হুব্বা তলপেটের বাঙালির কথা বলে : সম্পাদকের মুখোমুখি ব্রাত্য বসু

Bratya Basu Interview on Hubba : হুব্বা সিনেমাকে কি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করলেন ব্রাত্য? প্রোমোটার, সিন্ডিকেট, তোলাবাজির শুরুটা দেখাতে চাইলেন?

হুব্বা শ্যামল দাস। আম জনতার কাছে পরিচয় হুব্বা বলেই, পরিচয় গ্যাংস্টার বলেই। কিছুকাল আগেই মুক্তি পেয়েছে ব্রাত্য বসু পরিচালিত হুব্বা সিনেমাটি। এখানে হুব্বা অবশ্য শ্যামল নন, বিমল। এককালে হুগলি জেলা ও তার চারপাশ কাঁপানো গ্যাংস্টার ছিলেন হুব্বা। হুব্বার ত্রাস, হুব্বার রঙিন জীবন পর্দায় ধরেছেন ব্রাত্য, হুব্বার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশারফ করিম। ইনস্ক্রিপ্ট ও ব্রাত্যজনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক খোলামেলা আড্ডায় ধরা দিয়েছিলেন ব্রাত্য বসু, দীর্ঘক্ষণের আলোচনায় উঠে এসেছে তাঁর সাম্প্রতিকতম ছবি হুব্বার নেপথ্যের কাহিনি, হুব্বা নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির ভাবনার শিকড় সন্ধান করেছেন পরিচালক ব্রাত্য। সেই দীর্ঘ আড্ডাই ইনস্ক্রিপ্টের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হল লিখিত আকারে।

ইনস্ক্রিপ্টের প্রশ্ন ছিল, হুব্বা তৈরির ইতিহাস নিয়ে। ডন কর্নিয়েলির কথা স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের মনে পড়ে হুব্বা দেখতে গিয়ে। পাঠক ব্রাত্য বসু, দর্শক ব্রাত্য বসুই কি সিনেমা করিয়ে ব্রাত্য বসুকে দিয়ে হুব্বা করিয়ে নিল?

ব্রাত্য জানাচ্ছেন, গডফাদার তিনি পড়েছিলেন অনেক ছোটবেলাতেই। প্রায় ২০ বছর আগে একটা থিয়েটার করেছিলেন ব্রাত্য, পেজ ৪। সাংস্কৃতিক লোকেরা যে আসলে মাফিয়া, পেজ ৪ থিয়েটারের বিষয় ছিল সেটিই! ব্রাত্য বলছেন, মারিও পুজোর গডফাদার উপন্যাসে একটা বিশেষ জায়গা আছে, যেটা মূল গডফাদার সিনেমায় নেই। রামগোপাল ভার্মা তাঁর সরকার সিনেমায় ওই জায়গাটি উপন্যাস থেকে সরাসরি ফ্রেমে রাখেন। আমেরিগো বনাসেরা প্রথমেই ডনের কাছে এসে বলছেন, তাঁর মেয়েকে যারা অত্যাচার করেছে, হাসপাতালে পাঠিয়েছে ক্ষতবিক্ষত করে, ডন এর প্রতিবিধান করুন। ডন কর্নিয়েলি তখন তাঁকে খুবই তিরষ্কার করছেন, ডন বলছেন আসলে গুন্ডা বলেই বনাসেরা এড়িয়ে চলেছেন তাঁকে। আমেরিগো বনাসেরা তখন ডনকে টাকা অফার করতে যান। ডনকে টাকা! উপন্যাসে মারিও পুজো লিখছেন, বিভ্রান্ত বন্ধুকেও ক্ষমা করা যায়। দ্য গড ফাদারের মধ্যে অদ্ভুত কিছু জীবনদর্শন খুঁজে পান ব্রাত্য। কিছু কিছু চিত্রকল্প ভাবায় তাঁকে। মনে গেঁথে যায় সেই কথাটি, "বিভ্রান্ত বন্ধুকে ক্ষমা করা যায়।" সেই পাঠক, সেই দর্শক এবং সিনেমা দেখিয়ে ব্রাত্য- এই সবটা মিলেই তাই হুব্বা সিনেমার জন্ম হয়েছে বলে মনে করেন ব্রাত্য।

আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?

ব্রাত্য রাস্তা সিনেমাটি তৈরি করেন ২০০৩ সালে। সেই সিনেমার নেপথ্যেও কি তবে এই ডন-গ্যাংস্টার গল্পগুলির স্মৃতিপুঞ্জই কাজ করেছে? রাস্তা থেকে হুব্বার এই যাত্রাপথে কী কী শিখলেন পরিচালক ব্রাত্য বসু, কী কী বর্জন করলেন?

ব্রাত্য ইনস্ক্রিপ্টের সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, রাস্তাও এই স্মৃতির জায়গা থেকেই তৈরি। রাস্তা থেকে হুব্বা- এখনও অবধি ৫ খানা সিনেমা তৈরি করেছেন ব্রাত্য। আর এই যাত্রাপথে ক্রমাগত শিখে চলেছেন তিনি। হুব্বা নিয়ে অনেক আফসোসও রয়ে গিয়েছে তাঁর। সিনেমায় যে দৃশ্যে বাঘা জ্যোতিষীকে খুন করছে দড়ির ফাঁস দিয়ে, সেখানে পিছনে দেখা যায় টিভিতে জ্যোতিষীর শো চলছে। ওই দৃশ্যটি ভিএফএক্সে করা হয়েছে। তাড়াহুড়োতে ওই টিভির ক্লোজশট নিতে ভুলে যান ব্রাত্য। ব্রাত্য চেয়েছিলেন, বাঘার ঘেমো মুখ, বাঘার শিষ্য শিবু যে জ্যোতিষীকে মেরে ফেলছে আর ওই জ্যোতিষচর্চার শোয়ের জ্যোতিষীর বাণী মৃত্যুর ছটফটানির সঙ্গে মিশে যাক। তাহলে অন্যরকম মেজাজ তৈরি হতো। কিন্তু সম্ভব হয়নি।

এতদিনকার সিনেমা, উপন্যাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে নিউইয়র্ক হোক, মুম্বই হোক বা হুগলির কোন্নগরের গ্যাংস্টার- পরিণতি মোটামুটি একই! একটার সঙ্গে অন্যের পরিণতি তাই গুলিয়েও যায়। হুব্বা দেখতে দেখতে তাই গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর, বদলাপুরের কথা মনে আসেই। সত্যা, ডন, ডি কোম্পানি, সরকার, গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর, আব তক ছাপ্পন- এতগুলো সিনেমা তো ভারতে ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। হুব্বা তৈরির সময় ব্রাত্য বসুর মনে এই সিনেমাগুলি প্রভাব ফেলেনি?

ব্রাত্য জানাচ্ছেন, তিনি তাঁর হুব্বা সিনেমায় এই সিনেমাগুলো দেখিয়েছেন। মহেশ মাঞ্জরেকরের 'বাস্তব' সিনেমাটি এককালে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল তাঁকে। বহু রিয়েল লোকেশন, রাস্তায় শ্যুট, এক একটা খুন পিছনে গীতাপাঠ, মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসা- ভাবিয়েছিল ব্রাত্যকে। স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই বলতে পারেন এইগুলো তো আগের সিনেমাকেই হোমেজ দেওয়া। ব্রাত্য বলছেন, অবশ্যই হোমেজ, তিনি নিজের ইচ্ছে অনুযায়ীই হোমেজ দিয়েছেন। কিন্তু হুব্বা শুধু অন্য কতগুলো সিনেমার কোলাজ হয়ে থেকে যায়নি, হুব্বার মধ্যে দিয়ে অন্য অনেক গল্প বলতে চেয়েছেন ব্রাত্য। সেখানে এই অন্য সিনেমাগুলি উপাদান হিসেবে আছে। ষাটের দশক, আটের দশক, নয়ের দশকে, বাংলা মিডিয়ামে পড়া মানুষ, ইংরাজি বলতে আড়ষ্ট মানুষ, কোথাও ইংরেজি না বলতে চেয়েও বলতে না পেরে একইসঙ্গে অস্বস্তি বোধ করা আবার 'আমি ইংরেজি বলব কেন’ বলে দ্বন্দ্বে ভোগা মানুষ, যে মানুষটা আইপিএসও হতে পারে, ডাক্তারও, অধ্যাপক আবার মস্তানও হতে পারে- সেই মানুষদের পালস ধরতে চেয়েছেন ব্রাত্য। নিজের রুদ্ধসঙ্গীত থিয়েটারে বাঙালির ৩০ বছরের সাংস্কৃতিক জীবনের সফর দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। আর হুব্বাতে তলপেটের গড়পড়তা বাঙালির, নাশকতার বাঙালির, থলথলে জীবনের সামাজিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন ব্রাত্য।

গ্যাংস্টার সিনেমার ক্ষেত্রে, গ্যাংস্টার চরিত্রটির প্রতি পরিচালকের কোথাও একটা করুণাঘন দৃষ্টি থেকেই যায়, মায়া থেকে যায়। হয়তো মায়ের প্রশ্নে গ্যাংস্টার দুর্বল, হয়তো কোথাও মহৎ ন্যায়ের লক্ষ্যে লড়ে যাচ্ছে ডন। হুব্বা প্রকৃতার্থেই নব্বইয়ের দশক, সমস্ত বিশ্বাসভঙ্গের সময়ের, পোস্টট্রুথের আগমনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। হুব্বার কোনও নৈতিকতা নেই। সেক্রেড গেমসে আবার দেখা যাবে গ্যাংস্টারই সিনেমার নিয়ন্ত্রক। কিন্তু হুব্বাতে গ্যাংস্টার এই গোটা সিনেমার নিয়ন্ত্রক করে রাখলেন না ব্রাত্য, লাগাম দিলেন পুলিশের হাতেও। কেন?

ব্রাত্য বলছেন, ঠিক যে যে কারণে আম জনতা একজনকে গ্যাংস্টার বলে, অপরাধী বলে, পুলিশও ঠিক সেই সেই পথেই হেঁটে যায়, তাঁদের সোর্স সেই অপরাধীই। ব্রাত্য নিজে একটা সিস্টেমের মধ্যে প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে থেকেই এই জায়গাটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বলছেন, যে লোকটিকে দাগিয়ে দেওয়া হয় খারাপ বলে, আবার যাকে মনে রা হয় ভালো, তারা আসলে একই তলে। কে কীভাবে দেখছেন তার উপর নির্ভর করে সবটা। দেশে একটা মন্দির প্রতিষ্টা হচ্ছে। কারও কাছে সেটা একটা সিনেমার জন্ম দিচ্ছে। কারও কাছে 'গণশত্রু' হয়ে উঠছে, কেউ ভাবছে মন্দিরের জল থেকে দূষণ হতে পারে। ব্রাত্য বলছেন, তাঁর দেখাটাই এই গভীর উপলব্ধির কাছে নিয়ে এসেছে তাঁকে।

আরও পড়ুন- মিতা বলে ডাকতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার ‘মস্তান’ ভানু বোসের ম্যাজিক আজও অমলিন

হুব্বা সিনেমাকে কি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করলেন ব্রাত্য? প্রোমোটার, সিন্ডিকেট, তোলাবাজির শুরুটা দেখাতে চাইলেন কি?

ব্রাত্য ইনস্ক্রিপ্টকে বলছেন, হুব্বা সিনেমায় নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের উল্লেখ আসায় অনেকেই সম্ভবত আরও বড় কিছু আশা করেছিলেন কিন্তু সেদিকে যেতে চাননি পরিচালক। সিনেমাকে নিজের রাজনৈতিক পতাকা বহন করার কাজে লাগাতে চাননি। হুগলি জেলার গুন্ডার কথায় সিঙ্গুর আসবে খুব স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু সেই নিয়ে কোনও সমালোচনার পথে যাননি ব্রাত্য। ব্রাত্য জানেন, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় মানুষ শিল্প থেকে বাদ দিতে পারবে না, এই ছায়া নিয়েই চলতে হবে তাঁকে। মন্ত্রী হিসেবে ধরেই মানুষ সমালোচনাও করবেন। তবে ব্রাত্য মনে করছেন, সবাই সেভাবেই হুব্বা দেখছেন তা নয়। স্তুতি বা নিন্দার বাইরে গিয়ে সিনেমাটা অনেক মানুষের কাছেই সিনেমাটি পৌঁছচ্ছে বলে বিশ্বাস তাঁর। শিগগিরই টেলিভিশন ও ওটিটিতেও মানুষ হুব্বা দেখতে পাবেন।

বাংলাদেশের মোশারফ করিম অসম্ভব জনপ্রিয় অভিনেতা। কেন তাঁকেই হুব্বা চরিত্রে বাছলেন ব্রাত্য?

এই প্রশ্নের উত্তরে ব্রাত্য জানান, মোশারফকে নির্বাচন করে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তিনি। ডিকশনারি সিনেমার ডাবিংয়ের দিনে মোশারফ করিমকে ব্রাত্য বলেন, একজন ক্রিমিনালকে নিয়ে সিনেমা করতে চাইছেন তিনি। হুব্বা, আর মোশারফ করিমই হবেন হুব্বা। মোশারফ তাঁকে স্ক্রিপ্ট লিখতে বলেন, তিনি এসে শোনেনও। ডিকশনারিতে তাঁর কাজ দেখেই যে হুব্বার প্রস্তাব দিয়ে ফেলেন ব্রাত্য, তা নয়। ব্রাত্য কিন্তু মোশারফের টেলিভিশনে বা ইউটিউবে বাংলা নাটক দেখেননি কিন্তু কমলা রকেট দেখেছেন। তখন অবশ্য মোশারফকে চিনতেনও না। তবে তাঁর খুবই ভালো লেগেছিল কমলা রকেট। তবে ব্রাত্য মনে করেন, বাংলাদেশে মোশারফ খুবই জনপ্রিয় হলেও টেলিভিশনে বা ইউটিউবে যাঁরা মোশারফের নাটক দেখেন তারা বড় পর্দায় সিনেমা দেখেন কিনা তাঁর জানা নেই। মোশারফের ভক্ত হলে সিনেমায় কীভাবে মোশারফকে ব্যবহার করা হলো তা দেখতেই সিনেমা হলে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশে অনেক বেশি মানুষ মোশারফ ভক্ত হলেও পশ্চিমবাংলায় কতজন ভক্ত দেখলেন তা নিয়ে তাঁর সন্দেহই আছে। তবে অনেকেই আবার হুব্বা দেখে নতুন করে মোশারফকে আবিষ্কার করছেন বলেও জানান পরিচালক। ব্রাত্য মনে করেন, মোশারফকে আরও অনেক বেশি পরিচালক এবার ব্যবহার করতে চাইবেন। আদর্শ হিন্দু হোটেল সিরিজে ইতিমধ্যেই তিনি কাজও করছেন।

ব্রাত্যর ৬ নম্বর ছবিও কি তাহলে গ্যাংস্টার নিয়েই?

একেবারেই নয়, স্পষ্ট জানিয়েছেন পরিচালক ব্রাত্য বসু। তবে ডার্ক সিনেমা হতে পারে, থ্রিলার হতে পারে। ওটিটিতে কাজ করলে ডার্ক সিরিজই করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। অবশ্য কিঞ্চিৎ দোদুল্যমানতাতেও আছেন ব্রাত্য। অনেকদিন থেকেই প্রেমের সিনেমার কথা মাথায় ঘুরছে তাঁর। সম্ভব আর সুযোগ হলে সেটাও করতে পারেন তিনি। ব্রাত্য বলছেন, এই সময়টা খানিক গৌরকিশোর ঘোষের উপন্যাসের মতো, প্রেম নেই। প্রেমকে সবাই সন্দেহের চোখে দেখছে। তাই প্রেম না হলেও রোম্যান্টিক কমেডি করার চেষ্টা অন্তত করবেনই ব্রাত্য। তবে আপাতত নির্বাচনের ব্যস্ততাতে কাটছে দিন। কিছুকালের বিরতি নিয়ে ফের বড়পর্দার কাজে হাত দেবেন ব্রাত্য বসু।

More Articles