মমতা বনাম জুনিয়র ডাক্তার! বৈঠক বাতিলের পর স্নায়ুযুদ্ধে কে কোথায় দাঁড়িয়ে?

পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ, স্নায়ুযুদ্ধে এদিন সকালে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এরপর কী হবে? তাকিয়ে ছিল সব পক্ষই। কিন্তু কোনো সমাধানসূত্রেই পৌঁছনো গেল না।

বার বার তিনবার। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এর আগেও দু'বার সময় দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমবার মমতা অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যান। জুনিয়র ডাক্তাররা জাননি। দ্বিতীয়বার জুনিয়র ডাক্তাররা নবান্ন অবধি পৌঁছলেও সাত তলায় ওঠেননি। তার কারণ লাইভ স্ট্রিমিং-এর বিষয় সহমতে আসা যায়নি। অবশেষে সেই বৈঠক নবান্নে নয়, বৈঠক স্থির হলো কালীঘাটে। ৩২ জন জুনিয়র ডাক্তারই সেই বৈঠকে অংশ নিতে এল। কিন্তু বারেও, বৈঠকে লাইভ স্ট্রিমিং নিয়ে ফের জটিলতা হল। বৃষ্টিমাথায় ভিজছেন চিকিৎসকরা, মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যসচিব তাঁদের বারবার অনুরোধ করছেন বৈঠকে যোগ দিতে। বলছেন, মিনিটস সই করে দেওয়া হবে। তবুও, দাবিতে অনড় চিকিৎসকরা। শেষমেশ ভেস্তেই গেল বৈঠক।

পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ, স্নায়ুযুদ্ধে এদিন সকালে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এরপর কী হবে? তাকিয়ে ছিল সব পক্ষই। কিন্তু কোনো সমাধানসূত্রেই পৌঁছনো গেল না।

গত মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে কাজে ফিরতে হবে জুনিয়র ডাক্তারদের এমন নিদান দিয়েছিল স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট। চিকিৎসকরা কাজে তো ফেরেননি বরং ৬টি দাবি সামনে রেখে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধর্না শুরু করেছিলেন। দাবিগুলি ছিল - ১) মহিলা চিকিৎসকের খুনের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, ২) উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের লিখিতভাবে পদত্যাগ, ৩)২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিহত চিকিৎসকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ৪) রাজ্যের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, ৫) আন্দোলনরতদের জুনিয়র চিকিৎসকদের উপর অত্যাচারের জন্য কলকাতা পুলিসকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে,৬) কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে পদত্যাগ করতে হবে।

জুনিয়র ডাক্তারদের দাবির উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, আলোচনার পথ খোলা আছে কিন্তু গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রশাসনকে সরকারি কর্মচারীকে রাতারাতি অপসারণের নিদান দেওয়া অগণতান্ত্রিক। চলতে থাকে স্নায়ুর যুদ্ধ। চিকিৎসকরা আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। তাঁদের ওপর নাগরিক সমাজের যে বিপুল আস্থা আছে তা বোঝা যায় নাগরিক সমাজেরও একটা বড় অংশ তাঁদের সাথে রাত জাগতে শুরু করলে। কখনও মাথার উপর ত্রিপল, কখনও বস্ত্র, কখনও খাওয়ার একটানা চিকিৎসকদের জুটিয়ে গেছেন নাগরিক সমাজ।

এমন ঘটনা চলাকালে দু'টি বিষয় সামনে আসে যা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রথমত, বিজেপি অফিসে কিছু ছাত্রকে দেখা যায়। তৃণমূল সমর্থকরা বলতে থাকেন যে বিজেপির সঙ্গে ছাত্রদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কলতান দাশগুপ্ত-র অডিও ক্লিপ সামনে আসে। তাতেও যথেষ্ট অস্বস্তিতে পরে বাম শিবির। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, এই অডিওর সত্যতা যাচাই হয়েছে। জুনিয়র ডাক্তাররা অবশ্য রাজনৈতিক যোগাযোগের তত্ত্ব প্রথম থেকেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, তাঁরা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ফিরিয়েছেন,অগ্নিমিত্রা পালকে ফিরিয়েছেন এবং অধীর চৌধুরীকেও ফিরিয়েছেন। ফলে এগুলি তাঁদের আন্দোলনকে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু স্নায়ুর যুদ্ধ চলছিলই। পর পর দু'বার মমতা বন্দোপাধ্যায়কে অপেক্ষা করিয়ে চাপ রাখার এই কূটনীতিতে এগিয়েই গিয়েছিলেন আসলে জুনিয়র ডাক্তাররাই।

কিন্তু নিজের পালে হাওয়া টানার ক্ষেত্রে এ দিন নতুন কৌশল নেন মমতা। আজ সকালে হঠাৎ সরাসরি জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে চলে যান মমতা। সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের ডিজি রাজীব কুমারও। সেখানে তিনি ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'আমার নিরাপত্তাজনিত নানা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি নিজে ছুটে এসেছি। আপনাদের আন্দোলনকে কুর্নিশ জানাচ্ছি। আমি আপনাদের ব্যথা বুঝি। আমিও ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছি।'

মনে পড়তে পারে হোক কলরব আন্দোলনের কথা। সে সময়ও আন্দোলন যখন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে মমতা নিজেই রণাঙ্গনে প্রবেশ করেন। এবং আন্দোলনকারীদের আশ্বাস দিয়ে প্রশমিত করেন।

উল্লেখ করতে হবে, আরও একটি বিষয় প্রসারভারতীর প্রাক্তন অধিকর্তা, তৃণমূলের রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকার তাঁর ইস্তফাপত্রে বলেছিলেন, মমতা কেন আগের মতো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছেন না। ক্ষেত্রে কি মমতা নিজের ইতিহাস স্মরণ করলেন? নাকি জহর সরকারের উপদেশ মেনে নিলেন? উপদেশ মেনে নিয়েই কি পৌঁছে গেলেন জুনিয়র ডাক্তারদের মাঝে? এবং তাঁদের সাথে আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলে জনমানসে এমন একটি বার্তা দিলেন, যে তিনি বরংবার মুখ্যমন্ত্রী পদের তোয়াক্কা না করে, চেয়ারের তোয়াক্কা না করে চিকিৎসকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তিনি বার বার কথাবার্তার দরজা খোলা রাখছেন। 'আমি ইস্তফা দিতে রাজি আছি' এমন কথাও শোনা গিয়েছিল মমতার মুখে। অর্থাৎ বার্তা  দিয়েছেন, তাঁর পদের লোভ নেই, তিনি চেয়ার থেকেও নেমে আসতে পারেন। আলোচনার দরজা খোলা। এমনকি, জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মনোযোগ দিয়ে শোনা হবে, আসতে আসতে তাঁদের দাবি মানা হবে এমন কথাও বলেছেন মমতা। সুতরাং এরপর যদি জুনিয়র ডাক্তাররা মমতার সঙ্গে দেখা না করেন তাহলে চিকিৎসকদের সদিচ্ছা নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন উঠবে, সেই পরিসর তৈরি করে স্নায়ুযুদ্ধে এগিয়ে গিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু এই মুহূর্তে যখন আরও একবার বৈঠক মাঠে মারা গেল, মমতা না জুনিয়র ডাক্তার, কার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে জনতা, পরিষ্কার হবে কিছুক্ষণেই।

More Articles