দলে টানতে চেয়েছেন মমতা! শুভেন্দুর যে বিস্ফোরক দাবি ঘিরে হুলুস্থূল বঙ্গরাজনীতিতে
Suvendu Adhikari: শুভেন্দুই বলে ফেললেন 'সেটিং-কথা'। আর এই বিস্ফোরক অভিযোগের কেন্দ্রে আবার তিনিই, অর্থাৎ মমতা।
সেটিং না ফিটিং! সমঝোতা, না কি কাছে ডাকা! রাজ্যে ৩ ডিসেম্বরের তথাকথিত মেগা দুই সভার সঙ্গেই উচ্চারিত হচ্ছে এই শব্দও। একদিকে 'ভাইপো-ভাইপো' ডাক, অন্যদিকে তুইতোকারি- 'তুই বেশি চোর!' কে কত বেশি খারাপ বা কে কতটা বেশি কার চেয়ে ভালো, সেই প্রশ্নের উত্তাপের মধ্যেই আবারও বঙ্গের রাজনীতি তাতিয়ে দিয়েছে 'সেটিং'।
এবার আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের খবরে নয়। এবার 'সেটিং তত্ত্ব' শোনা গিয়েছে, মোদির দলের বঙ্গমুখ শুভেন্দু অধিকারীর গলায়। কয়েক দিন আগেই যাঁর 'পুরনো বন্ধু দিদি'-র সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বিস্তর। দলের অভ্যন্তরেও অস্বস্তিতে পড়েছিলেন শুভেন্দু। এবার সেই শুভেন্দুই বলে ফেললেন 'সেটিং-কথা'। আর এই বিস্ফোরক অভিযোগের কেন্দ্রে আবার তিনিই, অর্থাৎ মমতা।
কী বলেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা অর্থাৎ বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী? বহু জল্পনা এবং বিতর্ক-অভিযোগ পেরিয়ে ডায়মন্ডহারবারের লাইটহাউস মাঠে সভা করলেন শুভেন্দু অধিকারী। সেই সভাস্থল থেকেই অভিষেকের একাধিক অভিযোগের জবাব প্রসঙ্গে শুভেন্দু বলেন, ''ওর কথার উত্তর আমি দেব না। ও আমার প্রতিপক্ষ নয়। ওর পিসিকে হারিয়েছি। ওকে কেন জবাব দেব!" এখানে না থেমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম না-করে শুভেন্দু দাবি করেন, "সেদিন আমাকে কার্যত হাত ধরে সব মেটাতে চেয়েছিলেন, সেটিং করতে চাইছিলেন। বড় বলে পা ধরার কথা বলব না। তবে আমি সে সুযোগ দিইনি। আমি তিনজন বিজেপি বিধায়ক মনোজ টিগ্গা, অগ্নিমিত্রা পল, অশোক লাহিড়ীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেই সুযোগ দিইনি। ভেস্তে দিয়েছি। আমি সেটিং করার লোক নই।''
আরও পড়ুন: কয়লা পাচার কাণ্ডের তদন্তে চাবিকাঠি অভিষেকের শ্যালিকা? কীভাবে ঘনাচ্ছে রহস্য
সমগ্র রাজনৈতিক উত্তাপ থমকে গিয়েছে শুভেন্দু অধিকারীর এই দাবিকে কেন্দ্র করেই। সত্যিই কি সেদিন, অর্থাৎ নভেম্বরের ২৫ তারিখের সাক্ষাৎ ছিল সেটিংয়ের জন্যই? ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন?
সংবিধান দিবস। রাজ্য বিধানসভায় অধিবেশন চলছে। ঠিক সেদিনই বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ডাকেন শুভেন্দুকে। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরের পর এই প্রথম দেখা হয় দু'জনের। সৌজন্য বিনিময় হয় শুভেন্দু এবং মমতার মধ্যে। মুখ্যমন্ত্রী খোঁজ নেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতার বাবার শরীরের। এরপর বিধানসভাতেও মমতার মুখে ওঠে 'শুভেন্দু ভাইয়ের মতো' প্রসঙ্গ, অধিকারী পরিবারের প্রসঙ্গ। ফের উত্তাল হয় বঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চ। কেউ কেউ দাবি করেন, তাহলে কি মকুলের পথেই তৃণমূলে ফিরছেন শুভেন্দু! আবার মমতা কি অন্য কোনও কৌশল নিয়েই এ-কাজ করলেন! একাধিক প্রশ্ন আর বিতর্কের আবহেই দলীয় অন্দরেও শুভেন্দুর এই হঠাৎ-সাক্ষাৎ ঘিরে ওঠে প্রশ্ন। যদিও সৌজন্য এবং সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা বলে ঘটনাটি চাপা পড়তে পড়তেই শুভেন্দু অধিকারীর ভাই তমলুকের সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে বসেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
এরপরেই জল্পনা বাড়ে আরও। ফের কি নয়া কোনও সমীকরণ দেখতে চলেছে বাংলা! কিন্তু এই রেশ বেশিদিন টেকেনি। ফের অভিষেক এবং তৃণমূল সরকারের বিরূদ্ধে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই সরব হতে শুরু করেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু পা ছুঁয়ে প্রণাম থেকে শুরু করে দাবিদাওয়া- ঠিক কী হয়েছিল ওই ৪-৫ মিনিটের সাক্ষাতে। এই প্রশ্নের উত্তর যদিও পাওয়া যায়নি সেদিন। এবার নিজের অভিযোগের মধ্যেই বিতর্ক উসকে দিলেন মমতার মন্ত্রিসভার প্রাক্তন এই সদস্য। আর শুভেন্দুর এই দাবির পরেই শোরগোল পড়েছে রাজনৈতিক মহলে। অনেকেই বলছেন, যেখানে বারবার শুভেন্দু-বিরোধিতায় সরব হচ্ছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁকে মূল রাজনৈতিক শত্রু করে ফেলছেন তিনি, সেখানে দাঁড়িয়ে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খেলছেন অন্য কোনও রাজনৈতিক খেলা! অস্বস্তির মূল উপজীব্য শুভেন্দুকেই কি নাগালে নিতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী!
যদিও শনিবারের সমাবেশ থেকে শুভেন্দু-গড়ে দাঁড়িয়েই বিজেপি ভাঙার আভাস দিয়েছেন অভিষেক। তিনি বলেছেন, ''ডিসেম্বরে একটু দরজা খুলব। তারপর আবার বন্ধ করে দেব। এঁদের দলে জায়গা দিলেও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আমার।'' তাহলে ডিসেম্বরের বড় ধামাকা কি তৃণমূল দেখাবে! যদিও শুভেন্দুর 'সেটিং-কথা' নজর কেড়েছে ফের।
কী সেটিং হতে পারে সেদিন? রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, "কী হয়েছে কী হয়নি আমরা কেউ জানি না। যদি ধরা হয়, শুভেন্দু অধিকারী ঠিক বলছেন, কিন্তু সেক্ষেত্রেও রাজনৈতিকভাবে খুব একটা ভুল কিছু করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে নাগালে আনতে চেষ্টা করেন অনেকেই। এক্ষেত্রে তো শুভেন্দু তাঁরই দলের প্রাক্তন।'' যদিও সেদিন ঠিক কী কারণে এই সাক্ষাৎ ছিল, তা নিয়ে শুভেন্দুর অভিযোগ ছাড়া এখনও পর্যন্ত কিছুই জানা যায়নি।
সেটিং-অভিযোগের ইতিহাস
ভগ্নপ্রায় বিজেপি-র রাজনৈতিক অক্সিজেন বাড়ানোর অন্যতম কারিগর হয়ে উঠেছিলেন তৃণমূলের মুকুল রায়। দিল্লি গিয়ে গেরুয়া-পথের শরিক হন তিনিও। ঠিক তার আগের পরিস্থিতিতেই মুকুলকে ঘরে নিতে দিলীপ ঘোষদের 'সেটিং' চলছে, বারবার এই জল্পনা শোনা যেত। অতীতে একাধিক 'সেটিং কাণ্ড' থাকলেও এই রাজ্যে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই এই বিষয়টি মাথাচাড়া দেয় অনেক বেশি।
সেটিং এবং মমতা-মোদি বৈঠক
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বারবার দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। মমতার দিল্লি সফরে একাধিকবার দেখা হয়েছে দু'জনের। ফুলের তোড়া থেকে শুরু করে সন্দেশ। পাঞ্জাবি থেকে শাল। মোদি-র জন্য মমতার উপহারের বহরও কম থাকেনি একবারও। ভার্চুয়াল বৈঠকও হয়েছে যুযুধান এই দুই পক্ষের। কিন্তু একটি বৈঠকও প্রশ্নাতীত থাকেনি কখনও। মমতা এবং মোদি-র বৈঠক নিয়ে উঠেছে 'সেটিং' তত্ত্বর অভিযোগ। বিশেষত, রাজ্যের সিপিআইএম নেতৃত্ব প্রচার করতে উদ্যত হয়েছে বিজেমূল তত্ত্ব। মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ ঘিরেই উঠে এসেছে আসল সেটিং-অভিযোগ। ইডি-সিবিআই থেকে বাঁচতে মোদির সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খুঁজতে বেরিয়েছেন মমতা, এই প্রশ্নেও উত্তাল হয়েছে বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। উঠেছে মিটিয়ে নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করার অভিযোগও। যদিও স্বাভাবিকভাবেই বামেদের এই অভিযোগ বা দাবি নস্যাৎ করেছেন তৃণমূল নেতারা। এই ইস্যুতে বিপক্ষের কথা বলছেন বঙ্গের বিজেপি নেতারাও।
২৪ নভেম্বর, ২০২১
দিল্লি যাওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে বৈঠকে মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মমতার। কেন্দ্রীয় বঞ্চনা থেকে করোনা, একাধিক ইস্যুতে বৈঠকে বসেন দু'জনে। প্রায় ২০ মিনিট কথা হয় মোদি-মমতার। কিন্তু ওই বৈঠক নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। সিপিআইএম নেতারা দাবি করেন, সিবিআই তদন্তের গতি বাড়াতেই বাঁচার জন্য মোদির সঙ্গে দেখা করেছেন মমতা!
৫ অগাস্ট, ২০২২
বহু টালবাহানার পর, একাধিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ এড়িয়ে গেলেও এদিন ফের বহুদিন পরে মুখোমুখি হন মোদি এবং মমতা। দিল্লিতে বৈঠকে বসেন তাঁরা। রাজ্যের তরফে জানানো হয়, একশো দিনের কাজের প্রকল্প থেকে শুরু করে একাধিক বঞ্চনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন মমতা। যদিও মোদিকে দেওয়া হলুদ রঙের ফুলের তোড়ার অন্দরেই রাজনীতি খুঁজে পান এই রাজ্যের বাম নেতারা। এখানেও সেটিং তত্ত্ব খাড়া করেন তাঁরা। দাবি করা হয়, অনুব্রত থেকে অভিষেক। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এবং দুর্নীতির ফাঁস থেকে বাঁচতে মোদির সঙ্গে দেখা করেছেন মমতা। প্রায় ৪০ মিনিটের ওই বৈঠকে বাঁচার আকুতি করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী! এমনই দাবি করা যায় রাজ্যের সিপিআইএম নেতাদের তরফে। যদিও পুরোটাই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয় তৃণমূল। এই প্রশ্নে একই কথা বলে বঙ্গের বিজেপি-ও।
মমতা-মোদির একাধিক বৈঠক এবং অন্যান্যদের তরফে সেটিং তত্ত্বের মধ্যেই ফের তৈরি হয়েছে বৈঠক জল্পনা। জানা গিয়েছে, আগামী ৫ ডিসেম্বর ফের মুখোমুখি হতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদি।
সামগ্রিকভাবে, এক একটি সাক্ষাৎ প্রশ্ন তোলে নিরন্তর। দুই যুযুধান পক্ষের রাজনীতি ছাড়িয়ে সৌজন্যের বাতাবরণেও থাকে একাধিক প্রশ্ন আর বিতর্ক। সেখানেই উঠে আসে বহু কথকতা আর উত্তেজনার রসদ। সাম্প্রতিক সভাতেও শুভেন্দু করলেন সেই একই কাজ। এক সাক্ষাতকে ঘিরে থাকা একাধিক প্রশ্নের দাবানলে খানিকটা ফুঁ দিয়ে বাড়িয়ে দিলেন সেই জল্পনার আগুনের তেজ, বলছেন কেউ কেউ।