কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ়: সংবিধানের দিকে তাকিয়ে রণক্লান্ত ভারতীয়রা
Constitution Of India: যখন বেঁচে থাকার অধিকারই হারাতে হয়? তখন বোধহয় গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো দেবতার বিগ্রহতুল্য হয়ে উঠতে চায়।
দেশ ৭৭ তম স্বাধীনতা দিবসের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাড়ির মাথায় উড়ন্ত তিনরঙা পতাকা, চারচাকা গাড়ির ভিতর জাতীয় পতাকার মিনিয়েচার কেমন যেন আনমনা। সে জানে ব্রিটিশ উপনিবেশের নাগাল থেকে স্বাধীনতা পেতে বহু রক্ত-ঘাম-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-আন্তরিকতা এবং বন্ধু-স্বজনের আত্মা হয়ে সে ছিল। সে জানে স্বাধীন দেশে নতুন স্বপ্ন নতুন করে গড়ে নেওয়ার অঙ্গিকার কীভাবে গোটা একটা সংবিধান নির্মাণ করে। দেশভাগের যন্ত্রণা-বঞ্চনা- হাহাকার কীভাবে তাকে ছুরির ফলার মতো আঘাতে জর্জরিত করেছিল সে জানে। সেখান থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি। কারণ গণতন্ত্র চর্চার ভিতর দিয়ে নিজেকে ঠিক গড়ে নেবে সেই দেশ। যেখানে প্রতিষ্ঠা পাবে বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা। তেমন শপথই সে নিয়েছে। বৈষম্যের সরিয়ে সমতা-মর্যাদা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার নিরিখে সমস্ত কিছুকে দেখার চেষ্টা করবে। এত মানুষের এত বড় দেশে এত ভাষা এত রকম বৈষম্য বিভাজনের ভিতরে থেকে গণতন্ত্র চর্চার অঙ্গিকারে সে-ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ৩০ শে জানুয়ারি ১৯৪৮ গান্ধি হত্যার রক্ত ছিটে কমলা সবুজের মাঝে যে সাদা অংশ তাতে হয়তো ক্ষত হয়ে থেকে গেল। সেই কারণেই উদাস তিরঙ্গা নিশান?
চোখ থাক কাশ্মীরে
উত্তরে ভূস্বর্গ কাশ্মীর। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর মাসে ৩৭০ নামক এক বিশেষ ধারা সংবিধানে যুক্ত হলো। বলা ভালো, পৃথক সংবিধান, পৃথক পতাকা এবং আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পেল। ভারত রাষ্ট্রের সংবিধান স্বীকৃত সেই ৩৭০ ধারা ৩১ অক্টোবর, ২০১৯ পর্যন্ত বলবৎ থাকল। সেই সঙ্গে থাকল ভারত রাষ্ট্রের পুলিশ প্রশাসন ও সেনার দাপাদাপি। কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যত তীব্র হল, রাষ্ট্রের অত্যাচার-অন্যায়-বল প্রয়োগের মাত্রা বেড়ে ততই বেড়ে উঠতে লাগল। সংবিধান প্রদত্ত গণতন্ত্রের পিঠে সপাট হিংসার ছুরি বসিয়ে দেওয়ার কাজ সুসম্পন্ন হলো। ৩৭০ অনুচ্ছেদ যেন ছিল ভারত ও কাশ্মীরের মধ্যে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সূক্ষ্ম সেতু। রাতারাতি দিল্লি থেকে ফরমান জারি করে সেই সেতু নিস্ক্রিয় হলে পড়ে রইল কেবলমাত্র অপমান, অমর্যাদা ও চেপে বসা দমন।
আরও পড়ুন: সংবিধান আছে তাই নাগরিক বাঁচে
অখণ্ড ভারতের মুকুট কাশ্মীর। প্রশ্ন ওঠে, তাকে বিশেষ সুযোগসুবিধা, খাতির করে ৩৭০ ধারার ব্যঞ্জনায় মুড়ে রাখার কোনও রকম গুরুত্ব আছে কি আদৌ? কোনও না কোনও ভাবে স্বাধীন কাশ্মীরকে কুক্ষিগত করে হাসিল করার ইতিহাস যেমন আছে, তেমনই আছে কাশ্মীর দেশ হিসাবে স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এত দীর্ঘ সময় পার করেও সে আকাঙ্ক্ষা কিন্তু মলিন হয়নি।
কাশ্মীরের রাজা হরি সিংয়ের পূর্বসূরি মহারাজা গুলাব সিং ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ ৭৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে (ধারা ৩) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে কাশ্মীর কিনে নেন। যে কারণে মহাত্মা গান্ধী চুক্তিটি পড়ার পর চুক্তিটিকে ‘sale dead’ বলে মন্তব্য করেন। মনে রাখতে হবে, কাশ্মীরের সাধরণ মানুষ কী চাইছেন, তা জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা কিন্তু ছিল না। কাশ্মীর বারবার স্বাধীনতা হারিয়েছে। কিন্তু কখনই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে ত্যাগ করেনি। কাশ্মীর রাজনৈতিক ভাবে কখনই ভারতের অংশ ছিল না। ৫৬৫টি প্রিন্সলি স্টেট, ব্রিটিশের পরোক্ষ শাসন কায়েম ছিল। ভারত ভূখণ্ড ছিল প্রত্যক্ষ ব্রিটেনের রানির শাসনের অধীন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আইনের ধারা ৭(১) (ডি) ধারা অনুসারে রানি প্রধান হওয়ার চুক্তিপত্রগুলি বাতিল করার মধ্যে দিয়ে কাশ্মীর স্বাধীন ভূখণ্ড হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। একদিকে পাকিস্তানের উপজাতি গোষ্ঠীর লাগাতার কাশ্মীর আক্রমণের ঘটনা, অন্যদিকে ডোগরা রাজার ভয়ানক অত্যাচারে জর্জরিত কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। ঠিক সেই সময়ই পাশে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা প্রাপ্ত গণতান্ত্রিক সেকুলার দেশ হিসাবে নিজেদের গড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্য দিকে নবীন দেশ পাকিস্তান ধর্মীয় ভাবে ইসলামিক দেশ হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাইছে। সমান অধিকার সমান মর্যাদার ভিত্তিতে স্বাধীন কাশ্মীর হিসাবে গড়ে তোলার পক্ষে শেখ আবদুল্লা-রা ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন অস্থির পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য। চুক্তির ভিত্তিতে ভারতের নেহরু সরকার সাহায্যের আশ্বাস দেন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে শর্তসাপেক্ষ ভাবে ভারতের সাথে যুক্ত হয় কাশ্মীর।
উপরের ঘটনাগুলি মোটা দাগের বিবরণ হলেও, স্বাধীন কাশ্মীর পাওয়ার স্বপ্ন কোনওদিনই ছাড়তে পারেননি কাশ্মীরের বাসিন্দারা। নিটোল বাহারি কারুকাজের কাশ্মীরি শাল গোটা ভারতের শরীরে যখন ওম পৌঁছে দেয়, তখন কাশ্মীর ক্ষতবিক্ষত। দশ বারো বছর বয়স থেকে সত্তরোর্ধ্ব বাড়ির পুরুষেরা বেপাত্তা। এক থানা থেকে অন্য থানায় খোঁজ চালাতেই থাকে একা নারী। পুরুষহীন গ্রাম। রাষ্ট্রের পুলিশ-সেনা দিনে-রাতে যখন তখন গোটা এলাকা ঘিরে সার্জিকাল অপারেশন চালায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১, রাতের কুনান ও পোষপোরা গ্রাম। যে তালাশের সাক্ষী নারী-শরীর নারী-মন। ২৩ জন নারীর গণধর্ষণ আমরা অনেকেই ভুলে গিয়েছি। ভুলে গিয়েছি বলেই, ২০১৯ সালে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মহাঋিষি ভগিরথ জয়ন্তীতে গিয়ে হরিয়ানা-সহ উত্তর ভারতের যুবকদের কাশ্মীরের মেয়েদের বিবাহ করার জন্য দরাজ আহ্বান দিয়ে বসলেন। লুঠের মালের ভাগ বাটোরা করার মতো উল্লাস।
ছত্তীসগঢ়ের ছবি
মধ্য ভারতের ছত্তীসগঢ় মূলত আদিবাসী মানুষে বসবাস। ষড়যন্ত্র করে রামকে নির্বাসনে পাঠাতে যেমন দন্ডকারণ্য বাছা হয়েছিল। তেমনই দেশভাগে উচ্ছেদ হওয়া বাংলাদেশের বহু মানুষকে ঠাঁই দিতে দন্ডকারণ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলত দেশের মধ্যভাগ জুড়ে ঘন জঙ্গলে ঘেরা ছত্তীসগঢ়ের ভূমিপুত্র বলতে আদিবাসী মূলবাসী মানুষ। শতকরা হিসাবে প্রায় ৭০ ভাগ বিভিন্ন জনজাতির আদিবাসী মানুষের বসবাস। যেখানে ১১টি আসনের ১০টিতেই বিজেপি দল জয়যুক্ত হয়েছে। সেই ছত্তীসগঢ়ের বুকে গড়ে উঠেছে আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ। পরিস্থিতি এমনই যে বাধ্য হতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় আদিবাসী জনজাতিকে মিলিটারি পুলিশ দিয়ে হাপিস করার পরিকল্পক এখানে সংবিধান স্বীকৃত সরকার। বেঁচে থাকার স্বার্থে, আদিবাসী জনজাতিকে রক্ষা করার স্বার্থে গড়ে উঠেছে ‘মূলবাসী বাঁচাও মঞ্চ’। মঞ্চের সাথে যুক্ত কর্মীরা সুকমা, নারায়নপুর, দান্তেওয়ারা জেলায় প্যারামিলিটারি ফোর্সের ২২২টি ক্যাম্পের তালিকা তৈরি করেছেন। এই ক্যাম্পগুলির কাজ আড়ালে থেকে হত্যা সংগঠিত করা। মানবাধিকার কর্মীরা জানাচ্ছেন, আগের তুলনায় অনেক বেশি নারী ও শিশুদের হত্যার নিশানা করা হচ্ছে। হত্যা পরবর্তী সময়ে সরকার পক্ষ থেকে একই কৌশলে ঘোষণা করা হয়ে থাকে, মৃত ব্যক্তিরা সব নকশাল। নকশাল মানে মারাই যায়। কৈফিয়ত দিতে হয় না কাউকে।
গত ৩০ জানুয়ারি উনিশ বছরের রমেশ ওয়াম সদ্যজাত কন্যা সন্তানকে দেখতে ভাইরামগড় গ্রামে যান। কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনি ইন্দ্রাবতী নদীতে স্নান করতে গেলে নিরাপত্তা রক্ষীর এলোমেলো গুলিতে খুন হন। রাষ্ট্রের কাজ কি তবে গুপ্ত হত্যা সংগঠিত করা? তবে রাজনীতিতে ঘটা করে হিংসা অহিংসার প্রশ্নকে রাখা হয় কেন? ভারত রাষ্ট্র সংবিধানের তোয়াক্কা না করে কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ় সর্বত্র নাগরিকদের হত্যা হিংসা ভয় রক্ত পাতের ভিতর দিয়ে একই ফর্মুলায় কি নিকেশ করতে চাইছে? এই নাগরিকদের প্রত্যেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভুক্ত, কেউ ধর্মের দিক থেকে, কেউ জাতি হিসাবে।
আরও পড়ুন: সংবিধানের দলিত, দলিতের সংবিধান: একটি বোঝাপড়া
২০২৪ সালের একটি এমনই ঘটনার কথা মানবাধিকার কর্মী বেলা ভাটিয়া বলেন। রাজে ওয়াম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনও মতে একটি প্রতিবাদী সমাবেশে এলে মাটিতে পাতা প্লাস্টিকের উপরেই শুয়ে পড়েন। জানা যায়, বড় মেয়েকে যখন খাবার খাওয়াচ্ছিলেন গ্রামে তখন শ'খানেক নিরাপত্তারক্ষী ঢোকে। আচমকাই লক্ষ করেন অফিসারেরা তার ঘরের বারান্দায় এসে তাদেরই নিশানা করেছে বন্দুক দিয়ে। এবং সরাসরি গুলি চালানো শুরু হয়। বছর আটেকের মেয়েকে বর্মের মতো রক্ষা করলেও তাঁর নিজের মেরুদন্ডে গুলি লাগে। পুলিশ অবশ্য স্পষ্ট ভাবে অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে।
গণতন্ত্রের আধার সংবিধান। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত করতে দায়বদ্ধ থাকে। যখন বেঁচে থাকার অধিকারই হারাতে হয়? তখন বোধহয় গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো দেবতার বিগ্রহতুল্য হয়ে উঠতে চায়। আর পূজার নৈবেদ্য হয়ে সর্বত্রগামী হয়ে ওঠে তিরঙ্গা নিশান।