হেস্টিংসের দুর্নীতি ফাঁসের মাশুল, হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার

সালটা ছিল ১৭৬৩। ভারতবর্ষে সবে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন হয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংস তখনও গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হননি। কোম্পানির অধীনস্থ একজন সামান্য কর্মচারী তিনি। তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল বর্ধমান, নদিয়া এবং হুগলি অঞ্চলগুলি থেকে খাজনা আদায় করা। ধ্রুপদী ভারতীয় সাহিত্যের অনুরাগী এই ইংরেজ ব্যক্তিগত জীবনে বড় সোজা লোক ছিলেন না। সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকরা নিজেদের লেখায় তাঁর চৌর্যবৃত্তির কিছু কিছু নিদর্শনও তুলে ধরছেন। তা যাই হোক, হেস্টিংস সাহেবের খাজনা আদায়ের কাজ বেশ ভালোই চলছিল। এমন সময় তাঁর নামে উঠল টাকা পয়সা তছরুপের অভিযোগ। কোম্পানির খাস কেন্দ্রে সেই অভিযোগ নিয়ে এলেন মহারাজা নন্দকুমার। তখনও অবশ্য শাহ আলমের কাছ থেকে মহারাজা খেতাব তিনি পাননি। কিন্তু লর্ড ক্লাইভের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। আর সেই কারণেই তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে কালেক্টর পদ থেকে হেস্টিংসকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। 

এই অপমানের ফলে হেস্টিংস সাহেব স্বাভাবিকভাবেই নন্দকুমারের প্রতি ক্রোধ পুষে রেখেছিলেন। কিন্তু তক্ষুনি কিছু করতে পারেননি। সাদা চামড়ার এক সাহেব পদ থেকে সরিয়ে তার জায়গায় একজন কালো চামড়ার মানুষকে বসানো হচ্ছে, এ আর কেই বা কবে মেনে নিতে পেরেছে? নন্দকুমার তখন হয়ে উঠেছেন বাংলার হিরো। তাঁর সাহসিকতার প্রতি মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বঙ্গদেশের মানুষ। কিন্তু রাজা ধীরাজের ঐশ্বর্য তাঁর বেশিদিন থাকে নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজদের চক্রান্তের ফলে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল তাঁকে। সে গল্প আজও যেন থেকে গেছে বাংলার ইতিহাসের এক ট্র্যাজেডির মতো। 

পদচ্যুত হওয়ার ঠিক দশ বছরের মাথায় গভর্নর জেনারেল হয়ে কলকাতা এলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি তখন সীমাহীন। প্রায় প্রত্যেকদিন ব্রিটিশ হাই সোসাইটির পার্টি আলো করে বসে থাকেন তিনি। তাঁকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেদের ভোজসভায়  নিয়ে আসা সে সময় তামাম ইংরেজ বড়লোকদের কাছে ছিল গর্বের ব্যাপার। কলকাতা এসে হেস্টিংস দেখলেন নন্দকুমার তখনও তাঁর পিছু ছাড়েননি। এবার আরও বড় অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নিয়ে এলেন রাজাসাহেব। লিখিতভাবে তিনি জানালেন, হেস্টিংস নাকি মীরজাফরের স্ত্রী মুন্নি বেগমের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘুষের বিনিময়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক নবাব মুবারক উদ দৌল্লার আইনি অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন তাঁকে। এবার হেস্টিংস আরও বড় প্যাঁচে পড়লেন। চার সদস্যের এক কাউন্সিলর বোর্ডের কাছে হেস্টিংসকে নিজের কাজকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হত। ঘটনাচক্রে এই চারজনের মধ্যে তিনজনই তাঁর বিরুদ্ধাচারী ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল ক্ল্যাভারিং, মনসন ও ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিসের সঙ্গে তো হেস্টিংসের গোলাগুলির যোদ্ধই বেঁধে গেছিল একবার। 

কাউন্সিলরদের চাপে একেই হেস্টিংস নাস্তানাবুদ তার উপর এই চার সদস্যের টিমের কাছে নন্দকুমার নিয়মিত হেস্টিংসের কুকর্মের তথ্য প্রমাণ পাঠাতেন। ফলত তাঁরা একভাবে হেস্টিংসকে বিপদে ফেলতেই তাঁর ঘুষ খাওয়ার ঘটনার প্রতি কোর্ট অফ ডিরেক্টরর্সের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নন্দকুমারের বিরুদ্ধে হেস্টিংস তখন রাগে ফুঁসছেন। সুযোগ পেলেই তাঁকে কচুকাটা করবেন। এমতাবস্থায় সুযোগ আচমকা এসেও পড়ল।

বোলকিদাস নামক এক জহুরির সঙ্গে নন্দকুমারের কিছু ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। তাঁকে একবার তিনি কিছু রত্ন দেন বিক্রির উদ্দেশ্যে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কাশেমবাজার লুঠের সময় সেগুলি খোয়া যায়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে নন্দকুমারকে ৪ হাজার ২১ টাকা দিতে সম্মত হন বোলকিদাস। সেই মর্মে দু'জনের চুক্তিপত্রও তৈরি হয়। কিন্তু এর অল্পদিনের মাথায় বোলকিদাসের মৃত্যু হয়। যদিও, তার জন্য টাকা মার যায়নি নন্দকুমারের। বোলকিদাসের নিকটাত্মীয় পদ্মমোহন দাস দায়িত্ব নিয়ে নন্দকুমারের সমস্ত পাওনা মিটিয়ে দেন। কিন্তু গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। গঙ্গাবিষ্ণু নামে বোলকিদাসের এক আত্মীয় দাবি করেন, নন্দকুমার জালিয়াতি করে তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। সেই হিসেবে রাজাসাহেবের নামে তিনি হাইকোর্টে মামলাও করেন। হেস্টিংস দেখলেন সুযোগ এসে গিয়েছে। গঙ্গাবিষ্ণুর পালে সমান তালে হাওয়া লাগাতে থাকেন তিনি। 

১৭৭৫ সালে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। নিজের সমস্ত প্রমাণ নিজেই পেশ করেন তিনি। যে সকল কাউন্সিলরদের  হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহ তিনি করেছিলেন , তাঁরা কেউই তাঁর দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়াননি। এলিজা ইম্পের বিচারে ফাঁসির আদেশ হয় নন্দকুমারের। "জালিয়াতির জন্য ফাঁসি? এ কি মামাবাড়ির আবদার?" এ প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু ইংরেজ দণ্ডবিধিতে এমনটাই ছিল নির্দেশ। যদিও সে আইন ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। কিন্তু এতকিছু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেই বা কে? আগে এই স্পর্ধাকে ফাঁসি দাও, তারপর অন্য কথা।  

নিজের মৃত্যুস্থান নিজেই নির্বাচন করেছিলেন নন্দকুমার। শেষযাত্রায় গঙ্গা থাকবে তাঁর চোখের সামনে, এমনটাই ছিল তাঁর ইচ্ছে। সেই মতো বর্তমানের বিদ্যাসাগর সেতুর সামনে তৈরি করা হয় একরা কুয়ো। ১৭৭৫ সালের ৫ অগাস্ট, গোটা কলকাতা ভেঙে পড়েছিল মহারাজের ফাঁসি দেখতে। হিকি সাহেবের গেজেটে পাওয়া যায়, অনেকে নাকি আবার সেদিন ক্ষুন্ন মনে শহর ছেড়ে চলেও গেছিলেন। ধীরস্থির মুখে সেদিন ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন নন্দকুমার। শান্ত হাতে গলায় টেনে নিয়েছিলেন মৃত্যুর রজ্জু। আশেপাশের বাঁধভাঙা জনতা চোখে ত্রাস নিয়ে দেখলেন ব্রিটিশদের জঘন্য চক্রান্তের ফলে শহিদ হলেন মহারাজা নন্দকুমার।

More Articles