তাঁকে ছাড়া অচল ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, দেশ ভুলেছে মহাদেব দেশাইকে

Gandhi and Mahadev Desai: গান্ধীজির কাছে মহাদেব দেশাই কতটা অপরিহার্য ছিলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সংগঠনের প্রচারকার্য জন্য দেশাইজির উপর তিনি কতটা নির্ভরশীল ছিলেন, তার সর্বশ্রেষ্ট প্রমাণ গান্ধীজির কথা থেকেই পাওয়া যায়

স্বাধীনতা লাভের ঠিক পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪২ সালের ৯ অগাস্ট মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন, যাতে দেশবাসী ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ শাসকদের বিতাড়িত করতে সর্ব্বাত্মক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর একটা সপ্তাহও কাটল না,ষষ্ঠ দিনে অর্থাৎ ১৯৪২ সালের ১৫ অগাস্ট গান্ধীজি ও তাঁর অনুরাগীদের কাঁদিয়ে মাত্র ৫০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করলেন তাঁর একান্ত সচিব মহাদেব দেশাই।
গান্ধীজি তাঁর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত দেশাইজি এবং তাঁর কাছ থেকে পাওয়া মূল্যবান পরামর্শগুলির সুতীব্র অভাব বোধ করেছেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে, বলতে গেলে শেষ সপ্তাহে, যখন গান্ধীজির রীতিমতো বিব্রত অবস্থা, একদিকে তিনি ব্যাকুল ভাবে চেষ্টা করছেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির সম্পর্ক পুনরুদ্বারের জন্য এবং অন্যদিকে চেষ্টা করেছেন জহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যকার ফাটল মেরামত করতে। ওই সময় তিনি তাঁর নাতনি মনুকে বলেন, "আজ আমি মহাদেবের অভাব যতটা তীব্রভাবে অনুভব করছি, তেমনটা আগে কখনও করিনি। সে যদি আজ বেঁচে থাকত তাহলে দেশের পরিস্থিতিকে কখনই এই পর্যায়ে যেতে দিত না।"

১৯১৭ সালে আহমেদাবাদে দেশাইজি এলেন গান্ধীজির সংস্পর্শে। তারপর থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি নিবিড় মানসিক ও বৌদ্ধিক বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন গান্ধীজির সঙ্গে। মহাত্মা গান্ধীর সেবায় তিনি নিজেকে নিমজ্জিত করে দিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন একধারে গান্ধীজির সচিব, টাইপিস্ট, অনুবাদক, উপদেষ্টা, পত্রবাহক, কথপোকথনকারী, বিতর্ককারী এবং আরও অনেক কিছু| তাঁর হাতের খিচুড়ি গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয় ছিল।

গান্ধীজির কাছে মহাদেব দেশাই কতটা অপরিহার্য ছিলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সংগঠনের প্রচারকার্য জন্য দেশাইজির উপর তিনি কতটা নির্ভরশীল ছিলেন, তার সর্বশ্রেষ্ট প্রমাণ গান্ধীজির কথা থেকেই পাওয়া যায়। ১৯১৭ সালে মহাদেব দেশাই  সবরমতী আশ্রমে গান্ধীজির সচিব হয়ে এলেন। তার একবছর পরে একদিন গান্ধীজি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মোগললালকে বলেন, "আমার সচিবই এখন আমার হাত, আমার পা। আমার মস্তিষ্কও বটে। সে না থাকলে মনে হয় যেন আমার পা চলে না,আমার বাক্যস্ফূর্তিও হয় না। আমি তাঁর সম্বন্ধে যত জানি, তত তাঁর গুণের পরিচয় পাই। তাঁর ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতা যত, তাঁর পাণ্ডিত্যও ততটাই।" এর কুড়ি বছর পরের ঘটনা। অত্যধিক পরিশ্রমের চাপে দেশাইজির স্বাস্থ্যের রীতিমতো অবনতি হয়েছে। তবুও তিনি একদিনের জন্যও ছুটি নিতে রাজি নন। গান্ধীজি তাঁকে বকুনি দিয়ে বলেন, "আমরা নিশ্চয়ই একথা বলতে পারি যে, তোমার ভালো রকম কাজ-কাজ বাতিক আছে! তুমি কি জানো না যে, তুমি যদি অক্ষম হয়ে পড়ো, তবে আমার অবস্থা হবে একটা ডানাভাঙা পাখির মতো? আর তুমি যদি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ো, তবে আমার কাজকর্মের তিন-চতুর্থাংশ গুটিয়ে ফেলতে হবে?"

আরও পড়ুন- আজীবন ঝর্না কলমের চরম বিরোধী মহাত্মা গান্ধী, যে কথা মনে রাখেনি কেউ

ম্যাডেলিন সেল্ড নামের এক ব্রিটিশ মহিলা, পরবর্তীকালে যিনি মীরা বেহেন নাম বিখ্যাত হন, ছিলেন গান্ধীজির শিষ্যা| ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে একদিন মহাদেব দেশাই গেলেন আহমেদাবাদ স্টেশন থেকে সেই মীরা বেহেনকে অভ্যর্থনা করে আনতে। সেই থেকে দু'জনের মধ্যে এক পরম শ্রদ্ধার সম্পর্ক সৃষ্টি হল। তার ১৭ বছর পরে জেলবন্দি অবস্থায় যখন দেশাইজির মৃত্যু হল তখনও সহ-বন্দিনী অবস্থায় মীরা বেহেন ছিলেন তাঁর মৃত্যুশয্যার পাশে। মীরা বেহেন একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, নাম The Spirit's Pilgrimage। সেখানে দেশাইজি সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, "তিনি ছিলেন একজন দীর্ঘদেহী, সুপুরুষ ব্যক্তি। বুদ্ধির দীপ্তিতে ভরপুর তাঁর মাথার উপর ছিল বিরল কেশ। প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মার্জিত, রুচিশীল এবং সুগঠিত হাত দু'টির মাধ্যমে, তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে দিয়ে বুদ্ধির ঝলক ফুটে উঠত। পরিস্থিতি যতই জটিল ও পরিবর্তনশীল হোক না কেন, অসামান্য ধীশক্তি ও দ্রুততার সঙ্গে সে বিষয়ের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন। তিনি ছিলেন সর্বকার্যে বাপুজির দক্ষিণহস্ত। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তিনি যে কোনও বিষয়ে পৰ্যালোচনা করা, পরামর্শ করা,লেখালেখি করা ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের অনেক গুণাবলীর মধ্যে যে বিষয়টি সর্বাপেক্ষা রেখাপাত করত, সেটি হল বাপুজির প্রতি তাঁর নিবেদিত-প্রাণ ভক্তি।"

মহাদেব দেশাই অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী ছিলেন। পড়াশুনার চৰ্চায় নিমগ্ন থাকলেও তিনি কখনও তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য ভুলতেন না। সেই কর্তব্যটি হল, গান্ধীজিকে সর্বদা সকল কর্মে সহায়তা দেওয়া, সুপরামর্শ দেওয়া এবং তার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে গান্ধীজি কী বলেছেন, কী করেছেন, কেন করেছেন তার নির্ভরযোগ্য তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখা, যা আগামী প্রজন্মের উৎসাহী পাঠক ও গবেষকদের জন্য সম্পদ হয়ে থাকবে।

ব্রিটিশদের ভারত ছেড়ে চলে যেতে বলা ও সেই দাবিকে প্রবলতর করার জন্য দেশব্যাপী 'গণ আন্দোলনের' ডাক দেওয়ার কারণে ১৯৪২ সালের অগাস্ট মাসে গান্ধীজিকে ব্রিটিশ সরকার পুনে শহরে 'আগা খাঁ' প্রাসাদে বন্দি করেছিল| ঔপনিবেশিক সরকার এই উদ্দেশেই ওই প্রাসাদটিকে অধিগ্রহণ করে রেখেছিল। সেখানে গান্ধীজির কিছু ঘনিষ্ট সহযোগীও বন্দি হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে  অন্যতম ছিলেন মহাদেব দেশাই ও মীরা বেহেন। এই বন্দিদশা দীর্ঘমেয়াদি হবে এইরকম অনুমান করে দেশাইজি মীরা বেহেনকে বলেন, "কী দারুণ একটা সুযোগ এলো লেখালেখি করার পক্ষে! অন্তত ছ'টি বই লিখে ফেলার মতো বিষয়বস্তু মনের মধ্যে দানা বেঁধেছে। সেই বিষয়বস্তুগুলি লিখিতভাবে প্রকাশ করতে চাই।"

তারিখটা ছিল ১৪ই অগাস্ট ১৯৪২। তার পরের দিনই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে দেশাইজি চিরবিদায় নিলেন | মৃত্যুর পরের দিন দেশাইজির সুটকেস খুলে গান্ধীজি দেখেন যে, সেখানে কাপড় চোপড় ছাড়া রয়েছে কয়েকটি বই- আগাথা হ্যারিসনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া একটি বাইবেল, রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটকের বই 'মুক্তধারা', ‘Battle for Asia’ নাম একটি বই আর কিছু খবরের কাগজের টুকরো।

বিজেপির গান্ধী-মুক্ত ভারতের কৌশল না কি মোদি আমলেই যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন নেতাজি!আরও পড়ুন-

গান্ধীজির সহযোগীদের মধ্যে মহাদেব দেশাই ছিলেন সর্বাপেক্ষা উচ্চশিক্ষিত ও গুণী মানুষ। গুজরাতি ও ইংরেজি সাহিত্যে তিনি ছিলেন একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি। এছাড়া ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনীতি এবং আইন বিষয়েও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। আয়ান দেশাই নামক এক আমেরিকান ইতিহাসবিদের মতে, গান্ধীজি পরিচালিত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের যে বৌদ্ধিক প্রখরতা ছিল তার প্রাণকেন্দ্রে ছিলেন মহাদেব দেশাই। স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রাপথে বিভিন্ন পর্যায়ে দেশাইজি সাহায্য জুগিয়ে গিয়েছেন, যাতে গান্ধীজি বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে সংহত রাখতে পারেন। সদা সর্বদা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও খবরাখবর জুগিয়ে গিয়েছেন, যা গান্ধীজিকে সাহায্য করে গিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রামকে জারি রাখতে।

মহাদেব দেশাইয়ের বৌদ্ধিক আদান প্রদানের সঙ্গীদের যে বৃত্ত, সেটিও ছিল খুব উন্নত। যাঁদের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলত, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জহরলাল নেহরু, মীরা বেহেন, তামিল সংস্কৃতপণ্ডিত ভি এস শ্রীনিবাস শাস্ত্রী এবং ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সচিব গিলবার্ট লেথওয়েট। গান্ধীজির মতো মহাদেব দেশাইও ছিলেন সকল প্রকার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও সংকীর্ণ চিন্তার বেড়াজাল থেকে মুক্ত এক ব্যক্তিত্ব। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহর মতে, মহাদেব দেশাইয়ের নিরলস প্রচেষ্টা ও অবদান ছাড়া ভারত হয়তো কোনওদিন ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারত না। তৎসত্ত্বেও, এই মহান দেশপ্রেমী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী আজও যথাযোগ্য সম্মান পেলেন না।

 

তথ্য সূত্র : লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ 

More Articles