন)। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই সময় নৈতিক মূল্যবোধের জগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পারিবারিক সম্পর্ক বা শাস্ত্রের বিধান মানা থেকে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও রোমান্টিক চিন্তাধারা প্রসূত মূল্যবোধ প্রধান হয়ে ওঠে।
'বাংলার রেনেসাঁ যে উদার মানবতাবাদের জন্ম দিয়েছিল তার ফলে বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বঙ্কিম পাশ্চাত্য বাস্তববাদী শৈলীতে সাহিত্য রচনা করলেও তার সাহিত্যের চরিত্রগুলো ছিল রাজপুত্র, ধনী, জমিদার। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসেও অভিজাত শ্রেণির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রোত্তর যুগের উপন্যাসে উদার মানবতাবাদের সবচেয়ে সফল নিদর্শন দেখা যায়। তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের চরিত্রগুলি শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, গ্রাম্য বাঙালি, তুলনায় সাধারণ মানুষ। বিশেষত বাংলার রেনেসাঁ যে সমাজ পরিবর্তনের 'transition'-এর মধ্যে দিয়ে যায় তারাশঙ্করের উপন্যাস ও গল্পগুলো তার ঐতিহাসিক উপাদান দ্বারাই গঠিত হয়। সমাজতন্ত্র থেকে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। জলসাঘর বা গণদেবতায় তা স্পষ্ট। যদিও মার্ক্সবাদী সমালোচকরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল তাকে রেনেসাঁ শব্দে অভিহিত করতে চায়নি কারণ এটা কেবলমাত্র মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজের শ্রেণি গঠনের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি, ইউরোপিয় রেনেসাঁ সমাজতন্ত্রকে সরিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ধনতন্ত্র। বাংলার রেনেসাঁকে মার্ক্সবাদীদের অসমর্থন করার অন্যতম একটা কারণ হিন্দুত্বের কুসংস্কারগুলি। এছাড়াও যেসমস্ত সাধারণ মানুষ এই বিধবা বিবাহ বা সতীদাহ প্রথার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তাদের কাছে এই সমাজ সংস্কারের আন্দোলনগুলি মূল্যহীন ছিল। যদিও এই ধারণা আলোচনা সাপেক্ষ তথাপি সত্যজিতের ১৯৮১ সালে প্রেমচাঁদের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবি সদগতি দেখায় কীভাবে হিন্দু সমাজের একদম নিম্নবর্গও হিন্দুত্বের সামাজিক নিয়মকানুন মানতে বাধ্য ছিলেন। সংস্কারবাদীদের আন্দোলন সনাতন হিন্দু সংস্কারগুলির বিরুদ্ধাচরণ করেছিল এবং কঠোর জাতিপ্রথার দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সামনের দিকে তাকাতে সাহায্য করেছিল। এমনকী একটা যুক্তিবাদী নেতৃত্ব আন্দোলনকে মুক্তির পথ দেখাতেও সাহায্য করেছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে সামান্য ব্রিটিশ পদবি ধারণের গর্বে গর্বিত উচ্চমধ্যবিত্ত ইন্দ্রনাথ চৌধুরী এমনই একটি উদাহরণ যেখানে তাকে মুখোমুখি হতে হয় নতুন প্রজন্মের এক প্রতিনিধির সঙ্গে এবং তার সমস্ত গর্ব মূল্যহীন হয়ে যায়।
অথচ অপুর ট্রিলজি যে মানবতাবাদী 'national allegory' রচনা করে তাঁর ছবিতে সেই অগ্রগতি ও আদর্শবাদের ফাটল ধরে ৬০-এর দশকের শেষ থেকে। যে পথের অ্যানার্কির শুরু অরণ্যের দিনরাত্রিতে।
আর ঋত্বিকের স্মৃতির পথ ধরে এগোলে আমরা বলতে পারি, মানুষ জীবনে বহুবার রামায়ণ, রামচরিত মানসের কাব্য বা মহাকাব্য কাহিনি পড়েছে। মানুষ কেন বারবার ওই একই বই পড়ে? শুধু গল্পের টানে নয় নিশ্চয়ই। তাহলে বলতে হয়, শুধু গল্প নয়, আরও বাড়তি কিছু যা মনের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়, ঘটনার রেশ থেকে যায় অনেককাল। এই কারণেই কথিত মিথ আর ইয়ুং কথিত আর্কিটাইপের আকর্ষণে মহাকাব্য, লোককথা পঠিত হয় বারবার। তাই Epic Coincidence আর দুর্বল Melodrama-কেই ঋত্বিক তাঁর বক্তব্য প্রকাশের হাতিয়ার করেন। যখন তিনি দাঙ্গা ও দেশভাগের কাহিনিকে melodrama ও coincidence-সহ প্রকাশ করেছিলেন তখন তা ফিল্মের সময়কালের সঙ্গে ইতিহাসের সময়কালকে মিলিয়ে দেয়। যে ঘটনা তাঁর ছবির মূল বিষয় তা স্বাভাবিকভাবেই coincidence-কে ডেকে আনে। দেশভাগের পর যে ছিন্নমূল মানুষের স্রোত এদেশে পৌঁছয় তাদের জীবনে coincidence ও melodrama ছাড়া কীই বা হতে পারে!
যে মানুষ অকস্মাৎ তার প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছে সে মানুষ ততোধিক বিস্ময়ের সঙ্গে কোথাও হঠাৎই আবিষ্কার করেছে প্রিয়জনের মুখ। দেশভাগের পরের সময়ের ইতিহাসটাই coincidence-এর ইতিহাস। যিনি দেশভাগের আগে ছিলেন স্কুল মাস্টার তিনি মাত্র কয়েকদিন পরেই পরিণত হয়েছিলেন ঠিকা শ্রমিকে। মধ্যবিত্ত জীবনের গণ্ডি থেকে অদ্ভুতভাবে খসে পড়েছেন নিম্নবিত্ত বা অতি নিম্নবিত্তের রুক্ষ বাস্তবের নগরজীবনে। এর পিছনে কোনও রিয়ালিজম বা যুক্তির পারম্পার্য্য নেই। যা আছে তা হলো ভ্রান্ত রাজনীতির ফলে উৎপন্ন সমাপতনের ঘটনা; অর্থাৎ এ কাহিনিতে ঋত্বিক ইতিহাসকে মেলোড্রামায় পরিণত করেননি বরং ইতিহাস নিজেই ছিল মেলোড্রামা ও সমাপতনের কাহিনি।
ঋত্বিকের এই ফর্ম কিন্তু একেবারে নতুন বা অস্বাভাবিক নয়। যুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দেশভাগ ও দাঙ্গার প্রভাবে সব সময়েই সাধারণ মানুষের জীবন সমাপতনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যাঁদের মনে হয় বোনের ঘরে ভাইয়ের ঢুকে পড়া অস্বাভাবিক ঘটনা, তারা কেউই লক্ষ্য করেন না যে, 'Germany Year Zero' তে বাচ্চা ছেলেটার বাবাকে খুন করা আসলে আশ্চর্য সমাপতন ছাড়া আর কিছুই নয়। অথবা বাইসাইকেল থিভস-এর ঘটনা প্রবাহ কেবলমাত্র একটা ঘটনার সঙ্গে নয়া ঘটনার সমাপাতনিক প্রবাহ ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং, ঋত্বিকের এই ফর্ম আগেও বিশেষভাবে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন- গিলে খেয়েছিল দেবদাসের চরিত্র, কেন মনোবিদের কাছে ছুটতে হয়েছিল দিলীপ কুমারকে?
উগেৎসু মনোগাতারি দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে, অভিরাম ও সীতা বা ঈশ্বর হরপ্রসাদের জীবনের মতোই গেনজুয়া, মিয়াগি বা তোবেই যে বেশ্যালয়ে যায় সেখানেই দেখা পায় তার ভুলে যাওয়া স্ত্রী ওসামার। যেমন ঈশ্বর যে ঘরে প্রবেশ করে সেটাই সীতার ঘর। ঋত্বিক বা মিজোগুচি কেউই গল্পের মদ পরিবেশন করতে চান না বরং ডিসকোর্সের জন্ম দিতে চান। যুদ্ধ যেমন করে সমাপতন ডেকে আনে তার কথা বলেন মিজোগুচি। দেশভাগ কীভাবে সমাপতনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে একটা গোটা জাতীয় জীবনকে, সুবর্ণরেখায় ঋত্বিক সেকথাই বলার চেষ্টা করেছেন। ফলে সুবর্ণরেখার চরিত্রগুলো কেবল ব্যক্তি চরিত্র নয় তার চেয়েও বেশি ট্রান্স ইন্ডিভিজুয়াল আর্কিটাইপ হয়ে ওঠে।
স্বাভাবিকভাবেই ছয়ের দশকের বাংলা ছবিগুলিতে দেখা গেল এক অন্তর্মুখী চেতনার বহিঃপ্রকাশ; প্রতিবাদ, প্রতিরোধ মানসিকতা। বঙ্গভঙ্গের নির্লজ্জতা, তেভাগার ব্যর্থতা এবং স্বাধীনতা সংক্রান্ত আশাভঙ্গের হতাশায় নিমজ্জিত একটি জাতির পরিণতিতে যে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে সে সম্পর্কে শিল্পীরা মোটেই সন্দিহান ছিলেন না বরং তাঁরা তাদের শিল্প মাধ্যমকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে। ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল তো বটেই মূলধারার বাংলা ছবির ক্ষেত্রেও তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, পার্থ প্রতিম চৌধুরী, পূর্ণেন্দু পত্রীরাও পিছিয়ে থাকলেন না।
রাষ্ট্রের নীতিভ্রষ্টতা, শমন দমনের নারকীয়তা, যুবশক্তির নিদারুণ অপচয় সেই সময় যেভাবে বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পর্দায় উঠে এসেছিল তার তুলনায় সব ভারতীয় ছবিগুলির (মূলধারাই হোক কিংবা সমান্তরাল) অবদান নিতান্তই হাতেগোনা। শুধু তাই নয় অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা বা প্রযুক্তির সঙ্গে শিল্পের মেলবন্ধন অথবা 'ইজম' সংক্রান্ত চরিত্র বা টাইপ তৈরিতেও অগ্রগণ্য ছিলেন বাংলার পরিচালকরাই। "Film as a text" - এ পথ তো তারাই দেখান। একটা ছবি কীভাবে ভালো ছবি হয়ে উঠেছে, তার কনটেন্টের সঙ্গে কনটেস্টের মেলবন্ধন বহুস্তরীয় মানে তৈরি করতে পারছে কিনা এবং যা দেখে সাধারণ দর্শক তাদের মননে চিন্তনে বিচলিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে তাদেরও একটা প্রতি বক্তব্য বা বার্তার পরিসর কীভাবে সমগ্র শিল্পের মধ্যে ত্বরান্বিত হচ্ছে তার পরীক্ষামূলক প্রেক্ষাপটের বড় অংশটাই গড়ে তোলেন বাংলার পরিচালকরা।
এখন প্রশ্ন হলো, সত্তর পরবর্তী বা আশির দশকে ('পদাতিক' পরবর্তী কালে) বাংলা ছবি কি তার কৌলিন্য হারিয়ে ফেলল নাকি বহুস্তরীয় বার্তা বহতায় ইঙ্গিতবাহী হয়ে উঠতে পারল না। বিষয়টি কিন্তু একেবারেই তা নয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষেরা তাদের বেশ কিছু ছবিতে ব্যতিক্রমী অবদান রেখে গেলেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের 'নিম অন্নপূর্ণা' কিংবা 'তাহাদের কথা' যেমন রাজনৈতিক সংকটের কথা বলে তেমনই মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক জীবনের বিন্যাসের দিকনির্দেশও করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, 'দূরত্ব' ছবিটি দেখে ইতালির বিখ্যাত চিত্রসমালোচক Gian Ronadi বলেছিলেন, "It is a memorable film with brilliant patches and reminds us of the Rossellini, Godard and Roy"- ফিল্ম ভালো নাকি 'ঘটিয়া ' সেটা এই মন্তব্য থেকেই বিবেচ্য। ঋতুপর্ণ ঘোষের একাধিক ছবি বিশেষত 'বাড়িওয়ালী'র একটি বিশেষ দৃশ্যে মনসামঙ্গলের ব্যবহার আজও আমাদের কানকে তৃপ্ত করে। 'থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন' এবং 'পরমা' এই দু'টি ছবি যথেষ্ট ছিল অপর্ণা সেনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। স্টোনহ্যামের চরম নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের অমোঘ সুযোগ নেয় সমরেশ ও নন্দিতার সঙ্গ লিপ্সা। আঘাত পান স্টোনহ্যাম। সমরেশ-নন্দিতার জীবনে তিনি অবাঞ্ছিত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। সমরেশের মনের কোণে ন্যূনতম স্থানও জোটে না স্টোনহ্যামের। জনমানবহীন শীতের রাত্রে একাকী ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান স্টোনহ্যাম। এক হৃদয়স্পর্শী হাহাকার যেন ওই শীতের তীব্রতাকেও হার মানায়। আর পরমা তো ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্বকেই সজোরে আছাড় মারে মধ্যবিত্তের সদর দরজায়।
আরও পড়ুন- সর্বজয়া নয়, আসলে ইন্দির ঠাকরুনেরই সন্তান দুর্গা…
ঋতুপর্ণ ঘোষের ১৯ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তৈরি করা ১৯ টি ছবির মধ্যে ১২টি ছবিই পুরস্কারপ্রাপ্ত। মধ্যবিত্ত জীবনের আশা-আকাঙ্খার সঙ্গে তিনি মিশিয়ে দেন নারী মনের অন্তর্যন্ত্রণা। সম্পর্কের সংবেদনশীলতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা বা অন্বেষণ করার মধ্যে দিয়েই তিনি সমাজকে মন্থন করে গেছেন। 'উনিশে এপ্রিল', 'দহন' কিংবা 'বাড়িওয়ালী' তো বটেই এমনকী 'নৌকাডুবি' বা 'চিত্রাঙ্গদা' ছবিগুলি তৈরির মধ্যে দিয়েও তিনি তার রবীন্দ্রবীক্ষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। রবীন্দ্র উপন্যাসগুলির ছবিতে রূপান্তরিতকরণ বা অ্যাডাপটেশনকে মানবিক সম্পর্ক ও প্রেম, সর্বোপরি বিবেকের বাসনায় সম্পূর্ণ অন্যস্তরে উন্নীত করেন পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের চিন্তা চেতনার পালাবদলে এবং সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের স্বকীয় ভাষা প্রকরণে যে সাহসিকতা তিনি দেখান তা বিশেষ বিরল।
উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর 'ময়না তদন্ত' এবং 'চোখ' ছবি দু'টি বাংলা সিনেমার আশির দশককে সমৃদ্ধ করে। আদিবাসী মানুষ ও তাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন যন্ত্রণার ছবি পর্দায় এঁকে দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভিতর থেকেই যেন তৈরি হয় নতুন সংস্কৃতি আর যার উৎস হলো এইসব মানুষগুলি। পরবর্তীকালে তার তৈরি 'চোখ' ছবিটিতে পরিচালকের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে প্রচলিত মূল্যবোধের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। গণচেতনায় ও গণ আন্দোলনের চাহিদার তাগিদেই প্রয়োজন হয়ে পড়ল রাষ্ট্রশরীরের পচনশীল অংশে কুঠারাঘাত করা। আই ব্যাঙ্কে জমা পড়া একটি 'চোখ' কে পাবে? একজন শ্রমিক নাকি কারখানা মালিকের ছেলে? শিল্পপতি জেটিয়া তাই তার লোকদল নিয়ে ডাক্তার মন্ত্রী থেকে রাইটার্স সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় ওই চোখ পাওয়ার জন্য। অন্যদিকে, শ্রমিক ছেদিলালের কোথাও ঘুরে বেড়াবার সাধ্য নেই। অথচ ছবির শুরুতে দেখলাম জেলখানার অন্ধকারে বসে এক শ্রমিক তারই শ্রেণির মজুরের জন্য চোখ দান করে যাচ্ছে। এই শ্রেণিবন্ধুদের প্রতি সহমর্মিতাকে এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেয় লজ্জাহীন, মিথ্যেবাদী শিল্পপতিদের দল। ভাড়া করা গুন্ডা দিয়ে নির্জন প্রান্তরে শ্রমিকদের খুন করে মৃতদেহের উপর ছড়িয়ে দেয় নকশালদের পোস্টার। বারবার ক্লোজআপ ব্যবহারের সুপরিকল্পিত চিন্তায় 'চোখ' হয়ে ওঠে আরও বাঙ্ময়। আর অন্যদিকে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি যাদের অবস্থান ছেদিলাল ও জেটিয়ার মাঝে, তাদের শরীর নিষিক্ত বুর্জোয়া গন্ধকেও উন্মুক্ত করে দেন পরিচালক। শ্রমিক, মজুর, সর্বহারা যাদের সবচেয়ে বিশ্বাস করে তারা হলো এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অথচ এই শ্রেণিই আজ আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং সুবিধাবাদী। সহজেই তাদের কিনে ফেলতে পারে জেটিয়ারা। তাই ডক্টর মুখার্জি ছাড়া বাকিরা সহজেই বিক্রি হয়ে যায় জেটিয়াদের কাছে। মধ্যবিত্তের নৈতিকতা বা মূল্যবোধের মৃতদেহের উপর যেন পতপত করে উড়তে থাকে ওই নকশালি ঝান্ডা।
সামাজিক বিপ্লবের তাৎপর্যে থেকে যায় আত্মপ্রবঞ্চনা। 'কাজের ছেলে' 'পালান'- এর অবস্থান তাই শোষণ নিরপেক্ষ থাকে না। মধ্যবিত্ত, ভদ্র, শিক্ষিত, গৃহস্বামী যতই বলুক না কেন, ' ও আমাদের বাড়ির লোকের মতোই ছিল', ততই তা এই শ্রেণি-মূল্যবোধের নিস্পৃহতাকেই জোরদার করে। সত্যিই মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে যেন মনোক্সাইডের বিষ বাষ্প ঢুকে পড়ে। 'খারিজ' হয়ে যায় সমাজসত্যের তত্ত্বগুলি। পড়ে থাকে শুধু 'পালানে'র নিথর দেহ।
কোথায় যেন পড়লাম, মার্কিন অনুগামী ইজরায়েলের সেনারা নাকি গাজা থেকে কবি মোসাবকে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে উলঙ্গ করে পিটিয়েছে। মোসাব কবিতা লিখেছিলেন...