মোদিকে যোগ্য জবাব! মেইতেই-কুকি মিলে কীভাবে বিজেপিকে উপড়ে ফেলল মণিপুর?
Manipur against BJP Lok Sabha Results 2024: গত ১ বছর ধরে যে ঘৃণা মণিপুরে আগাছার মতো বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি তা সমূলে তুলে ফেলেছেন নিপীড়িত সাধারণ মানুষ।
গত বছরের মে মাস থেকে ছারখার হয়ে গেছিল উত্তরপূর্বের মণিপুর। সে রাজ্যের দু'টি প্রধান সম্প্রদায়, মেইতি এবং কুকি-জোমি উপজাতি গোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর সংঘাতে পুড়ে যায় বাড়িঘরে, মারা যায় মানুষ, নগ্ন করে মহিলাদের হাঁটানো হয় মিছিলে। ২২৭ জনেরও বেশি মানুষ মারা যান। ৭০,০০০ মানুষ বাড়িঘরছাড়া হন। রাজ্য ও কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারই ছিল মণিপুরে। তবু, এই ভয়াবহ জাতিহিংসার পরেও নরেন্দ্র মোদি একবারও যাননি মণিপুর। সেই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্যও করেননি।
এক বছর পর, ৪ জুন মণিপুর মোদির এই নীরবতার জবাব দিল। মেইতেই হোক বা কুকি সব সম্প্রদায় একজোট হয়ে বিজেপিকে রাজ্য থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। কংগ্রেস ইনার মণিপুর এবং আউটার মণিপুর দুই কেন্দ্রেই জয়লাভ করেছে কংগ্রেস। কংগ্রেস পেয়েছে ৪৭.৫৯% ভোট আর বিজেপি পেয়েছে ১৬.৫৮% এবং তার সঙ্গী নাগা পিপলস ফ্রন্ট পেয়েছে ১৮.৭% ভোট।
আরও পড়ুন- মোদিই প্রধানমন্ত্রী হবেন? নাকি, শেষ মুহূর্তে মোক্ষম চাল দেবেন নীতীশ-নাইডু?
ইনার মণিপুর কেন্দ্রে কংগ্রেসের অঙ্গোমচা বিমল আকোইজম পেয়েছেন ৩৭৪০১৭ ভোট আর আউটার মণিপুরে কংগ্রেসের আলফ্রেড কাঙ্গাম এস আর্থার ৩৮৪৯৫৪ টি ভোট পেয়েছেন। ইনার মণিপুরের কংগ্রেস প্রার্থী আকোইজাম তাঁর বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বী থাউনাওজাম বসন্ত সিংকে ১ লাখেরও বেশি ভোটে হারিয়েছেন। আউটার মণিপুরেও আলফ্রেড কাঙ্গাম নাগা পিপলস ফ্রন্টের প্রার্থী কাচুই টিমোথি জিমিকের চেয়ে ৮৫,০০০-এর বেশি ভোটে জিতেছেন।
মণিপুর বলছে, সমস্ত সম্প্রদায় মণিপুরে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। গত ১ বছর ধরে যে ঘৃণা মণিপুরে আগাছার মতো বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি তা সমূলে তুলে ফেলেছেন নিপীড়িত সাধারণ মানুষ। এমনকী বিজেপির পকেটে থাকা মেইতি ভোটারদেরও মোহভঙ্গ হয়েছে এবার। মণিপুর বুঝেছে, বিজেপি জুড়তে নয় ভাঙতে চায়। অন্যদিকে, ভারত জোড়ো যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব রাহুল গান্ধি শুরুই করেছিলেন এই মণিপুর থেকে। জাতিদাঙ্গায় বিধ্বস্ত মণিপুর তিনি হেঁটেছেন, মানুষও হেঁটেছে সঙ্গে। সেই পরিশ্রমের ফল হাতেনাতে পেয়েছে কংগ্রেস।
বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এই হিংসতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন শুধু তাই নয়, মেইতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলার জন্যও সমালোচিত হয়েছেন। সবথেকে বড় ইস্যু হচ্ছে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংঘাত বিধ্বস্ত রাজ্যে দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো হচ্ছে, সারা বিশ্ব সেই ভিডিও দেখছে আর বিজেপি শাসিত রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একবার যাওয়ার সময়ও পেলেন না! এই উদাসীনতার সবক শিখিয়ে দিল মণিপুর।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী খাম খান সুয়ান হাউসিং বলছেন, মণিপুরের এই ভোট আসলে 'ডাবল-ইঞ্জিন সরকার'-এর বিরুদ্ধে ভোট। যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়, কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায়, সেই রাজ্যে যদি এই হিংসা হয় এবং সরকার না থামায় তাহলে কোন নিরাপত্তা দিতে পারছে নির্বাচিত সরকার?
আরও পড়ুন- যৌন হেনস্থার ভিডিও কেড়েছে ঘুম! মেয়েদের এখনও স্কুলে পাঠাতে ভয় পান মণিপুরের বাবা-মায়েরা
ইনার মণিপুর আসনটি ইম্ফল উপত্যকার বিভিন্ন জেলা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আকোইজাম এবং রাজ্যের মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী থাউনাওজাম বসন্ত সিংয়ের মধ্যে লড়াই হয়েছিল৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সেনজাম মাঙ্গি সিং ইনার মণিপুরে বিজেপির খারাপ ফলের জন্য দু'টি কারণকে দায়ী করেছেন। ভোটাররা কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি হতাশ। মোদির নীরবতাকে উদাসীনতা বলেই মনে করেছেন মানুষ। আর রাজনৈতিক নেতা হিসাবে বিমল আকোইজমের ক্ষমতা ও যোগ্যতার উপরও মানুষের বিশ্বাস ছিল ঢের বেশি।
আকোইজাম মেইতেই ভোট টেনেছেন বিপুল, বিশেষ করে শিক্ষিত ভোটারদের কাছ থেকে বেশ ভালো সাড়া পেয়েছেন তিনি। কংগ্রেস বিমল আকোইজমের কাঁধে ভর করেই বিজেপিকে সজোরে থাপ্পড় মারতে পেরেছে। কংগ্রেস বীরেন সিং সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি মৌলবাদী মেইতেই গোষ্ঠী আরামবাই টেঙ্গোলের কৌশলের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। বীরেন সিংয়ের বিরুদ্ধে গেছে মানুষের ভোট কারণ মেইতেইরা বুঝেছে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব উপেক্ষা করেছেন বীরেন। মেইতেইদের শান্ত করার বদলে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন।
আউটার মণিপুরে মণিপুরের দু'টি প্রধান উপজাতীয় সম্প্রদায়, নাগা এবং কুকি, জো-দের জায়গা। এখানে বিজেপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তার সঙ্গী দল নাগা পিপলস ফ্রন্ট একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা টিমোথি জিমিককে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করায়। কুকি-জো সম্প্রদায়গুলি জাতিগত হিংসার বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছে। তারা আর্থারকে সমর্থন করেছে কারণ তিনি উপজাতীয় অধিকারের হয়ে লড়াই করেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সেনজাম মাঙ্গি সিং বলছেন, আউটার মণিপুরের মেইতেইরা চিরকালীন কংগ্রেস সমর্থক। এবার কুকিরাও আর্থারকে সাহায্য করেছে। নাগা পিপলস ফ্রন্টের বিরুদ্ধে নাগাদের মধ্যেই অসন্তোষ ছিল। বর্তমান সাংসদ লোরহো এস ফোজ নাগাদের পক্ষে কথা বলতে ব্যর্থ হয়েছেন। নাগাদের রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কিত কোনও সমস্যা সংসদে ওঠেইনি কারণ এই ফ্রন্ট বিজেপিরই বন্ধু দল।