কাঞ্চন-শ্রীময়ীর বিয়ে: নিষিদ্ধ প্রেস-নিরাপত্তারক্ষী-ড্রাইভার! কে দিল অপমানের অধিকার?

Kanchan Mullick Sreemoyee Chattoraj Wedding: অভিনেতা-বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক কেন এই তিন বিশেষ শ্রেণিকে বিয়ের উদযাপন থেকে দূরে রাখলেন?

একটা সময় 'ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস আর নট অ্যালাউড' লেখা বোর্ড লাগানো থাকত ব্রিটিশদের বিভিন্ন কর্মস্থল, আবাস বা প্রমোদস্থলের বাইরে। 'ইতর' শ্রেণিকে বাইরে রাখার সেই অভ্যাস যে বাঙালিও মজ্জাগত করে ফেলেছে তার প্রমাণ আজও মেলে বিভিন্ন বহুতল আবাসনের বাইরের দরজায়। বড় বড় করে সেখানে লেখা থাকে 'সেলসম্যানের প্রবেশ নিষেধ'। শ্রমিক ও মালিক দুই তরফেরই যুক্তি আছে। কে কার বাড়িতে কাকে ঢুকতে দেবেন তা নিজেদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু তা প্রদর্শন করে ঘোষণা করার মধ্যে যে উন্নাসিকতা ও ঔদ্ধত্য রয়েছে সেখানেই দ্বন্দ্ব। বিশেষ করে তা যখন একজন জনপ্রতিনিধি করেন, প্রশ্ন ওঠে বৈকি! কাঞ্চন মল্লিক তা করেছেন। একজন অভিনেতা পরিচয়ের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে গেলে চলবে না। কাঞ্চন মল্লিক তৃণমূলের বিধায়ক, উত্তরপাড়া আসনে মানুষের ভোটে জিতেছেন তিনি। সম্প্রতি দ্বিতীয় বিয়ে করায় সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ব্যাপক চর্চা তাঁকে আর তাঁর স্ত্রী শ্রীময়ীকে ঘিরে। এমন অবস্থায় বিয়ের রিসেপশন পার্টি সেরেছেন তিনি। আর নিমন্ত্রণ স্থলের দোরগোড়ায় বড় বড় করে লিখে দিয়েছেন "প্রেস, পার্সোনাল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ড্রাইভারস আর নট অ্যালাউড।"

অভিনেতা-বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক কেন এই তিন বিশেষ শ্রেণিকে বিয়ের উদযাপন থেকে দূরে রাখলেন? প্রথমত তিনি নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ে করছেন, তা উদযাপন করছেন। সেখানে তিনি কাকে ডাকবেন, কাকে ডাকবেন না, কী খাওয়াবেন সমস্তই তাঁর সিদ্ধান্ত। কিন্তু দরজায় তা বড় বড় করে লিখে 'অনুপ্রবেশকারী' তাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাঞ্চন তাকে অভদ্রতাই বলা চলে একমাত্র। বিনোদন জগত আর প্রেস অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। দুই তরফই দুই তরফের কাজের সঙ্গী, প্রচারের মাধ্যম। মাঝে মাঝে প্রচারমাধ্যম অভিনেতা-শিল্পীদের চটিয়ে দেয়, আবার অভিনেতা-শিল্পীরাও হামেশাই বিনোদনের প্রচারার্থে, নিজের প্রচারার্থে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করেন। অম্ল-মধুর এই সম্পর্ক একেবারেই জীবিকার নিরিখেই দেখা হয়। এর বাইরে যা কিছু, তা পেশার বাইরে। তাহলে সেই প্রেসকে এত অশ্রদ্ধা কেন? কাঞ্চন মল্লিক তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ সারেন জানুয়ারিতে। তারপর ১৪ ফেব্রুয়ারি রেজিস্ট্রি সারেন। ২ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন শ্রীময়ীর সঙ্গে। দ্বিতীয় বিয়ের ঘোষণার পর থেকেই একাধিক সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া এই খবরে উত্তাল হয়ে ওঠে। শ্রীময়ী কে, প্রাক্তন স্ত্রী কে, তিনি কাঁদছেন কিনা, শ্রীময়ী ও কাঞ্চনের বয়সের ফারাক কত থেকে শুরু করে সমস্ত সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ে খবর শুরু হয়।

আরও পড়ুন- শরীরে জটিল অসুখ, ভাগ্নির সঙ্গে বিয়ের ‘গুঞ্জন’, তবুও অমলিন ভারতের ‘ডান্সিং কিং’ প্রভু দেবা

শুধু খবর হলেও বা কথা ছিল! খবরের অন্দরে লুকিয়ে ছিল নানা রগড়। কাঞ্চন মল্লিকের শরীর, বয়স, বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা সহ নানা মিম, রিলস ছড়িয়ে পড়ে। নামী সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে অনন্ত ডিজিটাল মিডিয়া সমস্তকেই সপ্তাহব্যাপী ব্যবসা জুগিয়েছে কাঞ্চন শ্রীময়ীর বিয়ে। রিসেপশন থেকে তাই 'প্রেস' বিষয়টিকেই বাদ রাখতে চেয়েছেন কাঞ্চন ও শ্রীময়ী। চাইতেই পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল কি? কাঞ্চন নিজেও নানা সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। 'প্রেস' বলতে কি তিনি নিজের বন্ধুবৃত্তের বা ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদেরও এই অসম্মানটাই করতে চাইলেন?

ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীদের 'ব্যক্তি'কে নিরাপত্তা জোগানোর কাজটিই পেশা। সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঘোরেন না। যারা ঘোরেন তারা বিশেষ, তাই কাঞ্চন তাঁদের বিয়েতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। তাহলে নিরাপত্তারক্ষীদের বাইরে রেখে আসার কথা এভাবে দরজার বাইরে লিখে রাখতে হচ্ছে কেন? ড্রাইভারদের অবস্থানও বুঝিয়ে দিয়েছেন কাঞ্চন। বিয়েতে আমন্ত্রিতদের ড্রাইভাররা অকুস্থলে পৌঁছে দেবেন ঠিকই কিন্তু বিয়ের অন্দরে তাঁদের ঠাঁই নেই। সেলসম্যান, ড্রাইভার, নিরাপত্তারক্ষীদের কেউ নিজস্ব উদযাপনে সামিল নাও করতে পারেন। কিন্তু কাঞ্চন 'কেউ' নন। কাঞ্চন একজন অভিনেতা, জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থনে তাঁর কেরিয়ার তৈরি হয়েছে। তিনি একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধিও। মানুষের সঙ্গেই, আরও স্পষ্ট করে বললে সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ থাকার কথা। একজন নেতার জীবনের বিয়ের মতো কোনও উদযাপন এতটাও ব্যক্তিগত হতে পারে না যেখানে তিনি শ্রেণি বিভাজন করে দাগিয়ে দেবেন।

আরও পড়ুন- “আমি আপনার স্ত্রীকে বিয়ে করতে চাই” : নির্ভীক প্রেমিক জগজিৎ সিং রইলেন আড়ালেই

সোশ্যাল মিডিয়াতে এই নিয়ে তুলকালাম চলাকালীন অনেকেই বলছেন, একজন মানুষের বিয়ে, চেহারা, বয়স, স্ত্রী সমস্ত নিয়ে 'প্রেস' যা করেছে কয়েকদিন ধরে তাতে কাঞ্চন এই জবাব দিয়ে উচিত কাজই করেছেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষই প্রতিবাদ করছেন এই ঘটনার। তবে, এক বড় অংশের মানুষ এবং সাংবাদিকদের একাংশও বলছেন, এই প্রতিবাদ সোশ্যাল মিডিয়াতেই সীমিত রইবে। কারণ সংবাদমাধ্যমের পেট ভরাতে কাঞ্চন মল্লিকদের খবর হতে হবেই। কাঞ্চনরা এভাবে নিজেদের আর বাকিদের স্থান বুঝিয়ে দেবেনও মাঝে মাঝে। তাই যারা পোস্ট লিখে প্রতিবাদ করছেন, পেশার তাগিদেই তাঁদের আবারও কাঞ্চন-শ্রীময়ী বা এমন তারকে-অভিনেতা-শিল্পীদের দরকার পড়বেই। কাঞ্চনদেরও দরকার পড়বে সংবাদমাধ্যমকে। দুই তরফা এই প্রয়োজনের মাঝে "প্রেস, পার্সোনাল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ড্রাইভারস আর নট অ্যালাউড"-এর মতো অপমান হারিয়ে যাবে। 'প্রফেশনাল হ্যাজার্ড' আটকানোর নামে কাঞ্চন যা করেছেন তা কি সত্যিই ক্ষমা করে দেবেন সাংবাদিকরা? ক্ষমা করে দেবেন নিরাপত্তারক্ষী বা ড্রাইভাররা? ভোটের প্রয়োজনে যখন কাঞ্চনই হাত জোড় করে যাবেন রাজ্যের অলিগলিতে, তখন এই মানুষরা কি প্রশ্ন তুলবেন কেন কোন অধিকারে তাঁদের অপমান করলেন কাঞ্চন?

More Articles