ইউনিসেফের বিস্ফোরক রিপোর্ট! কয়েক বছরেই তাপপ্রবাহের বলি হবে শিশুরা

Heatwave and Child Health: ২০৫০ সালের মধ্যে যদি বিশ্ব উষ্ণায়নের সূচককে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না আনা যায় তাহলে আফ্রিকা এবং এশিয়ার প্রায় অর্ধেকের বেশি শিশু চরম তাপপ্রবাহের এক্সপোজারের সম্মুখীন হবে।

২০২২ সালে এপ্রিল এবং মে মাসের প্রথম দশদিন কী তার বেশি সময় ধরে তীব্র দাবদাহে পুড়েছে পশ্চিমবঙ্গ সহ কলকাতা। এই রাজ্যে এর আগে এমন কবে ঘটেছে তা আম বাঙালি স্মরণ করতে পারে না। কলকাতায় পারদ চড়েছে রেকর্ড মাত্রায়, প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। কালবৈশাখীর খোঁজ নেই। কিছুদিন বা বলা ভালো, কিছু বছর যাবত আমরা সকলেই অনুভব করছি চেনা ঋতুগুলো কেমন যেন ভোল পাল্টে ফেলেছে। চেরাপুঞ্জি বৃষ্টিহীন, আবার বন্যায় ভাসছে মরু শহর রাজস্থান। লন্ডন শহর কখনও গরমে হাঁসফাঁস করছে আবার কখনও বর্ষার জলে নাকানি চোবানি অবস্থা নয়তো আবার তুষারপাতে সমস্ত কিছু বিপর্যস্ত। উচ্চতা বাড়ছে সমুদ্রতলের। বরফ গলছে আস্তে আস্তে। গরমকাল স্থায়ী হচ্ছে বেশি দিন। শীত যেন প্রায় লুপ্তপ্রায়। আর বৃষ্টি যেন নিজের মনমর্জি মতো কাজ করছে। সবই নিয়ম ভাঙা। প্রকৃতির এই পরিবর্তন পৃথিবীকে নতুন ইঙ্গিত দিচ্ছে। দাবানলে বনের পর বন উজাড় হচ্ছে। এর মধ্যে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, তুরস্ক, জার্মান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়াসহ কয়েকটি শহর রয়েছে। জাপানের ইতিহাসেও লেখা হচ্ছে ভয়াবহ দাবদাহের খতিয়ান। এরই মধ্যে জলবায়ু সূচক রেকর্ড ভেঙেছে।

তাপপ্রবাহ কী?

বইয়ের পাঠ্য ভাষায় বলতে গেলে, যখন কোনও স্থানের ভূপৃষ্ঠের উপরিস্থ (সাধারণ ভূমি থেকে ২ মিটার উচ্চতায়) বায়ুর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা (সাধারণত রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা) কমপক্ষে পরপর ওই স্থানের বছরের ওই একই সময়ের বায়ুর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার শীর্ষস্থানীয় ১৫ শতাংশ তাপমাত্রার মধ্যে পড়ে, তবে তাপমাত্রার সেই অবস্থাকে তাপপ্রবাহ বলে গণ্য করা হয়। তাপপ্রবাহের সংজ্ঞা নির্ধারণে রাতের তাপমাত্রাকে বেছে নেওয়ার কারণ হল গরমকালে রাতে মানুষ যখন ঘুমায়, তখন শরীর তাপ ত্যাগ করে শীতল হয় এবং মানবদেহ পরবর্তী দিনের কাজের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে। তাপপ্রবাহের সময় যেহেতু রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক সময়ের তাপমাত্রা অপেক্ষা অনেক বেশি থাকে, তাই মানবদেহ তাপ ত্যাগ করে যথেষ্ট পরিমাণে শীতল হতে পারে না; পারলেও মানুষের হৃৎপিণ্ডকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় শরীর থেকে তাপ বের করে দিতে। ওই একই কথা প্রযোজ্য দিনের বেলাতেও। তাপপ্রবাহের সময় যেহেতু বায়ুর তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে তাই মানুষের শরীর থেকে তাপ বের করে দিতে মানুষের হৃৎপিণ্ডকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। কোনও কোনও সময় মানুষের হিট স্ট্রোক হয়ে যায় অতিরিক্ত গরমের কারণে।

আরও পড়ুন- ‘চিনি’-র দখল চিনের? স্বাদে মিষ্টি, কিন্তু শব্দের ভেতর লুকিয়ে জটিল রহস্য

কীভাবে প্রভাব ফেলছে তাপপ্রবাহ

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সেই পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে। আবার মানুষ সেই সময় থেকেই প্রায় নিজের প্রয়োজনে নিষ্ঠুরভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে। এর মাধ্যমে মূলত মানুষ নিজের অস্তিত্বই ধ্বংসের দিকে নিয়ে এসেছে। মানুষ চাইলে যেকোনও সময় যুদ্ধ থামাতে পারে, এটি মানুষের ইচ্ছের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু মানুষ কি চাইলেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে? কাজ অতটা সহজ নয়। কারণ, যে প্রকৃতি ধ্বংস করে আমরা তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলেছি সেই মোহ থেকে এত সহজে বের হয়ে আসা যায় না। তাছাড়া পৃথিবীর সব মানুষ মানসিকভাবে প্রকৃতির এই ধ্বংসলীলার জন্য সরাসরি নিজেদের দিকে আঙুল তোলে না। সম্প্রতি ইউনিসেফের তরফ থেকে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে যাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত শিশু তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে চলেছে। অর্থাৎ মাত্র ২৮ বছরের অপেক্ষা। জলবায়ু পরিবর্তনে কোনও ভূমিকা নেই দেশের শিশুদের কিন্তু তারাই সর্বোচ্চ মূল্য দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হওয়া তাপপ্রবাহের কবলে পড়ছে পৃথিবীর শিশুরা, আর সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকা ‘জার্নাল পিডিয়াট্রিক অ্যান্ড পেরেনিটাল এপিডিমিয়োলজি’র বিশেষ সংখ্যায় এ বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। মূলত উষ্ণায়ন ও এর জেরে দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনে মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রূণ, সদ্যোজাত শিশু ও শিশুর শৈশবকে কতটা বিপজ্জনক করে তুলেছে এরই একটি চিত্র উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া সহ সারা বিশ্বে গবেষণা চালিয়ে দেখা হয়েছে। তাপমাত্রার এই হেরফেরের সঙ্গে সদ্যোজাত শিশুদের ওজন বৃদ্ধিরও বিপজ্জনক প্রবণতা ধরা পড়েছে কয়েকটি গবেষণায়। ইসরায়েলে ২ লাখ শিশুর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, উষ্ণায়নের জন্য জন্মের এক বছরের মধ্যেই অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির শিকার হচ্ছে শিশুরা। সেই ওজন বৃদ্ধি পরে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে অন্তত ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে। এর জেরে বিশ্বে শিশুদের অস্বাভাবিক স্থূলত্ব মহামারির আকার নিয়েছে বলেও জানা যায়। গবেষণাপত্রগুলি আরও জানিয়েছে, এ মুহূর্তে বিশ্বের অন্তত ১৮ শতাংশ শিশুই অস্বাভাবিক ওজন বা স্থূলত্বের শিকার। আবার কয়েকটি গবেষণা জানিয়েছে, তাপপ্রবাহের জন্য হওয়া দাবানলের ধোঁয়ায় মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রূণের কিছু জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিপদ ২৮ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। আর সেটা হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার প্রথম তিন মাসেই।

গবেষণায় আরও জানা গিয়েছে, উষ্ণায়ন ও অত্যধিক তাপপ্রবাহের ঘটনা আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বেই শিশুদের হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগে ভর্তি হওয়ার ঘটনার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া কোনও কোনও দেশে বা অঞ্চলে সর্বাধিক তাপমাত্রার সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে অপরিণত ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম-হার পাঁচ থেকে সাত শতাংশ বেড়েছে।

ইউনিসেফের দেওয়া রিপোর্টে আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে যদি বিশ্ব উষ্ণায়নের সূচককে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না আনা যায় তাহলে আফ্রিকা এবং এশিয়ার প্রায় অর্ধেকের বেশি শিশু চরম তাপপ্রবাহের এক্সপোজারের সম্মুখীন হবে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেছেন, ইতিমধ্যে বিশ্বের ৩ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু এমন দেশে বাস করে যেখানে তাপপ্রবাহ প্রবল এবং প্রায় ৪ জনের মধ্যে ১ জন সেই তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে আসে। এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও ভয়ঙ্কর হতে থাকবে। তিনি আরও জানান, যদি তাপমাত্রার সূচককে ১.৫ ডিগ্রিতে নামানো যায় তবেই শিশুদের জীবন এবং ভবিষ্যৎ বাঁচানো সম্ভব হবে, নচেৎ নয়। শিশুরা যত বেশি তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে আসবে তত তাদের মধ্যে হাঁপানি, ফুসফুসের সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

আরও পড়ুন- ৩০ বছরে প্রথমবার স্নান আর তারপরেই মৃত্যু দুনিয়ার সবচেয়ে নোংরা ব্যক্তিত্বের

কীভাবে বুঝবেন তাপপ্রবাহের শিকার হয়েছে শিশুরা?

পছন্দের খাবারটাও মুখে তুলতে চাইছে না বাড়ির খুদে সদস্যরা? একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, সঙ্গে শুরু হচ্ছে পেটের সমস্যা? কয়েক দিন ধরে এমন চলতে থাকলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবেই। অনেকক্ষেত্রেই জানা গেছে, তাপপ্রবাহের শিকার ওই শিশু। শুধু বড়রাই নন, তীব্র গরম মানিয়ে নিতে পারছে না শিশু শরীরও। তাই চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ভ্যাপসা গরমে সাবধানে রাখতে হবে খুদেদের।

শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “প্রতিটি শিশুকে এখন প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়াতে হবে, তরল জাতীয় খাবারেও জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, উচ্চ মাত্রায় প্রোটিনযুক্ত খাবার যেন বেশি না দেওয়া হয়৷ কারণ ওই খাবারের জন্য কিডনির উপরে চাপ পড়বে, তাতে শরীরে বেশি জলের প্রয়োজন হবে।” যদিও অধিকাংশ শিশুই জল খেতে চায় না, তাই বাড়ির লোক গ্লুকোজ, ফলের রস দিতে থাকেন। কিন্তু সেটা ঠিক পন্থা নয় বলেই জানাচ্ছেন শিশুরোগ চিকিৎসকেরা। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স’-এর জাতীয় স্তরের সহ-সভাপতি চিকিৎসক অতনু ভদ্রের কথায়, “গরমে ঘাম হয়ে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম বেরিয়ে যায়। সেই ঘাটতি পূরণ করতে হলে ওআরএস বা নুন-চিনির জল বেশি খেতে হবে। গ্লুকোজে নুন থাকে না। ফলে সেটি শিশুর পছন্দের হলেও কার্যকরী নয়।” শিশুরোগ চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরীর কথায়, সদ্যোজাতদের মধ্যে জন্ডিসের প্রবণতাও বাড়ছে। তীব্র গরমে তাদের শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মস্তিষ্কে যে হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থি রয়েছে, তীব্র গরমে সেটি ঠিক মতো কাজ করে না। তাতেই শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে জ্বর নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।

এক জনপ্রিয় পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বিজ্ঞানী উষ্ণায়নের জেরে হওয়া তাপপ্রবাহের উত্তরে মজা করে বলেছিলেন, আসলে পরিবেশ এক ক্ষ্যাপা জন্তুর মতো আর মানুষ তাকে অনবরত বিরক্ত করে যাচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা করলে সেটা তো প্রকৃতি মেনে নেবে না। তাই এবার প্রতিশোধ নেওয়ার পালা শুরু হয়েছে। সেই প্রতিশোধের আগুনে পুড়তে হচ্ছে ছোট্ট শিশুদের। এরই মধ্যে ইউনিসেফের দেওয়া এই রিপোর্ট যেন মানুষকে আরও নাজেহাল অবস্থার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। গত বছর তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছিল ১৫ কোটিরও বেশি মানুষ।

পরিবেশ নিয়ে ভাবনা আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত আবহাওয়ার বিপুল পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছেন সকলেই। কিন্তু সকলেই যদি ‘চলছে-চলুক’ ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন তাহলে ইউনিসেফের এই রিপোর্ট সত্যি হতে আর বেশি দেরি নেই, জলবায়ু সংকট অচিরেই হয়ে উঠবে শিশুর জীবন সংকট।

More Articles