ভারতেও কি বাধ্যতামূলক হবে ভোট দেওয়া! বোলসেনারোর হার সবক শেখাবে বিজেপিকে?
Lula da Silva: যখনই দেখা গেছে, শাসকদল নিজেদের সমর্থকদের ভোট দেওয়াতে উৎসাহী করতে পারছেন না, তখনই তারা হারার ভয় পাচ্ছেন, আর তখনই তারা ভোটদানকে বাধ্যতামূলক করতে চাইছেন
২০০১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে গুজরাতের একটা ছোট কোম্পানি এক সাংবাদিককে ডেকে পাঠায় তাদের বেঙ্গালুরুর অফিসে। বলা হয়, মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন সমস্ত গুজরাতবাসীর জন্য একটা চিপ লাগানো স্মার্ট কার্ড তৈরি করতে, যার মধ্যে সেই ব্যক্তির সমস্ত তথ্য, মানে নাম, ঠিকানা, বয়স, রক্তের গ্রুপ ইত্যাদি থাকবে। এই কার্ডটি খুব তাড়াতাড়ি অর্থাৎ আগামী দু’মাসের মধ্যে তৈরি করে ফেলতে হবে, সেই জন্যই এই মিটিং। তাঁরা সেই সাংবাদিককে আরও বলেন যে, গুজরাতের অফিসাররাও দিন-রাত এক করে কাজ করছেন। সরকারি সুযোগ সুবিধা কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে এই কার্ডটির মাধ্যমে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে মোদি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং তারপর তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ীই কাজটা শুরু হয়েছে। এ তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প।
এর ঠিক ৩ মাস পর গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকাণ্ড। তার কিছুদিন পর থেকে শুরু হয়ে যায় ‘গুজরাত দাঙ্গা’। কিছু কিছু জায়গায় তাণ্ডব চলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে। যে সমস্ত মিডিয়া এই বিষয়ে রিপোর্ট করেছে এবং যতগুলো তদন্ত কমিশন বসেছে প্রত্যেকেই জানিয়েছে কীভাবে তালিকা ধরে ধরে মিলিয়ে, বাড়ি থেকে টেনে বের করে মারা হয়েছে। বাড়ি থেকে টেনে বের করে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং তারপর সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে মুসলমানদের বাড়ির দরজায় ঢ্যাঁড়া চিহ্ন দেওয়া হয়, তারপরের দিন সেই বাড়িগুলোকেই ধরে ধরে আক্রমণ করা হয়। কীভাবে মানুষকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে তা আমরা দেখেছি। বাকিটা ইতিহাস।
এটা যদিও জানা যায় না যে, স্মার্ট কার্ডগুলো কোন জরুরি ভিত্তিতে বানানো হয়েছিল কিন্তু সেগুলো এই দাঙ্গা এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি আজ? তারপরে গুজরাতকে দেখিয়ে বিজেপির পক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার কাজ শুরু হয়। ‘গুজরাত মডেল’ বলে একটি বড় ফানুস ছাড়া হয়, যাকে ধীরে ধীরে এমনভাবে দেখানো হয় যে দেশের এক অংশের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, এমন একজন প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন যিনি যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তাঁকে সামনে রেখেই দেশের বিকাশ হবে। একদিকে গুজরাত হয়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদীদের পরীক্ষাগার আর অন্যদিকে পোষা মিডিয়ার দৌলতে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি।
আরও পড়ুন- ব্রাজিলের গদি উল্টোনো কতটা বাঁচাবে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনকে
এরই মধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ২০০৯ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে আসে ‘আধার’ প্রকল্প। বলা হয়, যাঁদের কোনও পরিচয়পত্র নেই, তাঁরা একটি পরিচয়পত্র পাবেন। তখন কিন্তু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রের প্রস্তাবিত আধারের বিরোধিতা করেন, কারণ তাঁর কাছে তখন গুজরাতের সেই স্মার্ট কার্ডের উদাহরণ আছে। তিনি ভালো করেই জানেন, এই ধরনের তথ্যভাণ্ডার দিয়ে কী কী করা সম্ভব? কীভাবে বোঝা সম্ভব, কে বা কারা সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন এবং তা সত্ত্বেও সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করছেন এবং ভোট দিচ্ছেন না। তাই যখন নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন তার পরে পরেই তিনি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে একজন মানুষের ফোন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সহ সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করার কাজে জোর দেন। বলা হয়, সরকারি সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য আধার বাধ্যতামূলক। ১০০ দিনের কাজ বা গ্যাসের ভর্তুকি বা অন্য যে কোনও প্রকল্প যার মাধ্যমে সরকারি টাকা একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যাঙ্কে পৌঁছবে তার অন্যতম চাবি হচ্ছে আধার। ধীরে ধীরে আধার প্রায় সমস্ত নাগরিকের সমস্ত পরিচয়পত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এমনকী যেসব ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধা যুক্তও নয়, যেমন ব্যক্তিগত ট্যাক্স জমা দেওয়ার জন্য প্যান বা ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনেও আধারকে চাপ দিয়ে যুক্ত করা হয়।
সর্বোচ্চ আদালত তাদের রায়ে যদিও জানিয়েছে, শুধুমাত্র সরকারি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্র ছাড়া আর অন্য কোনও কিছুতে আধারকে যুক্ত করা যাবে না, তা সত্ত্বেও এই সংযুক্তির কাজ করা হয়। এই মুহূর্তে আইন করে আধার এবং ভোটার কার্ডের সংযোগের কথা বলা হয়েছে এবং নির্বাচক তালিকা শুদ্ধিকরণের নামে, সেই কাজ পুরোদমে চলছে।
এই ধান ভানতে শিবের গীত কেন গাইতে হলো? কারণ আবারও গুজরাত নির্বাচন আসছে। যদিও নির্বাচন কমিশন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এখনও গুজরাত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেনি কিন্তু নরেন্দ্র মোদির তৎপরতা এবং একের পর এক প্রকল্পের উদ্ধোধনের ঢল দেখে সবাই বুঝতে পারছেন সামনেই গুজরাত বিধানসভার নির্বাচন। যদিও এতদিন অবধি কোনও বিরোধী দলই বিজেপির হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরাতে পারেনি, কিন্তু এবার যেন মনে হচ্ছে সব কিছু বিজেপির সুরে বাজছে না। তাই এবার আবার নতুন একটা চমক আনতে চলেছে বিজেপি। যদিও সরাসরি বিজেপি এই চমক আনছে না, কিন্তু নির্বাচন কমিশন, যা স্বশাসিত সংস্থা হলেও শাসক দলের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া এক পা চলে না, তারা এবার বেশ কিছু কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে মৌচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেই চুক্তিতে কী আছে?
বলা হয়েছে, শহরাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে মানুষ রাজনীতি নিয়ে কথা বললেও, সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে মত দিলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইছেন না। নির্বাচন কমিশন, তাই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে বলেছে, কারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না, তাঁদের নাম সর্বসমক্ষে আনতে হবে। তাঁদের ওয়েবসাইট এবং নোটিশবোর্ডে সেই কর্মীদের নাম টাঙিয়ে দিতে হবে, যাতে অন্যদের বোঝানো যায়, যে ওই মানুষরা গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ উৎসবে অংশ নিতে চান না, এবং তাঁরা গণতান্ত্রিক রীতি নীতির বিরুদ্ধে। শুধুমাত্র বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে এই কথা বলা হয়নি, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম চালু হবে এই বারের নির্বাচনে। এমনিতে শুনতে বেশ সচেতনতামূলক প্রকল্প মনে হলেও আসলে এর পিছনে এক অন্য উদ্দেশ্য আছে। গত নির্বাচনগুলিতে যাঁরা ভোট দেননি, তাঁদের নাম এবং অন্যান্য তথ্য হাতে পাওয়া গেলে, নির্বাচন কমিশন কি নিশ্চিত করে বলতে পারে যে, এই তথ্য শাসক দল অন্য ভাবে ব্যবহার করবে না? ওয়েবসাইটে বা অন্য যে কোনও জায়গা থেকে যদি এই তথ্য পাওয়া যায়, কারা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন না, তাহলে কি সেই তথ্য সংশ্লেষণ করে এটা বোঝা সম্ভব নয়, কোন নির্বাচক কী কারণে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না? আধারের সঙ্গে অন্যান্য সমস্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা যখন সংযোগ করা আছে, যদি কোনও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায় যে তিনি ভোট দিচ্ছেন না, তাহলে তাঁর সরকারি সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া কি খুব কঠিন কাজ শাসকদলের পক্ষে? ২০০১ সালে এক ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল, আর ২০২২ সালে তারই একটি উন্নত সংস্করণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- হিন্দির বিরুদ্ধে, বাংলার পক্ষে রক্তঝরা আন্দোলন! যেভাবে জন্মেছিল পুরুলিয়া জেলা
কিন্তু প্রশ্নটা কি শুধু তথ্য সংগ্রহ বা তার সংশ্লেষণ সংক্রান্ত? প্রশ্নটা কি গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্তও নয়? ভারতের মতো দেশে কি একজন নাগরিকের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক? গত ২২ জুলাই ২০২২ ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সভাপতি এবং সাংসদ, দীপক প্রকাশ ‘বাধ্যতামূলক ভোটিং বিল ২০২২’ রাজ্যসভায় পেশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও মত দিয়েছেন যে, সংবিধানের ১১৭ নম্বরের ৩ নম্বর উপধারা অনুযায়ী, এই বিষয়ে যাতে চিন্তা ভাবনা করা হয়। এই বিল পেশ করার সময়ে মাননীয় সাংসদ, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, সাইপ্রাস, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে সহ নানান দেশের উদাহরণ দিয়েছেন, যেখানে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু নাগরিকেরা ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করছেন না, এবং দেখা যাচ্ছে, যে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ছে না কোনও নির্বাচনেই, তাই অন্যান্য দেশের মতো এই দেশেও শাস্তির বিধান রাখতে হবে। ২ দিনের জেল অথবা রেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া, বা সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে ১০ দিন বেতন না দেওয়া বা কাজে পদোন্নতি ২ বছর পিছিয়ে দেওয়া বা ৫০০ টাকা জরিমানাও করা হতে পারে। আবার উল্টোদিকে কোনও ব্যক্তি যদি কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ভোট দেন, তাহলে তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে। এর আগে ২০১৯ সালেও এইরকম প্রস্তাব আনা হয় বিজেপির অন্য এক সাংসদ জনার্দন সিং সিগ্রিওয়ালের পক্ষ থেকে কিন্তু তা বাতিল করা হয় মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে। বলা হয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা একজন ব্যক্তি নাগরিকের অধিকার, তাঁর কর্তব্য। গুজরাতের বিধানসভাতেও এর আগে বাধত্যামূলক ভোটিং নিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ করানো হয়, কিন্তু তাতে গুজরাত উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে স্থগিতাদেশ আনা হয়।
শেষ করা যাক ব্রাজিলের উদাহরণ দিয়ে। ব্রাজিলে বাধ্যতামূলক ভোটিং ব্যবস্থা চালু আছে। ল্যাটিন আমেরিকায় এই বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক চলছে। ২০১০ সালে রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেশেন হেমকে এবং বনি মিগুইড বলে দু’জন গবেষক, একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যাতে বোঝা যায় কেন বাধ্যতামূলকভাবে ভোট দেওয়ানোতে শাসকদল বেশি উৎসাহী? বিভিন্ন দেশ, যেখানে এই ব্যবস্থা চালু আছে, সেখানকার শাসকেরা মনে করেন, যাঁরা ভোট দিতে আসছেন না, তাঁরা আসলে তাঁদের সমর্থক নন। যখনই দেখা গেছে, শাসকদল নিজেদের সমর্থকদের ভোট দেওয়াতে উৎসাহী করতে পারছেন না, তখনই তারা হারার ভয় পাচ্ছেন, আর তখনই তারা ভোটদানকে বাধ্যতামূলক করতে চাইছেন।
তাহলে কি আমাদের শাসকরাও প্রথমে গুজরাতে এই পদ্ধতি নিয়ে এসে দেখতে চাইছেন, তাঁরা জেতেন কি না? এই পরীক্ষায় সফল হলে কি নির্বাচন কমিশন, যা ইদানিং শাসকদলের পুতুল হিসেবে প্রায় প্রমাণিত, সারা দেশে এই পদ্ধতি চালু করবে? এতো কিছু করেও, বোলসেনারো কিন্তু পরাজিত হয়েছেন, সমাজতান্ত্রিক শক্তি লুলার কাছে, এই কথাটা কি আমাদের শাসকদলের খেয়াল আছে? যাঁরা বাধ্য হয়ে যাবেন ভোট দিতে, তাঁরা শাসকদলকে ভোট দেবেন সে নিশ্চয়তা কি আছে? ব্রাজিলে বাধ্যতামূলক ভোট দেওয়ানোকে কার্যকর করতে গিয়েই কি বোলসেনারো হারলেন, এই প্রশ্নও কিন্তু ঘুরছে।