দেশজুড়ে মসজিদের তলায় মন্দির থাকার বিজেপির দাবির আসল রহস্য কী?
Sambhal Jama Masjid: ১৯ নভেম্বর সম্ভল জেলা আদালতে দায়ের করা পিটিশনে বলা হয় সম্ভল মসজিদটি সেই আমলে শ্রীহরি মন্দির নামক এক হিন্দু মন্দিরকে ধ্বংস করে তৈরি হয়েছিল।
হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও রাষ্ট্রের আনুকুল্যে অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপনা সম্পূর্ণ হবার পর দেশ জুড়ে মসজিদ খুঁড়ে তার তলায় প্রাচীনকালের হিন্দু মন্দিরের অবশেষ আছে কিনা তা অনুসন্ধান করার দাবি প্রবল হয়ে উঠছে। একটু নজর করলে দেখা যাবে, এই দাবিগুলোকে আদালতের দরজায় নিয়ে যাবার পেছনে একটি পরিকল্পিত কৌশল কাজ করছে। এই কৌশলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইনের [The places of worship (special provisions) Act,1991] সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে তাকে বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সহ তিন সদস্যের বেঞ্চ এই সংক্রান্ত মামলাগুলির শুনানির প্রশ্নে স্থগিতাদেশ দিলেও, তা মূল মামলার ফয়সালা হওয়া পর্যন্ত কার্যকরী থাকবে।
এই নতুন করে 'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে' জিগির কি ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তার তরতাজা উদাহরণ হলো সম্ভল মসজিদের ঘটনা। উত্তরপ্রদেশের এক জনপদ সম্ভল। ধর্মপরিচয়ে এখানকার ৭৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান ও ২৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে দুই ধর্মের মানুষ সম্প্রীতিতে বাঁচেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে এখানে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস নেই। ১৫২৬ সালে মুঘল বাদশাহ বাবরের এক উচ্চ পদস্থ কর্মচারী হিন্দু বেগ এখানে জামা মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বাবরের আমলে আরও দুটো মসজিদের নির্মাণ হয়েছিল — অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ এবং পানিপথে কাবুলি বাগ মসজিদ। এবছর ১৯ নভেম্বর সম্ভল জেলা আদালতে হরিশংকর জৈন নামে এক আইনজীবী এক সিভিল স্যুট ফাইল করেন, যাতে বলা হয় এই মসজিদটি সেই আমলে শ্রীহরি মন্দির নামক এক হিন্দু মন্দিরকে ধ্বংস করে তৈরি হয়েছিল। পিটিশনে বলা হয়, এই মসজিদটি এক গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিসৌধ যা ১৯৫৮ সালের অ্যানশিয়েন্ট মনুমেন্টস অ্যান্ড আর্কিওলজিকাল সাইটস অ্যান্ড রিমেইনস অ্যাক্ট দ্বারা সংরক্ষিত এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এই স্মৃতিসৌধকে সবার জন্য খুলে দিতে দায়বদ্ধ। আবেদনকারীরা তাদের দাবির সপক্ষে 'বাবরনামা', 'আকবরনামা' এবং ব্রিটিশ আমলে এএসআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল এ.কানিংহামের প্রতিবেদনের উল্লেখ করেন।
আবেদনকারী আইনজীবী হরিশংকর জৈনের পরিচয় এ সুযোগে দেওয়া যেতে পারে। সত্তর বর্ষীয় এই আইনজীবী আদতে এলাহাবাদের (প্রয়াগরাজ) বাসিন্দা এবং বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি মামলায় তিনি হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিত্ব করেন। এযাবৎ এই ধরনের মামলা তিনি প্রায় শ'খানেক করেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণ জন্মভূমি-শাহি ইদগা মামলা, জ্ঞানবাপী মসজিদ মামলা, কুতুব মিনার হিন্দু মন্দির সংক্রান্ত মামলা এবং মধ্যপ্রদেশের ভোজশালায় কমল মৌলা মসজিদের তলায় সরস্বতী মন্দির সংক্রান্ত দাবি। হরিশংকর জৈন 'হিন্দু ফ্রন্ট ফর জাস্টিস' সংগঠনের সভাপতি।
আরও পড়ুন- জ্ঞানবাপী আসলে ব্যর্থতা লুকনোর গোদি-মিডিয়া পালা
আদালতে পিটিশনটি ওঠার পর বিচারপতি আদিত্য সিং মামলাটি শোনেন ও তৎক্ষণাৎ মসজিদে সমীক্ষা করে ২৯ নভেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবার নির্দেশ দেন। ওই একই দিনে রায় বেরনোর দু' ঘণ্টা পরেই আদালত নিযুক্ত অ্যাডভোকেট কমিশনার এবং সমীক্ষাকার্যের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রমেশ রাঘব তিরিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মসজিদে দলবল নিয়ে যান। এই বিদ্যুৎগতিতে আদালতের নির্দেশ পালনের ইতিহাস সত্যিই বিরল! বিষয়টি সম্পর্কে অবগত না থাকা এবং পাল্টা আইনি পদক্ষেপ না থাকার কারণে সেদিন সমীক্ষার কাজ হয়। এই বিষয় নিয়ে মসজিদ কমিটি যখন আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আবার ২৩ নভেম্বর মধ্যরাতে তাদের স্থানীয় সার্কেল ইন্সপেক্টর জানান, পরদিন ভোরবেলায় আবার সমীক্ষা শুরু হবে। সকালবেলায় টিম পৌঁছে যায় যখন সকালের প্রার্থনার জন্য বহু মুসলিম সেখানে উপস্থিত। ইতিমধ্যে তেতে থাকা সম্ভলে প্রচুর মানুষ প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। সেই ক্ষুব্ধ প্রতিবাদে পুলিশ গুলি চালায়, পাঁচজন মুসলিম যুবকের মৃত্যু হয়। একদিন সমীক্ষার পর আবার কেন কয়েকদিনের মধ্যে পুনরায় সমীক্ষার প্রয়োজন পড়ল, কেনই বা উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া গেল না, কেনই বা মসজিদ কমিটিকে প্রায় অন্ধকারে রেখে মধ্যরাতে সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো— এই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।
পূর্বে উল্লেখিত প্যাটার্নটি কীভাবে কাজ করছে বোঝার জন্য পূর্ব উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরের অটলা মসজিদের সাম্প্রতিক বিতর্কের দিকে নজর ফেরাতে হবে। নথিবদ্ধ ইতিহাস অনুযায়ী, ১৩৭৬ সালে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক এই মসজিদের কাজ শুরু করেন যা সম্পূর্ণ করেন জৌনপুরের শাসক ইব্রাহিম শাহ সাকরি, ১৪০৮ সালে। জামা মসজিদ হিসাবে উত্তর প্রদেশের সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডে এই মসজিদ নিবন্ধীকৃত। এক্ষেত্রেও আমরা দেখব, স্বরাজ বাহিনী অ্যাসোসিয়েশন নামের এক অস্তিত্ব বিহীন সংগঠনের পক্ষে জনৈক সন্তোষ কুমার মিশ্র আদালতে পিটিশন ফাইল করে দাবি করেছেন যে, প্রাচীনকালে রাজা বিজয়চন্দ্র এখানে অটলা দেবীর মন্দির স্থাপন করেন। সেই মন্দির পিটিশন অনুযায়ী, সনাতন ধর্মীদের কাছে পবিত্র বলে পূজিত হতো। ফিরোজ শাহ তুঘলক সেই মন্দির ভেঙে মসজিদ স্থাপন করেন। এমনকী পূর্ববর্তী কথিত মন্দিরের থামগুলোর উপরেই এই মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এই পিটিশনের নতুন বিষয় হলো, সেখানে এখনও না কি হিন্দুরা প্রতীকী পুজো করেন। মসজিদ কমিটির পক্ষে ফৈয়াজ আহমেদ জানিয়েছেন, ১৩৯৮ সাল থেকে এটি মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত, এর আগে কখনও এটা মন্দির হিসাবে দাবি ওঠেনি। পিটিশনের দাবি, সেখানে হিন্দুদের ভোগ, সেবা ও কীর্তনের অনুমতি দিতে হবে এবং অহিন্দুদের (অর্থাৎ মুসলমান) এখান থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। এখানেই সম্ভলের অনুকরণে আদালতের কাছে অ্যাডভোকেট কমিশনারের মাধ্যমে সমীক্ষার দাবি জানানো হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি এলাহাবাদ কোর্টের বিচারাধীন। উদাহরণ দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই, শুধু উল্লেখ থাক, জ্ঞানবাপী মসজিদের ক্ষেত্রে এটা শুরু হয়, তারপর কৃষ্ণ জন্মভূমি-শাহি দরগা হয়ে গোটা উত্তরপ্রদেশে বর্তমানে এই দাবি ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
বাবরি মসজিদের ঘটনার পর এই ধরনের দাবি যে সুনামির চেহারা নেবে একথা আন্দাজ করেই, তা রুখবার জন্য উপাসনাস্থল আইন (১৯৯১) পাশ হয়েছিল। অযোধ্যাকে একমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে চিহ্নিত করে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট যে ধর্মীয় স্থানের যা চরিত্র ছিল তাই বজায় রাখা হবে। নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ধর্মস্থানের চরিত্র পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনও নতুন বিবাদ আদালতগ্রাহ্য হবে না। ২০১৯ সালে বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত বিতর্কিত রায়েও কিন্তু বিচারপতিরা ধর্মীয় স্থানে স্থিতাবস্থা রাখার আইনটির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে তা সব পক্ষকে মেনে চলার কথা বলেন:
"Historical wrongs can not be remedied by the people taking law in their own hands........ In preserving the characters of place of worship, parliament has mandated in no uncertain terms the history and its wrongs shall not be used as instrument to oppress the present and future"।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, উপাসনাস্থল আইন-১৯৯১ লাগু থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের পিটিশন আদালত গ্রাহ্য হচ্ছে কেন? আইন বলছে, ধর্মস্থানের চরিত্র বদল সংক্রান্ত কোনও আবেদনের জন্য আদালতের দরজা চিরতরে বন্ধ, আবার পরিসংখ্যান বলছে এই ধরনের প্রায় শতাধিক মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে গৃহীত হয়েছে। এই বৈপরীত্য বুঝতে হলে ২০১৪ সালে ভারতে 'হিন্দু হৃদয় সম্রাট' নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হবার পরে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থার দিকে চোখ ফেরাতে হবে। এই সময়পর্বে সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গৈরিকীকরণ শুরু হয়েছে, বিচার বিভাগ তার ব্যতিক্রম নয়। নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের একাংশ প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদীদের এজেন্ডার পক্ষে সওয়াল করছেন যা অভূতপূর্ব। উপাসনাস্থল আইনকে দুর্বল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে খোদ বিচার বিভাগের মধ্যে থেকেই।
আরও পড়ুন- রাম মন্দিরের রায় দিতে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়?
এইবারের গল্পের শুরু ২০২২ সালের মে মাসে, যখন বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষার অনুমতি দেন দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়:
"ascertainment of a religious character of a place, as a processual instrument, may not necessarily fail foul of the act"।
চন্দ্রচূড়ের এই রায় আদতে এক প্যান্ডোরার বাক্স খুলে ফেলল যা আগামীদিনে আরও দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করবে। সম্ভল কাণ্ড তার এক উদাহরণ মাত্র। এই বিচার বিভাগের এক অংশ কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের চরিত্র বদল করতে চায় তা সম্প্রতি এক সেমিনারে স্পষ্ট করেছেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শেখর কুমার যাদব,
"ভারত চলবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী। এটি আইন ও ন্যায় বিচারের মূলনীতি। এটা বলতে কোনও বাধা নেই যে এটাই দেশের আইন।সংখ্যাগুরুদের জন্যই দেশের আইন চলে। পরিবার বা সমাজের আঙ্গিকে দেখুন, সংখ্যাগুরুদের উন্নতি এবং সুবিধা যেটায় হয়, সেটাই দেশের আইনে গ্রহবযোগ্য"।
এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটটি বিশ্লেষণ করলে সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক স্থগিতাদেশ নিয়ে উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ থাকে না। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ শুধুমাত্র জানিয়েছে, উপাসনাস্থল নিয়ে আপাতত কোনও মামলা করা যাবে না। যতদিন আইনটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দায়ের করা আবেদনগুলির শুনানি চলছে, ততদিন নতুন কোনও মামলা করা উচিত নয়। একইসঙ্গে নিম্ন আদালতগুলিকে উপাসনাস্থলের অবস্থা নিয়ে কোনও ধরনের রায় বা নির্দেশ দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। এখানে স্পষ্ট যে, মূল ছকটি হলো সংবিধানের আর্টিকেল ২৫-এ উল্লেখিত ধর্মাচরণের অধিকারকে ব্যবহার করে পার্লামেন্টে করা আইনটিকে অবৈধ ঘোষণা করা। বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাটিকে যে কৌশলে বিচার বিভাগ ন্যায্যতা দিয়েছে,তারপর থেকে বিভেদকামী শক্তি রক্তের স্বাদ পেয়েছে। এখন উপাসনাস্থল-১৯৯১ আইনটিকে বাতিল করতে পারলে তাদের প্রকল্পিত হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন আরও গতি পাবে। আজ তাই এই আইনটিকে রক্ষার দাবিতে গণতন্ত্রকামী মানুষকে সরব হতেই হবে।