মেঘের মধ্যে বন্দি ৪০ মিনিট! ৬৪ বছর আগে যে ভয়াবহ ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে...

40 Minutes Within the Cloud: দ্য ম্যান হু রোড দ্য থান্ডার বইটি লিখেছিলেন তিনি, নিজের সেই ৪০ মিনিটের অভিজ্ঞতা নিয়ে।

মেঘ সাধারণত কী কী ধরনের হয়? সাধারণ অনেকেই বলবেন সাদা মেঘ, কালো মেঘ, বৃষ্টির মেঘ। ছোটবেলায় ভূগোল পড়ে মনে রাখা কেউ কেউ নিম্বাস, কিউমুলোনিম্বাস অবধি যাবেন। উড়োজাহাজে চেপে মেঘের উপর দিয়ে যাওয়ার কথাও বলবেন অনেকে। স্বভাব-কবিরা দার্জিলিং অবধি গিয়ে মেঘ মাখার কথা বলবেন, আরও অফবিট গন্তব্যে গিয়ে জানলা খুলেই ঘরে মেঘ ঢুকে যাওয়ার কথা বলবেন। কিন্তু ধরুন, মেঘের মধ্যে আটকা পড়ে গেলেন আপনি! বিষয়টা যতই রোম্যান্টিক শোনাক না কেন, আদতে তা নয় একেবারেই। কিন্তু মেঘের মধ্যে আটকে যাবেনই বা কীভাবে? মেঘ তো আর উড়ন্ত বেলুন না যে ভেতরে ঢুকে থাকা যাবে! ঢুকতে গেলেই ধপাস! ভিজেও যাবেন দিব্যি। কিন্তু আটকে পড়েছিলেন এক ব্যক্তি, একটি কিউমুলোনিম্বাস মেঘের মধ্যে।

কিউমুলোনিম্বাস মেঘ (Cumulonimbus) হচ্ছে মেঘ জগতের ভিলেন। এই মেঘ অশান্ত, বিশাল বিশাল তার আকার। যতরাজ্যের বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি সব তৈরি করতে পারে এই কিউমুলোনিম্বাসই। বেশিরভাগ মেঘই ২,০০০ মিটার (৬,৫০০ ফুট) পর্যন্ত পৌঁছায় না কিন্তু কিউমুলোনিম্বাস মেঘগুলি ২০,০০০ মিটার (৬০,০০০ ফুট) পর্যন্ত উপরে উঠে যায়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম র‌্যাঙ্কিন হলেন সেই দু'জন ব্যক্তির মধ্যে একজন যিনি একবার মেঘের মধ্যে আটকে পড়েছিলেন। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলে গিয়েছেন তিনি। সাল ১৯৫৯, দিনটা ছিল ২৬ জুলাই। লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম র‌্যাঙ্কিন এবং তাঁর উইংম্যান হার্বার্ট নোলান তাঁদের F-8 ক্রুসেডার জেট নিয়ে দক্ষিণ ক্যারোলিনার দিকে উড়ে যাচ্ছিলেন। সামনে যে ঝোড়ো বাতাস ও মেঘ রয়েছে সেই সম্পর্কে সচেতনই ছিলেন তারা। তাই প্রায় ১৪,৩০০ মিটার (৪৭,০০০ ফুট) উপর দিয়ে উড়ছিলেন তারা, মেঘেদের অনেক উপর দিয়ে।

আরও পড়ুন- পৃথিবীর উচ্চতম সেতুর উপর দিয়ে বন্দে ভারত! মেঘের উপর দিয়ে এবার যে গন্তব্যে যাবে ট্রেন

নীচে তখন বেজায় ঝড়। ঝড়ের উপরে রয়েছেন এই দু'জন। হঠাৎ র‍্যাঙ্কিনের ইঞ্জিনের গোলযোগ দেখা দেয় এবং এটি বন্ধ হয়ে যায়। এবার উপায়? প্রেসার স্যুট নেই সঙ্গে, বাইরে তখন -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। বাতাসে এত কম অক্সিজেন যে শ্বাস নিতেই পারছিলেন না র‍্যাঙ্কিন। কিন্তু বেরোলেই মরণ! সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ তিনি বুঝতে পারলেন, না বেরনো ছাড়া উপায় নেই। তিনি ইজেকশন হ্যান্ডেল টেনে ১৪,৩০০ মিটারে নিয়ে গেলেন। এই করতে গিয়ে হাত থেকে গ্লাভস গেল খুলে। এবার একেবারে শিরে সংক্রান্তি!

অবিলম্বে, তাঁর চোখ এবং কান থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে। তাত্ক্ষণিক ডিকম্প্রেশনের জন্য পেট ফুলতে শুরু করে। গ্লাভস হারিয়ে ফেলায় হিমশীতল তাপমাত্রায় তার হাত জমে যায়। র‍্যাঙ্কিন জরুরি অক্সিজেন এবং একটি প্যারাসুট সহ একটি কিউমুলোনিম্বাস মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়েন, ওই প্যারাসুট বজ্রবিদ্যুৎ বা ঝড়ের মাঝখানে মানুষকে বাঁচানোর মতো শক্তপোক্তই নয়। প্যারাসুট কর্ড টানেননি, র‍্যাঙ্কিনের উপস্থিত বুদ্ধি বলছিল, টানলেই মৃত্যু। তিনি ব্যারোমিটারটিকে কাজে লাগালেন যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্যারাসুটটিকে ছেড়ে দেবে যখন তার উচ্চতা প্রায় ৩,০৪৮ মিটারে (১০,০০০ ফুট) নেমে যাবে। তিনি আশা করেছিলেন, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বা জমে যাওয়ার আগেই বজ্রপাত থেকে বেরিয়ে আসবেন তিনি।

র‍্যাঙ্কিন মেঘের মধ্যেই থেকে গেলেন। চরম আবহাওয়ার মেঘের মধ্যে প্রতি পল এক এক যুগের মতো মনে হয়েছিল! বিজ্ঞানীরা এই হিংস্র ঝোড়ো মেঘের অভ্যন্তরীণ কার্যকারিতা সম্পর্কে খুব কমই জানেন, কিন্তু ক্রমবর্ধমান গরম বাতাস এবং শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাতের ফলে মানুষকে নিমেষে শেষ করে দেওয়ার জন্য এই মেঘ যথেষ্ট।

আরও পড়ুন- আকাশে ৪৮ কেজি নুন ছড়িয়ে বৃষ্টি ঘটায় ‘মেঘধরা’ দল! অসম্ভবকে বাস্তব করেছে এই দেশ

অবশেষে প্যারাসুটটি খুলে গেল। র‍্যাঙ্কিন ভাবলেন ৩,০৪৮ মিটারের কাছাকাছি এসে গিয়েছেন কিন্তু কোথায় কী! ভিতরের চাপগুলির ফলে ব্যারোমিটারের পাঠ গুলিয়ে যায়, র‍্যাঙ্কিন সরাসরি উপরের দিকে উঠতে থাকেন। কখনও ওঠেন, কখনও নামেন। অবশেষে ঝড় থেকে মুক্তি পেলেন। নামতে নামতে এক গাছে আটকে পড়লেন, গাছের দাল ভেঙে, মাথায় চোট পেয়ে সোজা নীচে মাটিতে। ঘড়ি দেখলেন। সময় তখন সন্ধা ৬:৪০ মিনিট। মানে প্রায় ৪০ মিনিট মেঘের মধ্যে ছিলেন র‍্যাঙ্কিন। ডিকম্প্রেশন ইনজুরি এবং অন্যান্য ছোটখাটো আঘাত ছাড়া তুলনামূলক অক্ষত অবস্থাতেই বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।

এর প্রায় ৫০ বছর পরে, ২০০৯ সালে ৮৮ বছর বয়সে র‍্যাঙ্কিন মারা যান। দ্য ম্যান হু রোড দ্য থান্ডার বইটি লিখেছিলেন তিনি, নিজের সেই ৪০ মিনিটের অভিজ্ঞতা নিয়ে।

More Articles