"মানুষকে ভুল বোঝাতে সঞ্জয়ের ফাঁসি চাইছেন মমতা!" বিস্ফোরক তিলোত্তমার বাবা
RG Kar Verdict: কেন আরজি কর কাণ্ডের রায়ের কপি বাংলায় অনুবাদ করে লিফলেট বানিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করবেন? কী অভিযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে? একান্ত সাক্ষাৎকারে তিলোত্তমার বাবা।
যে নামের পাশে ডিগ্রি বসানোর জন্য এত লড়াই, সেই নামটাই আজ মুছে গিয়েছে। তিলোত্তমা, অভয়া নাম দেওয়া হয়েছে মেয়ের। মিডিয়ার সামনে একথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আরজি করে ধর্ষিতা ও খুন হওয়া চিকিৎসকের মা। প্রায় ছয় মাস হলো মেয়েকে হারিয়েছেন। চোখের জল হয়তো শুকিয়েছে, কিন্তু মনের ক্ষত? সামান্য দর্জির দোকান চালিয়ে মেয়েকে ডাক্তার করার স্বপ্ন দেখেছিলেন সোদপুরের এক সাধারণ বাবা-মা। কিন্তু তার এত কাছাকাছি পৌঁছেও এক রাতে সবটা শেষ। গত ৯ অগাস্ট সকালে আরজি করের সেমিনার রুমে এক তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়ার নিথর দেহ উদ্ধার হয়। তারপরের ঘটনাক্রম সবারই জানা।
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে দাবানলের মতো আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার বুকে। দেশ ছাড়িয়ে সেই দহনের আঁচ পড়েছিল সারা বিশ্বে। নিজের বাড়ির মেয়ের সুরক্ষার প্রশ্নে শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জেও রাস্তায় নেমেছেন মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে। ক্ষোভে, দুঃখে রচিত হয়েছে অগুনতি স্লোগান। মহানগরীর বুক চিরে দেওয়াল লিখন হয়েছে বিচারের দাবিতে। ক্যামেরা ও বুমকে সঙ্গী করে সাক্ষী থেকেছি সেই চলমান ইতিহাসের। ১৪ অগাস্ট রাতের ও রাস্তার দখলকারীরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। স্বাধীনতার পর ফের ওই রাতে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলন চিত্রায়িত হলো। কিন্তু উপসংহারে কী পেলেন তাঁরা? আরজি করের ঘটনার ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার মুখে আদালতের রায়ের পর এখনও প্রশ্নের মুখে সুবিচার! খোদ বিচারপতিই রেখেছেন একগুচ্ছ প্রশ্ন।
১৮ জানুয়ারি ২০২৫। আরজি কর মামলার রায় ঘোষণা করেন শিয়ালদহ আদালতের বিচারপতি অনির্বাণ দাস। ২০ জানুয়ারি দোষী সাব্যস্ত সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সাজা ঘোষণা হয়। আরজি কর মামলার ১৭২ পাতার রায়ে 'ফ্যাক্ট' লিখতে গিয়ে বিচারপতি প্রথমেই লিখেছেন, “কালি দিয়ে নয়, চোখের জল দিয়ে টালা থানায় অভিযোগপত্র লিখেছিলেন নির্যাতিতার বাবা।”
আরও পড়ুন- ফাঁসি হলো না সঞ্জয় রায়ের! কেন আরজি কর ধর্ষণকাণ্ড বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা নয়?
আরজি করের ঘটনায় প্রতিটি মেয়ের বাবাই হয়তো নীরবে কেঁদেছিলেন। সরকারি হাসপাতালে সরকারের অধীনে কর্মরত থাকা অবস্থায় তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ, খুন স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যে এবং কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি মহিলারা এখন অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবেও কাজ করে থাকেন। রাতবিরেতে বাড়ি ফেরেন। রক্ষকই যদি ভক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করে, তাহলে তাদের নিরাপত্তা দেবে কে?
ডাক্তারি পড়ার জন্য আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি যে মেধাশ্রম করতে হয় একজন পড়ুয়াকে, সিভিক ভলেন্টিয়ার হতে গেলে তা করতে হয় না। ভালো 'সোর্স' থাকলেই চলে! রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের মতো এখানেও অযোগ্য প্রার্থী নিয়োগ হচ্ছে না তো? আরজি কর মামলাতেই সুপ্রিম কোর্ট সিভিক ভলেন্টিয়ার নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে রাজ্যকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিল। কিন্তু তারপরও কি সরকারের টনক নড়েছে? আদৌ নড়বে? আরজি কর কাণ্ড শুধু একটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নয়, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। প্রশ্নচিহ্ন উঠেছে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে।
আদালতের রায় শুনে কী প্রতিক্রিয়া নির্যাতিতার পরিবারের! সুবিচার পেলেন অভয়া? ইনস্ক্রিপটকে নির্যাতিতার বাবা জানিয়েছেন, বিচারে খুশি হওয়ার কোনও জায়গা নেই। তবে বিচারপতির উপর যে আস্থা নির্যাতিতার পরিবার রেখেছিলেন, তার পূর্ণ মর্যাদা বিচারপতি দিয়েছেন। তাঁদের মূল অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী ও সিবিআইয়ের উপর।
আরজি করের নির্যাতিতার পরিবারের ক্ষোভ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে দেখলে এবং পুলিশকে ঠিকভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দিলে সুবিচার হতো। বিচারপতি তাঁর রায়ে পুলিশ অফিসার রূপালি মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। বিচারপতির সামনে পুলিশ অফিসার সৌরভ ঝা বয়ান দিয়েছেন যে, “সকালে যখন খবরটা পাই, কিছুটা জায়গা ফাঁকা রাখি। রাতে সেই গ্যাপে এই জিডি এন্ট্রি করি”। এই নিয়ে নির্যাতিতার বাবা বলেন, “পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে নোংরামি ঢুকে গেছে, জানে যে আমরা যাই করি আমাদের শাস্তি হবে না”।
মুখ্যমন্ত্রী আদালতের রায়ে খুশি নন। সঞ্জয় রায়ের ফাঁসি চাইছেন। এই বিষয়ে নির্যাতিতার বাবা বলেন, “ওঁর মধ্যে যদি মানবিকতা থাকে তাহলে নিজে দায়িত্ব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করুন। পুলিশ এবং প্রশাসন নিয়ে শিয়ালদহ আদালত যে বক্তব্য রেখেছে, সেটা যদি তিনি ভালো করে পড়েন এবং বোঝার চেষ্টা করেন তাহলে মানবিকতার খাতিরে ওঁর পদত্যাগ করা উচিত। আমরা ওঁকে রায়ের কপি ভালো করে পড়ে পদত্যাগ করার দাবি জানাচ্ছি।” রায়ের কপি বাংলায় অনুবাদ করে লিফলেট বানিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করবেন বলেও জানান নির্যাতিতার বাবা।
মুখ্যমন্ত্রীর সঞ্জয়ের ফাঁসি চাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “ওঁর পুলিশ ও প্রশাসন নিয়ে শিয়ালদহ আদালত যে সমালোচনা করেছে সেটাকে ঢাকতেই হাইকোর্টে দৌড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষকে ভুল বোঝাতে তিনি সঞ্জয় রায়ের ফাঁসি চাইছেন। মানুষকে ভুল পথে বিভ্রান্ত করছেন, যেটা তৃণমূল প্রথম থেকেই করে আসছে”।
আরও পড়ুন- মেয়েকে ছাড়া শুধুই অন্ধকার! পুজো যেভাবে কাটাবেন নির্যাতিতার পরিবার
অন্যদিকে সিবিআইয়ের ভূমিকতেও অখুশি আরজি করের নির্যাতিতার পরিবার। সিবিআই কোনও কাজই করেনি বলে অভিযোগ। এমনকী আদালতের রায়েও তাই লেখা হয়েছে। রায়ের ১৫২ পৃষ্ঠার ৩ নং পয়েন্টে রয়েছে, কলকাতা পুলিশ যে কাজ করেছিল, সেটাই আদালতে পেশ করেছে সিবিআই। এর বাইরে কিছু করেনি।
ফাঁসির সাজার প্রসঙ্গে নির্যাতিতার পরিবারের বক্তব্য, “ফাঁসি চাই-ফাঁসি চাই বলে লাফালে তো হবে না। সিবিআই অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি এবং বিচারপতির কাছেও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ক্রাইম সিন নিয়ে বিচারপতিরও সন্দেহ আছে। তাহলে বিচারপতি ফাঁসিটা দেবেন কীভাবে? বিরলের মধ্যে বিরলতম তখনই হয় যখন সমস্ত কিছু প্রশ্নাতীত। কোনও প্রশ্ন থাকবে না। প্রশ্ন থেকে গেলেই বিচারকের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়।”
সিবিআই-এর বিরুদ্ধে পরিবারের আরও অভিযোগ যে, ২৭ ডিসেম্বর তাঁরা হাইকোর্টে রিড পিটিশন দেওয়ার পর, সেই পিটিশনের কপি নিয়ে সিবিআই দিল্লিতে বসে আছে। ইনভেস্টিগেটিভ অফিসার সীমা পাহুজার একমাস ধরে কোনও খবর নেই। হাইকোর্টের মামলার কপি আজ পর্যন্ত তাঁদের সার্ভিস করা হয়নি বলে অভিযোগ তোলেন। রাজ্য সরকার বা সিবিআই কেউই করেনি। অথচ তাঁরা যখন হাইকোর্টে মামলা করেছেন, আধঘণ্টার মধ্যে সিবিআইকে কপি দিয়েছেন বলে জানান। কিন্তু সিবিআইয়ের কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ। এছাড়া নিজাম প্যালেসে নির্যাতিতার বাবা নিজে গিয়ে কপি জমা করেছেন।
বৃন্দা গ্রোভারের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নির্যাতিতার বাবা। তিনি বলেন, “কেসটা একটু দাঁড় করাই তারপর বৃন্দা গ্রোভার ও টিমকে আমি আইন পড়াব। প্রকাশ্যে এই কথা বলছি। তিনি কোনও কাজই করেননি। আমাদের কাছে প্রমাণ নেই। তবে সিবিআইয়ের সঙ্গে মিলে সঞ্জয় রায়কে সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছিলেন। বিনামূল্যে আমাদের মামলা লড়ছিলেন বলে তিনি যা-ই করবেন সহ্য করে নেব এমন হয় না।”
তিনি আরও বলেন, বৃন্দা গ্রোভারের দল আর সিবিআই নির্যাতিতার পরিবারকে নির্দেশ দিয়েছিল তাঁরা লোয়ার কোর্টে ঢুকতে পারবেন না। কারণ ওখানে ইন ক্যামেরা ট্রায়াল হচ্ছে। অথচ যেদিন তাঁরা নতুন উকিল নেন, আদালতে যেতেই বিচারপতি জিজ্ঞেস করেছেন, “আপনারা আসেননি কেন?”
নির্যাতিতার বাবা বারেবারেই জানিয়েছেন, বিচারপতির উপর যে আস্থা তাঁরা রেখেছিলেন, তার পূর্ণ মর্যাদা রেখেছেন বিচারপতি। "আসলে আদালতের রায় পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যে কারণে সঞ্জয়কে ফাঁসি দেওয়ার জন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন," বলেন নির্যাতিতার বাবা।
আরও পড়ুন- বিকাশের বদলে বিলকিসের আইনজীবীতেই ভরসা নির্যাতিতার পরিবারের, কে এই বৃন্দা গ্রোভার?
আদালত নির্যাতিতার পরিবারকে ১৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা নেবেন না বলেই জানিয়েছেন নির্যাতিতার বাবা। তাঁর বক্তব্য, “৯ তারিখ থেকেই টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। এটাও তারই কোনও পার্ট কিনা কীভাবে জানব? টাকা চাই না, একটাই মাত্র মেয়ে ছিল। ৬২ বছর বয়স পর্যন্ত আমি যা করেছিলাম, আমার মেয়ে যা করেছিল তা এক রাতে দুষ্কৃতী ও সরকার মিলে সব শেষ করে দিয়েছে। সুতরাং টাকা আমাদের চাই না।”
এরপর তাহলে কী ভাবছে নির্যাতিতার পরিবার! হাইকোর্টের কাছে ইতিমধ্যেই ৫৪টা প্রশ্ন রেখেছেন। উচ্চ আদালতে প্রথম যেদিন পিটিশন করেছিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত চেয়েছিলেন বলে জানান। কিন্তু কোর্ট সিবিআইকে ভালো মনে করে তদন্তভার তাঁদের হস্তান্তর করেছিল। হাইকোর্ট প্রথম দিন থেকেই কলকাতা পুলিশকে নিয়ে সন্দেহ করেছিল। যে কারণে কোর্টের মধ্যেই সিবিআইকে কেস ডায়েরি হস্তান্তর করার নির্দেশ দিয়েছিল। আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন নির্যাতিতার পরিবার। সিবিআই কাজ করছে না বলে বিস্ফোরক অভিযোগ তাঁদের।
সঞ্জয় রায় সাজা পেলেও তথ্য প্রমাণ লোপাটে অভিযুক্ত আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলের কী হবে! কেনই বা তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে হলো? কাকে বাঁচাতে? শুধু নির্যাতিতার পরিবারের নয়, বিচারপতিও যে প্রশ্নগুলো রেখেছেন এবং সাধারণ মানুষের মনেও যেসব প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে, তার উত্তর মিলবে কবে?