মোদির বিকশিত ভারত আসলে গণতন্ত্রের লজ্জা

Republic Day 2025: শুধু ২০২৩ সালে ভারতে সব মিলিয়ে ৭,৯৫৬ ঘণ্টা ইন্টারনেট শাটডাউন ছিল যাতে ৫৯.১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ৫৮৫.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়।

গণতন্ত্র এমনই এক ভাবনা যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-প্রতর্ক এক বহমান প্রক্রিয়া। ভারতীয় সাধারণতন্ত্র তার ব্যতিক্রম নয়। গণতন্ত্র সম্পর্কে যে কোনও আলোচনায় আব্রাহাম লিঙ্কনের বহুল প্রচারিত আপ্তবাক্যটি ('of the people, by the people and for the people') সূচনাবিন্দু হিসাবে কাজ করলেও তা আজকের দিনে যথেষ্ট নয়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা ফলিত গণতন্ত্রের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একাধিক মানদণ্ড নির্বাচন করেছেন যা একটা দেশে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা কেমন চলছে তা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এক্ষেত্রে যেমন স্বচ্ছ নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে শাসকের ক্ষমতাসীন হওয়ার কথা আছে, তেমনই আছে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী যাতে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে তার কথাও। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে স্বাধীন মিডিয়ার কথা আছে। একবিংশ শতকে গণতন্ত্রের আলোচনায় খুব গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেছে সিভিল লিবার্টির কথা। আজ এই প্রশ্নে সবাই সহমত যে, বুনিয়াদি নাগরিক অধিকার বিহীন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ। শেষ বিষয়টি অবশ্য শাসক যাতে আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজ করতে পারে এবং শাসক বিপথগামী হলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যবস্থা — যাকে আজকাল 'Executive Check' নামে অভিহিত করা হয়। আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠক্রমে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার তিনটি স্তম্ভের কথা— আইনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থা এবং সর্বজন স্বীকৃত চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে মিডিয়ার কথাও আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি মুন্ডাকা উপনিষদের 'সত্যমেব জয়তে' উচ্চারণ করে যে ভারতবর্ষ যাত্রা শুরু করে তা অনেক সীমাবদ্ধতা সত্বেও এক ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল। আজ সেই স্বপ্নের পঁচাত্তর বছর পর গণতন্ত্র এদেশে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, তা বোঝার এক প্রচেষ্টা এই নিবন্ধ।

প্রথমেই একথা স্বীকার্য থাকুক যে, সংবিধান সভা গণতন্ত্রের ফলিত প্রয়োগের মাপকাঠি হিসাবে যে সংবিধান রচনা করেছিল, তা বাস্তবে প্রযোজ্য হয়নি। এক্ষেত্রে শাসকদের শ্রেণি স্বার্থ, সদিচ্ছা, দুর্নীতি যেমন দায়ি তেমনই সংবিধানের বহু কথার মধ্যে স্ববিরোধিতাও লুকিয়ে ছিল। বিশেষ করে মৌলিক অধিকার ও নির্দেশাত্মক নীতির ক্ষেত্রে এই পরস্পর বিরোধিতা সবচেয়ে প্রকট। কাঠামোগত ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আদর্শগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা হলেও সংবিধান কোথাও স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেনি। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন অব স্টেটসের ধারণা আদতে রাজ্যের উপর কেন্দ্রের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার রোডম্যাপ মাত্র। একই কথা রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে বর্ণিত (আদতে কেন্দ্রের চর) রাজ্যপাল পদটির কথাও বলা যায়। এত সত্বেও একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ভারত রাষ্ট্র মূলত সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে শাসিত হয়েছে। এই ব্যতিক্রমটি স্থায়ী হয়েছিল ১৯৭৫ সালের জুন মাস থেকে ১৯৯৭ সালের মার্চ পর্যন্ত (২১ মাস) যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। এই পর্বে নির্বাচনকে নিষিদ্ধ করে, বিপক্ষের রাজনীতিবিদদের পাইকারি হারে গ্রেফতার করে, সমস্ত নাগরিক অধিকার স্থগিত করে, মিডিয়াকে বশম্বদ করে এবং অবশ্যই তিনটি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার স্পর্ধা দেখিয়ে এক স্বৈরাচারকে সামনে এনেছিলেন। এই চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিন্তু সংবিধানকে সাময়িক স্থগিত করে প্রযুক্ত হয়েছিল, সংবিধানের চরিত্র বদল করে নয়। আমরা বর্তমানে নিবন্ধে বেছে নিয়েছি ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির দিল্লিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় থেকে বর্তমান সময়কে। এই পর্বে ভারতীয় গণতন্ত্রের হাল হকিকত আমরা পর্যালোচনা করতে চাই কারণ বর্তমান শাসক দল ও তার মস্তিষ্ক বলে পরিচিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নরেন্দ্র মোদির শাসনকালকে এক নতুন ভারতের জন্ম বলে মনে করেন। ইতিপূর্বে বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে যে এনডিএ সরকার তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে মোদি জমানার বিশেষ পার্থক্যের কথা ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে ২০১৪ সালে মোদি ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য যেখানে তিনি বলেছিলেন, পৃথ্বীরাজ চৌহানের পর প্রথম ভারতের হিন্দু শাসক হলেন নরেন্দ্র মোদি। এমনকী কয়েকদিন আগে, ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠনের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত ঘোষণা করেছেন যে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট নয়, ২০২৪ সালে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের দিন ভারত স্বাধীন হয়েছে। সেই হিসাবে ভারতের স্বাধীনতার বয়স এক বছর মাত্র। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো যে, সাভারকার থেকে হেগড়েওয়ারের মত প্রচারকরা প্রকাশ্যে ১৯৫০ সালে বলেছিলেন যে, এই সংবিধানে কোনও ভারতীয় উপাদান নেই, মনুস্মৃতির জীবনাদর্শ নেই, আছে শুধু পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ। তাই মোদি জমানার শুরুর দিন থেকে ভারতকে গণতন্ত্রের জননী বলে সম্বোধন করেন তখন তাদের আমলে গণতন্ত্রের চরিত্র, স্বরূপ ও ফলিত প্রয়োগ কেমন, তা বিচার করা জরুরি হয়ে ওঠে।

Assam CAA Protest

আরও পড়ুন- মোদির রামরাজ্যে ঠিক কেমন আছেন সাধারণ মানুষ?

মোদির বিকশিত ভারতে গণতন্ত্রের হাল হকিকত বোঝার প্রধান মাপকাঠি নাগরিক অধিকার, মিডিয়ার স্বাধীনতা এবং বিরুদ্ধতার অধিকার কতখানি আছে, তার উপর। আর্টিকেল ১৯ পত্রিকার 'Global Expressions Report' যা সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিমাপ করে, শুধু সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের নয়, তার ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে পৃথিবীর ১৬১টি দেশের মধ্যে ভারতকে ১৪১ তম স্থান দিয়েছে যা ভারতীয় গণতন্ত্রের লজ্জা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ২০১৪ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ভারতের স্থানের ক্রমাবনতি ঘটছে। এই প্রতিবেদনের মতে ভারতের ৫৩% মানুষ মত প্রকাশের অধিকার জনিত সংকটে আক্রান্ত।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন মিডিয়া গণতন্ত্রের আয়না। গত তিন বছরে ভারতে বহু সাংবাদিক জেলে গেছেন। সংখ্যাটা ১৯৯০ সাল থেকে বিচার করলে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে ৬ জনকে দানবীয় ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ হচ্ছে জম্মু- কাশ্মীরে। ২০২৪ সালের ১৮ এপ্রিলের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ১৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা চলছে। ২০২০ সালে দিল্লিস্থিত 'রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস' গ্রুপের প্রতিবেদন অনুসারে করোনা অতিমারীর সময় মানবিক সংকট নিয়ে প্রতিবেদনের কারণে ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আজকের ভারতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বেশিটাই কর্পোরেটদের কুক্ষিগত হওয়ার কারণে বিকল্প মিডিয়া এক প্রতিস্পর্ধা উঠে এসেছে। মোদি সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব এই বিকল্প প্রচারমাধ্যম। স্বাভাবিকভাবেই এরা রাজরোষের শিকার। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় দি ওয়ার, বিবিসি, নিউজক্লিক, দৈনিক ভাস্কর, এনডিটিভি, দ্য কুইন্ট, ভারত সমাচার ও গ্রেটার কাশ্মীরের কথা। সবচেয়ে আশ্চর্যের হলো বিগত দুই দফায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোনও প্রেস কনফারেন্স করেননি। ইন্টারভিউ দিয়েছেন অক্ষয়কুমারের মতো বলিউডি তারকাকে যার প্রতিটি প্রশ্ন সাজিয়ে দিয়েছিলেন মোদির মিডিয়া উপদেষ্টারা।

বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার এই সর্বাত্মক অগ্রগতির সময়ে মতপ্রকাশের জন্য নাগরিকরা ইন্টারনেটকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। নাগরিকের এই অধিকার সবচেয়ে বেশি ভঙ্গ হয়েছে মোদির ভারতে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরপর ছ'বছর ইন্টারনেট শাটডাউনের ক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। শুধু ২০২৩ সালে ভারতে সব মিলিয়ে ৭,৯৫৬ ঘণ্টা ইন্টারনেট শাটডাউন ছিল যাতে ৫৯.১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ৫৮৫.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়। এর মধ্যে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় মণিপুর রাজ্যের (লোকসংখ্যা প্রায় ৩২ লক্ষ) কথা যেখানে একবছরে ২১২ দিন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল।

মত প্রকাশের অধিকার, ভিন্ন মতের অধিকারকে ধ্বংস করতে সবার আগে দরকার নাগরিকের মগজে কার্ফিউ বসানো। এজন্য মোদি জমানায় পরিকল্পিতভাবে একের পর এক পদক্ষেপ করা হয়েছে। টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট (২০০৬), দ্য সিনেমাটোগ্র্যাফ অ্যাক্ট এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্টের সংশোধনী এই লক্ষ্যেই করা হয়েছে। সরকার চাইছে ইউটিউব, গুগল, টুইটারকে (অধুনা এক্স) কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে। টুইটার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালে কনটেন্ট বাতিল করার জন্য ভারত সরকার তাদের ৫৩,০০০ আইনি অনুরোধ জানিয়েছে। ২০২০ সালে ভারত সরকার টিকটক, শার্লেট, উইচ্যাট সহ ৫৯টি অ্যাপ বাতিল করেছে সরকার বিরোধিতার দোহাই দিয়ে। কীভাবে বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে হয় তা আমরা দেখেছি বিবিসি নির্মিত তথ্যচিত্র 'মোদি কোশ্চেন' ও অস্ট্রেলিয়ায় নির্মিত 'অনেস্ট গভর্নমেন্ট অ্যাডস' নামক ব্যাঙ্গচিত্রটিকে ভারতে নিষিদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে।

প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের লক্ষণ হলো নাগরিকের প্রশ্ন করার অধিকার। এক্ষেত্রে এদেশে অধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো 'তথ্যের অধিকার আইন'। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা একের পর এক সংশোধনী এনে আইনটিকে নখ-দন্তহীন করে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। আইনের বর্তমান অবস্থায় সরকার যদি কোনও তথ্যকে 'প্রাইভেট' মনে করে তবে সেই তথ্য প্রকাশিত হবে না। এই সময় বর্ডার রোডস ডেভলপমেন্ট বোর্ড, ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন, ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন সহ ২৬টি সংগঠনকে তথ্যের অধিকার আইনের আওতার বাইরে করে দেওয়া হয়েছে।

গণতন্ত্রের মোদি নির্মিত আখ্যানে প্রতিটি নাগরিক এক টার্গেট যাকে রাষ্ট্র প্রতি মুহূর্তে তার নজরদারিতে রাখতে চায়। ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে সরকার এক 'ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট' পাশ করেছে যার মাধ্যমে সে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নাগরিককে তার আয়ত্তে রাখতে চায়। দ্য ওয়ার সহ পৃথিবীর ১৬টি সংবাদ প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালে ১৭৪ জন ভারতীয় নাগরিকের এক তালিকা প্রকাশ করে যাদের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপে ইজরায়েলের এনএসও সংস্থার পেগাসাস প্রযুক্তি লাগানো হয়েছে। এইভাবে আজ নাগরিকের ন্যূনতম গোপনীয়তার অধিকারটিকেও অস্বীকার করা হচ্ছে।

গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ প্রক্রিয়ার আরেকটি লক্ষ্যবস্তু হলো অলাভজনক এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া। মোদি মন্ত্রিসভার সেকেন্ড ম্যান অমিত শাহের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এনজিওগুলোকে ভাতে মারতে এনজিও সংস্থার 'ফরেন কনট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অ্যাক্ট- ২০১৩' লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে, তাদের কাজকর্মকে 'দেশবিরোধী' আখ্যা দিয়ে। আজ অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যারা ভারতের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে, ভারতে তাদের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এমনকী অলাভজনক থিঙ্কট্যাঙ্ক যারা মোদি সরকারের বিভিন্ন নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তাদেরও লাইসেন্স বাতিল হয়েছে। উল্লেখযোগ্য, সোসাইটি ফর পলিসি রিসার্চ, রাজীব গান্ধি ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর ইকুইটি স্টাডিজ। ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই ধরনের লাইসেন্স বাতিলের সংখ্যা ২০,০০০।

আরও পড়ুন- বহুত্ববাদী ভারতবর্ষই গণতন্ত্রের মৃত্যু রুখবে?

এখানেই গল্পটা শেষ হচ্ছে না। বিকশিত ভারতে বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরের কোনও জায়গা নেই। গণতান্ত্রিক পথে সংগঠিত প্রতিবাদকে বর্বর অত্যাচারের মাধ্যমে দমন করা এবং প্রতিবাদের অপরাধীকরণ এই জমানার চরিত্র লক্ষণ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও কর্পোরেট স্বার্থবাহী নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত মানুষ এই সন্ত্রাস হাড়েহাড়ে প্রত্যক্ষ করেছে। একইসঙ্গে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করার গল্পও কম নেই। এক্ষেত্রে টার্গেট হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ। সিবিআই, ইডির মতো এজেন্সিগুলো আজ সরকারের ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে। ফলত গণতন্ত্রের আরেকটি লক্ষণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার স্বচ্ছ পরিবেশ, আজ আর ভারতে নেই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট অনুযায়ী ২৫জন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ বিজেপিতে যোগদানের পর অভিযোগ মুক্ত হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে বিজেপি আজ ওয়াশিং মেশিন।

স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে এই স্বৈরাচার এক ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে দেশজুড়ে কায়েম করতে চাইছে। বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিক মহলেও ধিকৃত। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে অহরহ বিজ্ঞাপিত ভারত আজ প্রশাসন ও সরকার পরিচালনা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নেহাতই পেছনের সারির দেশ। ফ্রিডম হাউস তার সাম্প্রতিক মূল্যাঙ্কনে ভারতকে 'আধা-মুক্ত' দেশের তকমা দিয়েছে। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট ঘোষিত 'গণতন্ত্র সূচকে' ২০২২ সালে ভারতের স্থান ৪৬, যা ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রাকমুহূর্তে ছিল ২৭। সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম প্রজেক্ট তাদের সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় ভারতকে 'Electoral Autocracy' আখ্যা দিয়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সার্ভেতে দেখা যাচ্ছে ভারতের 'social hostility score' আরও নীচের দিকে নেমে গেছে। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার প্রকাশিত 'World Press freedom Index'-এ ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। টমাস রয়টার্স ফাউন্ডেশন ভারতকে বলেছে, মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে পৃথিবীর মধ্যে বিপজ্জনক দেশ। ক্যাটো ইন্সটিটিউট, যারা মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে, তাদের সূচকে ২০২২ সালে ভারতের স্থান ১১২ যা ২০১৫ সালে ছিল ৭৫। একথা উল্লেখ থাকা দরকার যে, এই সূচকগুলো যারা প্রকাশ করেছেন, তারা বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাবনার, এমনকী পরিমাপের পদ্ধতিও ভিন্ন। কিন্তু প্রত্যেক রিপোর্টের মূল কথা হলো ভারতের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। কোনও দেশের পক্ষে এই রিপোর্টগুলো গৌরবের নয় কিন্তু বিকশিত ভারতে এই বিপন্নতাকে ভারত বিরোধীদের চক্রান্ত বলে দেগে দেওয়াটাই আজ রীতি।

More Articles