যুদ্ধ চলবেই, তবু টানে অঙ্কের রহস্য: কথোপকথনে মেরিনা ভায়াজোভস্কা

EXCLUSIVE: পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় মহিলা, যাঁকে ফিল্ডস মেডাল কমিটি এই পুরস্কারে ভূষিত করে। রইল ড. মেরিনা ভায়াজোভস্কার সঙ্গে কথোপকথন।

প্রতি চার বছর অন্তর ফিল্ডস পুরস্কার দেওয়া হয় চল্লিশের কমবয়সি গণিতজ্ঞদের। গণিতে তাঁদের অসামান্য কাজের জন্য। রাশিয়া যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তার কিছুদিন পরেই তিনি ফিল্ডস মেডেল প্রাইজ় যেতেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় মহিলা, যাঁকে ফিল্ডস মেডাল কমিটি এই পুরস্কারে ভূষিত করে। তিনি মেরিনা ভায়াজো়ভস্কা।

গণিতে তাঁর মূল কাজ স্ফিয়ার প্যাকিংকে কেন্দ্র করেই। সেই কাজই তাঁকে এনে দিয়েছে এই পুরস্কার। বর্তমানে সুইৎজা়রল্যান্ডের École polytechnique fédérale de Lausanne (EPFL)-এর অধ্যাপিকা।

রইল ড. ভায়াজোভস্কার সঙ্গে কথোপকথন।

মেরিনা ভায়াজো়ভস্কা

আরও পড়ুন: ‘পুরস্কার দিয়ে কাজ বিচার বন্ধ করা উচিত’, কথাবার্তায় বিজ্ঞানী দীপক ধর

আপনি যখন ফিল্ড মেডেল প্রাইজ় পেলেন, তার কিছুদিন আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ আপনাকে বা আপনার কাজকে কতটা প্রভাবিত করেছে?

ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ তো আজ শুরু হয়নি। দুই দেশে লড়াই চলছে আট-আটটা বছর ধরে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন আঘাত হানল, সেই যুদ্ধ আমার কাছে মানসিক আঘাত পাওয়ার থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে চলা আমার কাছে সত্যি-ই খুব কঠিন ছিল। অন্তত প্রথম ক'টা মাস। দুর্ভাগ্যবশত, মনে হয় না এই যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হবে বলে। আমাকে একরকম মানসিক ভার নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হয়েছে। আমি আবার আমার ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো শুরু করেছি, তাদের ক্লাস নিচ্ছি, এবং অবশ্যই অঙ্কের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও করছি। যুদ্ধ এখন আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ‍্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই নিয়েই বাঁচতে হবে।

এমনকী, যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন আমি অঙ্কের গবেষণার দিকেও মন দিতে পারিনি প্রথম কয়েক মাস। কারণ, এই ধরনের কাজের জন্য কেবল শান্ত পরিবেশই যথেষ্ট নয়, মানসিক শান্তিরও প্রয়োজন। এবং এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন এখানে সেমিস্টারও শুরু হয়েছে। কিন্তু আমি আবার অশান্ত পরিবেশে পড়াতে পারি না। এক্ষেত্রে আমি আমার ছাত্র-ছাত্রী তো বটেই, আমার সহকর্মীদের কাছেও ভীষণ কৃতজ্ঞ। আমি যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম যুদ্ধের কারণে, আমাকে পড়ানো বা কাজ করার জন্য মানসিক জোর তারাই দিয়েছে।

তবে কী জানো তো, এটা কেবল যুদ্ধই নয়, জীবনের যে কোনও কঠিন পরিস্থিতি, দুঃখ, অথবা মৃত্যু, এই বিষয়গুলি খাটে।

আচ্ছা, বহু মানুষ, বিশেষ করে বাচ্চারা অঙ্ক বিষয়টিকে ভয় পায়। অঙ্ক বিষয়টিকেই এড়িয়ে চলে কেবল ভয়ে। অঙ্কে ভয় কাটানোর জন্য, বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন?

আমার মনে হয়, আমরা যেভাবে অঙ্ক শেখাই, সেটা ভয় তৈরি হওয়ার একটা কারণ। কেউ এখানে প্রশ্ন করতেই পারে, অঙ্ক শেখানোর সঠিক পদ্ধতি কী। আমি মনে করি না, অঙ্ক শেখানোর জন্য আদৌ কোনও নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকতে পারে। প্রত্যেকটি শিশু আলাদা, তাদের প্রত্যেকের শেখার ধরন আলাদা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমি বলব, শিক্ষা একটা 'আর্ট'। গাণিতিক শিক্ষাও সেরকম। সেখানে একজন শিশু কতটা ভালো শিখবে, নির্ভর করে শিক্ষক-শিক্ষাকারা কীভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরছে, তার ওপর। শুধু শিশুই নয়, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও একই কথাই আমি বলব। সবার ভাবনাচিন্তার ধরন আলাদা,স্বাভাবিকভাবেই তাদের শেখার ধরনও আলাদা। আমার মনে হয়, গাণিতিক শিক্ষা 'পার্সোনালাইজ়ড' হওয়া উচিত।

গণিত বিষয়টা সৃজনশীল। কিন্তু আমি তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষ হয়ে বলছি, আমাদের দেশে সৃজনশীলতার বিশেষ পরিবেশ নেই। যার অন্যতম কারণ আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। আমাদের চাকরির প্রয়োজন। আর চাকরি পেতে গেলে সংখ্যাগত সমাধান ভালো করে জানতে হয়। আপনার কি মনে হয় সংখ্যাগত সমাধান আর গণিত এক জিনিস? না কি তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই?

আমার কাছে এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। আমি সবসময় এইভাবে আলাদা করতে পারি না।

আমি অঙ্কের ছাত্রী নই। কিন্তু যাঁরা অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাঁদের অনেকেই বলেন, অঙ্ক খুব সুন্দর একটা বিষয়। অঙ্ক কবিতার মতো। আপনার এই বিষয়ে কী মতামত?

আমি খুবই তাত্ত্বিক গণিত নিয়ে কাজ করি। আমি যা নিয়ে কাজ করি, সব ক্ষেত্রে হয়তো সরাসরি তার কোনও প্রয়োগও নেই। তবু আমার মনে হয়, অঙ্ক এমনই একটা বিষয়, সে যেন বিজ্ঞানের মধ্যে কবিতা হয়ে লুকিয়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি বলব, অঙ্ককে যত না বেশি 'পোয়েট্রি অফ সায়েন্স' বলা যায়, তার থেকেও বেশি বলা যায় 'ল্যাঙ্গুয়েজ অফ সায়েন্স'।

(হেসে ফেলে) আমিও বেশ কিছু অঙ্ক করি, যেগুলোকে আমার কোনওদিনই সুন্দর বলে মনে হয়নি। তাদের কবিতার মতো ভাবা তো অনেক দূরের কথা। আমার মনে হয়, সৌন্দর্য বিষয়টাই খুব সাবজেকটিভ (আবারও হেসে ফেলে)।

আমার পরের প্রশ্নটার সঙ্গে আগের এই প্রশ্নটার কিছু মিল থাকলেও জানতে চাইব একটা বিষয়। সেটা হলো, অনেকে বলে গণিত হল প্রকৃতির ভাষা। কবিতার ছত্রে ছত্রে যেমন অঙ্কের হিসেব লুকিয়ে থাকে, প্রকৃতির প্রতিটি কোনে খুঁজলে বোধহয় আমরা একটা ম্যাথেমেটিকাল প্যাটার্ন খুঁজে পাবো। আপনার এই বিষয়ে কী বক্তব্য?

(শিশুসুলভ বিস্ময়সূচক শব্দ করে) এটা তো বিশাল একটা রহস্য আমি বলব। সেটা তো বোধহয় আমার অভিব্যক্তি-ই বলে দিল। অঙ্ককে 'ল্যাঙ্গুয়েজ অফ নেচার' বা 'প্রকৃতির ভাষা' বলা যায় কি না, এর উত্তরে আমি জোর দিয়ে হ্যাঁ বা না বলতে পারি না। তবে অবশ্যই অঙ্ক বেশ কিছুটা প্রকৃতি এবং মানুষের দ্বারা উদ্বুদ্ধ। অঙ্কের বহু গণনা বা সমাধান প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। আমার কাছে এটা কেবল মজারই নয়; প্রকৃতির কোণে কোণে কীভাবে অঙ্ক লুকিয়ে থাকে, আমার কাছে তা অপার বিস্ময়ও।

More Articles