প্রজাতন্ত্র দিবস আসলে গণতন্ত্রের মৃত্যুদিবস পালনের কর্মসূচি

Republic Day 2025:২০২৩ সালের ৩ মে শুরু হওয়া সশস্ত্র সংঘাতে আক্রান্ত মণিপুরের যে আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক তাপমাত্রা তা কি আদপেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহী?

স্বাধীনতার পর পেরিয়ে গেছে সাত দশকেরও বেশি সময়। গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন নিয়ম মেনেই যথাসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক জীবন নিজস্ব ভোটাধিকারের মাধ্যমে পছন্দের শাসক দল নির্বাচিত করেছে, তা ধরেই নেওয়া যায়। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শাসক শ্রেণি। বারেবারে স্বপ্ন দেখিয়েছে। আবার আশাহত হতে হয়েছে জনগণমনকে। নাগরিক জীবন আশাহত হয়েছে তার বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নটি। সাতচল্লিশ পরবর্তী ভারতবর্ষের সব প্রান্তেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখবদল জনকল্যাণ আর শাসননীতির ভিন্ন ভিন্ন যে পরিভাষা তৈরি করেছে তা হয়তো এক ধরনের দ্বিচারিতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, তাই কোথাও কোথাও বিছিন্নতার বোধও তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সচেতন মানুষ চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছে যে, প্রকৃত অর্থে বন্দুকের নল আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী দূরত্ব ঠিক কতটুকু? বিশেষত উত্তর পূর্বাঞ্চলে এ ভাবনার বীজ গভীরভাবেই প্রোথিত হয়েছে।

গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে উত্তপ্ত হয়ে থাকা মণিপুর বারেবারে বুঝিয়ে দেয় যে, বহুত্ববাদের দর্শন শুধু মৌখিকভাবে প্রচার করা হয়েছে। বাস্তবে কিন্তু শাসক শ্রেণির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যুক্তি এক অনাস্থার পরিবেশই তৈরি করেছে। এখানকার বিভিন্ন প্রান্তে অভ্যন্তরীণ সংঘাত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, গৃহহীনতার পরিবেশ বারেবারে নাগরিক থেকে অনাগরিক হয়ে উঠতে বাধ্য করেছে মানুষকে। জনগণ নিজেদের দেশের মূলস্রোতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকার মধ্যেও জাতীয় ঔপনিবেশিক চিন্তাস্পর্শ পেয়েছে। তাই বিছিন্নতার মানসিকতা থেকেই গড়ে ওঠা জাতীয় মুক্তির পথে স্পষ্টভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দানা বাধতে পারেনি। উৎপীড়কের মুখ বদলের রাজনৈতিক সমীকরণকে বোঝার রাজনীতি অনুপস্থিত। কেন হলো এমন? যে ভারতবর্ষ এক সময় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গর্ব বোধ করত, সেই দেশই দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রকে সরিয়ে রেখে নতুন করে হাঁটা শুরু করেছিল। নতুন নতুন চলার পথে ছিল দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িকতা, অর্ধসামন্তীয় চিন্তাধারা, তার মাঝেই ছিল সদ্যোজাত সংবিধানের প্রতি সম্মান। সেই সংবিধান রচনার মুহূর্তে ভীমরাও আম্বেদকার স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছিলেন যে, ভারতবর্ষের প্রয়োজন একটি সামাজিক গণতান্ত্রিক কাঠামো, শুধুমাত্র রাজনৈতিক গণতন্ত্র নয় (India must strive to be a social democracy and not merely a political democracy)।

This Durga Idol In Kolkata Is Inspired By Resilience Of Women Facing Violence In Manipur

আরও পড়ুন- বহুত্ববাদী ভারতবর্ষই গণতন্ত্রের মৃত্যু রুখবে?

তিনি সামাজিক গণতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে যে, সামাজিক গণতন্ত্র হলো এক জীবনযাপন, যেখানে সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের উপস্থিতিকে অনুভব করা সম্ভব (Social Democracy is a way of life which recognizes liberty, equality and fraternity as the principles of life)। ভীমরাও আম্বেদকার যখন সংবিধান রক্ষা সম্পর্কীয় এক উদার অনিবার্য শর্ত তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সমসাময়িক পরিস্থিতিতেই উত্তর পূর্বাঞ্চলে আর্মস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট মোতায়ন করার পরিকল্পনা রচনা করা হয়েছিল।

১৯৫৮ সালে ভারতবর্ষের তৎকালীন কেন্দ্র সরকার সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলেই আর্মস ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের মতো কালো আইনটি চাপিয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন কেন্দ্র সরকারের মনে হয়েছিল, সম্পূর্ণ উত্তর পূর্বাঞ্চলই ‘উপদ্রুত অঞ্চল' হয়ে উঠছে। সেনাবাহিনীর উপর সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো। একদিকে অন্য রাজ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার আরেক দিকে সামরিক পরিকল্পনা গড়ে তোলা— এ প্রক্রিয়া আজও চলেছে।

২০২৩ সালের ৩ মে শুরু হওয়া সশস্ত্র সংঘাতে আক্রান্ত মণিপুরের যে আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক তাপমাত্রা তা কি আদপেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহী? প্রায় দুই বছর হবে— একই ছবি। অতর্কিতে আক্রমণ, আবার পাল্টা আক্রমণ। ধর্ষণ আর প্রতিশোধ ধর্ষণ। এসব ঘটনার মধ্যে দিয়েই একটি সবুজ উপত্যকাতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে চলেছে। সেনা অভিযান চলছে, আর নিরাশ্রয় মানুষগুলো নিজস্ব ঠিকানা থেকে আশ্রয়হীন হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান মণিপুর বিশ্বের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে যেন জানতে চাইছে, এর পর কী?

আরও পড়ুন- বিপজ্জনক সময়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে ভারতীয় গণতন্ত্র

নতুন বছরের নতুন ভোরে, মণিপুরের জনগণের কাছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চান। তিনি বলেন, রাজ্যে যা ঘটেছে সব কিছুর জন্যই তিনি দুঃখিত। কিন্তু এখনও মণিপুরের আশ্রয় শিবিরে দিন গুজরান করা জনগণ শাসক শ্রেণির তরফে কোনও প্রতিশ্রুতি পায়নি যে, আর কতদিন পর আশ্রয়শিবির থেকে তারা নিজেদের গ্রামে ফিরে যাবেন। পারবেন আদৌ? ষাট হাজারেরও বেশি মানুষ নিরাশ্রয়। নিজস্ব জমি, বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র থেকেই উচ্ছেদ হয়েছেন। নিজের মাতৃভূমিতেই বিদেশি হয়ে যেতে বসেছেন। জনজাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন একেবারে তলায় এসে ঠেকেছে। সেনাবাহিনীর অত্যাচার, ভুয়ো এনকাউন্টারের গল্প আছে। এসবের মাঝে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নটি প্রায় অবান্তর হয়ে যায় কারণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্তই হলো উদার পরিবেশ রচনা করা। এমন এক পরিবেশ যা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ, জাতিবৈষম্য ও লগ্নিপুঁজির বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে উৎসাহিত করবে। মণিপুরের মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, গত দেড় বছরে ধারাবাহিকভাবে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের আক্রমণ তীব্র হয়েছে। বিভিন্ন জনজাতির মধ্যেকার অখণ্ডতা ধ্বংস হয়েছে। বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসন বেড়েছে। উন্নয়নের ব্লুপ্রিন্টকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে, রাজ্যের গ্রামীণ ব্যবস্থায় ঋণগ্রস্ততা বেড়েছে, জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে মানুষ। গ্রামীণ অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব দেখা গেছে। শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। মায়েদের সঙ্গে অল্পবয়সি মেয়েরা স্থানীয় বাজারে আসছে, তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। একটি সুন্দর সবুজ উপত্যকা যখন বোমা বারুদের প্রয়োগশালা হয়ে উঠে তখন নীৎশের মতোই বলতে ইছে করে, "রাতের আকাশে কোনও তারা নেই, আছে শুধু বাদুড়, পেঁচা আর উন্মাদ চাঁদ"।

আসন্ন গণতান্ত্রিক দিবসে হাজার হাজার শিশু আশ্রয় শিবিরে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন সমারোহে অংশগ্রহণ করবে। হাঁ করে শুনবে, ‘মেরা ভারত মহান’-এর রূপকথা, আর হয়তো ভাববে তাদের খেলার মাঠ, নিজস্ব ঠিকানা, স্কুল সব যে হারিয়ে গেল! এটা কি তবে ভারতীয় গণতন্ত্রের মৃত্যুদিবস পালনের কর্মসূচি? না সভ্যতার মৃত্যুদিবস?

More Articles