হিন্দি ছাড়া সবেতে ফেল! যেভাবে আইপিএস হয়েছিলেন বাস্তবের টুয়েলভথ ফেল মনোজ শর্মা

12th Fail Manoj Sharma : টাকা জোটাতে টেম্পো চালিয়েছেন। ধনী পরিবারের কুকুরদের হাঁটাতে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছেন, লাইব্রেরিতে পিওন হিসেবেও কাজ করেছেন।

সব চরিত্র কাল্পনিক নয়। পর্দায় বা বইয়ের পাতায় পাওয়া কোনও চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কোনও চরিত্রের মিল থাকা নেহাতই কাকতালীয় নয়। আসলে যে চরিত্ররা ঘুরে বেড়ায় চারপাশে, তাঁদের সঙ্গে সিনেমার চরিত্রের, সাহিত্যের চরিত্রের তুমুল মিল পাওয়াই তো স্বাভাবিক। বাসববর্জিত ঘটনাকে আরও বিপুলভাবে পর্দায় তুলে আনলে তখন হয়তো অচেনা লাগে, অথচ সেই চরিত্রের শিকড় বাস্তবের কাঁটা-পাথর ভরা পথেই। ২০২৩ সালের সেরা সিনেমা বলতে গেলে অনেকেই অনেক সিনেমার কথা বলবেন, বক্স অফিস কাঁপানো জওয়ান-পাঠান থেকে শুরু করে ওটিটিতে আসা বহু সিনেমার কথা উঠবে। কিন্তু ২০২৩ সালের সবচেয়ে নজরকাড়া সিনেমা 12th Fail। বিধু বিনোদ চোপড়ার পরিচালনায় বিক্রান্ত মাসি অভিনীত সিনেমাটি এখন মানুষজন দেখছেন ওটিটি-তে। অথচ গত ২৭ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহেই মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটি। তখন তা নজরেও আসেনি কারও। অনুরাগ পাঠকের ২০১৯ সালের এক উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই সিনেমা সারা বিশ্বব্যাপী দর্শকদের, সমালোচকের প্রশংসা পেয়েছে। ২০ কোটি টাকার বাজেটে নির্মিত 12th Fail, বক্স অফিসে প্রায় ৭০ কোটির আয়ও করেছে। আর এই সিনেমার চরিত্র কাল্পনিক নয় মোটেও! বাস্তবের আইপিএস অফিসার মনোজ শর্মাই এই সিনেমাতে অভিনীত বিক্রান্ত মাসির চরিত্রের মূল আকর।

12th Fail সিনেমাটি আইপিএস অফিসার মনোজ শর্মার জীবনের সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করেই তৈরি। দ্বাদশ শ্রেণিতে হিন্দি ছাড়া সমস্ত বিষয়ে ফেল করেছিলেন মনোজ কিন্তু ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন তাতে ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়নি। টাকা-পয়সা ছিল না, স্বপ্ন ছিল প্রবল। মনোজ শর্মা নিজের টিউশনের টাকা জোগাড় করতে টেম্পো চালানোর কাজ করেছেন। ধনী পরিবারের পোষ্য কুকুরদের হাঁটাতে নিয়ে যাওয়ার কাজও করেছেন। লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল, পাখির চোখ আইপিএস অফিসার হওয়া।

আরও পড়ুন- “বারবার ব্যর্থ হয়েছি” : কোন ম্যাজিকে UPSC উত্তীর্ণ হলেন বাংলার ঋষভ সিং?

বিক্রান্ত মাসি তুখোড় অভিনেতা সন্দেহ নেই। মনোজ শর্মার চরিত্রকে পর্দায় আনার কাজটি করেছেন তিনি চূড়ান্ত সততায়। বিক্রান্ত নিজেও বলছেন, এই সিনেমা আসলে সেই অজস্র সাধারণ মানুষের কথা বলে যারা কষ্ট পেয়েছেন, লড়েছেন। চলচ্চিত্র সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন বিক্রান্ত। কিন্তু তিনি বলছেন, সিনেমার নায়ক আসলে মনোজ শর্মাই। সমস্ত কৃতিত্ব তাঁর। ডিজনি + হটস্টারে দেখা যাচ্ছে 12th Fail। মনোজ শর্মার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিক্রান্ত মাসি এবং মেধা শঙ্কর তাঁর স্ত্রী আইআরএস শ্রদ্ধা জোশীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

মনোজ শর্মার লড়াই ছিল তীব্র। জন্ম তাঁর ১৯৭৭ সালে মধ্যপ্রদেশের মোরেনা জেলার একটি ছোট গ্রাম বিলগাঁওতে। বাবা কাজ করতেন কৃষি বিভাগে। টাকা পয়সা ছিল না একেবারেই। নবম আর দশম শ্রেণিতেও পরীক্ষার রেজাল্ট খুবই খারাপ হয়েছিল তাঁর। কোনওভাবে থার্ড ডিভিশনে উৎরে যান তিনি। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় দ্বাদশ শ্রেণিতে! দেখা যায় একমাত্র হিন্দি ছাড়া বাকি সমস্ত বিষয়েই ফেল করেছেন মনোজ। অথচ তাঁর স্বপ্ন ভারতের সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা UPSC! ইউপিএসসি পরীক্ষায় বসা, পরীক্ষায় পাস করে আইপিএস হওয়ার স্বপ্ন কীভাবে দেখতে পারে একজন পড়ুয়া যে নিজে উচ্চমাধ্যমিক ফেল? স্বপ্নকে মরে যেতে দেননি মনোজ। প্রবল উদ্যমে লেগে পড়েন। পরবর্তী চেষ্টায় দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা পাশ করেন। তারপরে আরও বড় কিছুর প্রস্তুতি শুরু করেন।

জীবনের এই মুহূর্তে বিচিত্র সব কাজ করেছিলেন মনোজ। পরের বেশ কয়েক বছর UPSC পরীক্ষার প্রস্তুতি ছাড়া অন্য কিছু নিয়েই ভাবেননি তিনি। মনোজ শর্মার এই লড়াই আর ১২ ক্লাস পাস না করতে পারার গ্লানির মধ্যে দিয়ে চরম আশাবাদের যে গল্পটি বিধু বিনোদ বুনেছেন তা এই দেশের হাজার হাজার পরীক্ষার্থীদের এক আবেগ। প্রতি বছর এই কঠিন যাত্রা শুরুর আগে, শেষে যারা ভেঙে পড়েন, যারা মুষড়ে পড়েন অথবা হাল ছেড়ে দেন, তাঁদের সবার জন্য 12th Fail আসলে এক বাস্তব রূপকথা। মনোজ শর্মার এই প্রস্তুতির কন্য টিউশন ফি দেওয়ারও সামর্থ ছিল না। টাকা জোটাতে টেম্পো চালিয়েছেন। ধনী পরিবারের কুকুরদের হাঁটাতে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছেন, একটি লাইব্রেরিতে পিওন হিসেবেও কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে পড়াশোনা করতে করতেই মনোজ শর্মা ম্যাক্সিম গোর্কি, আব্রাহাম লিংকন এবং মুক্তিবোধের সম্পর্কে জানেন। জীবন এবং তাঁর উদ্দেশ্যকে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন মনোজ।

আরও পড়ুন- নকশি কাঁথার ভারতজয়, বাংলার মেয়েদের কাছে অনুপ্রেরণার আরেক নাম ‘পদ্মশ্রী’ প্রীতিকণা

সমস্ত প্রস্তুতি এবং কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও প্রথম চেষ্টাতেই UPSC পরীক্ষায় ব্যর্থ হন মনোজ। পরের দুইবারও শিকে ছেঁড়েনি। কিন্তু মনোজ ভেঙে পড়ার মানুষ ছিলেন না কখনই। দৃঢ়চেতা মনোজ নিজের লক্ষ্য জানতেন। অবশেষে চতুর্থ চেষ্টায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মনোজ। সর্বভারতীয় স্তরে ১২১ র‍্যাঙ্ক ছিল তাঁর। ২০০৫ সালে মহারাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেন তিনি। বর্তমানে মুম্বইতেই পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

অনুরাগ পাঠকের বই এবং এই সিনেমা দু'টিতেই মনোজ শর্মা এবং তাঁর স্ত্রী শ্রদ্ধা যোশীর মধ্যেকার প্রেমের নিবিড় এক অংশ রয়েছে। দিল্লির মুখার্জি নগরের একটি UPSC কোচিং সেন্টারে তাঁদের দেখা হয় প্রথম। ওই ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষকই মনোজকে শ্রদ্ধাকে মনোজের সঙ্গে দেখা করার কথা বলেন। মনোজ শর্মা পরে জানিয়েছিলেন, সেই দিনই তিনি কোথাও একটা অনুভব করেছিলেন যে শ্রদ্ধার প্রতি তাঁর বিশেষ এক অনুভূতি আছে। শ্রদ্ধার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস জয় করেন। আর সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম। কিছুদিনের মধ্যেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা।

শ্রদ্ধা ছিলেন মনোজের জীবনের ধ্রুবতারা। মনোজের লেখার দক্ষতা তৈরি করেছিলেন তিনিই। বন্ধু মনোজের জন্য নোটসও তৈরি করে দিতেন তিনি। নিজেও বিবিধ কাজ করেছেন শ্রদ্ধা। মহিলা আর্থিক বিকাশ মহামণ্ডলের (MAVIM) নেতৃত্বে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৫ সালেই নৈনিতালের ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন শ্রদ্ধা। ২০০৭ সালে ভারতীয় রাজস্ব পরিষেবায় (IRS) যোগদান করেন তিনি।

More Articles