ভবানীপুরের ডন, কুঁদঘাটের বোম! দক্ষিণ কলকাতা কাঁপাতেন যে মস্তানরা
Mastan of South Kolkata: প্রতিদিনের ব্যয়াম সেরে বাড়ি ফিরছিল কাল্টু। ঠিক সেই সময়ই কে বা কারা কাল্টুর পাছা লক্ষ্য করে বোমা মারল। দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল
মধ্য কলকাতার মস্তানরা যখন প্রায় মিথের পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন, দক্ষিণ কলকাতাই বা পিছিয়ে থাকে কেন? সেদিনের দক্ষিণ কলকাতা অবশ্য কালীঘাটের গণ্ডি পেরিয়েই শেষ হয়ে যেত। বাকি বিস্তীর্ণ রিফিউজি কলোনি ও শহরতলি । ভানু বোস, গোপাল পাঁঠা, রাম চ্যাটার্জিদের মতো আইকন না থাকলেও দক্ষিণের পাড়ায় পাড়ায় তখন চলছে মস্তানতন্ত্র। তবে এদের মধ্যে অন্তত তিনজন ব্যক্তি ছিলেন যাদের ব্যাপ্তি ছিল এলাকা ছাড়িয়ে মোটামুটি গোটা রাজ্যে! আর প্রভাব? তাও ছিল বিরাট। দক্ষিণের পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা মস্তানদের আইকন ছিলেন তারা। পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণের সেলিব্রিটি মস্তান ছিলেন রাসু চ্যাটার্জি, কালী ঘোষ, বুলু মজুমদার আর টুলু মুখার্জি। এর মধ্যে রাসু চ্যাটার্জির গল্প বলার মতো আজ আর কেউ তেমন নেই। বাকিদের গল্প আজও বেঁচে আছে। পুরনো পাড়ায় এখনও ফিসফিসিয়ে কারা যেন ওদের গল্প বলে যায়।
পঞ্চাশের দশকের ভবানীপুর এক অভিজাত বাঙালি অঞ্চল। প্রতিষ্ঠিত আমলা, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী মানুষের ভিড় দক্ষিণের অভিজাত এই পল্লীতে। পঞ্চাশের ভবানীপুরে মস্তানের প্রসঙ্গ আসতেই এক বাক্যে সবাই বলবে যার কথা, তিনি কালী ঘোষ। ভবানীপুরের ডন। ছিপছিপে, পেটানো চেহারা। শান্ত দু'টি চোখ অতল ও গভীর। ভবানীপুরের বিখ্যাত শ্রীহরির কচুরির দোকানের পাশেই একটা ছোট শ্রীহরির দোকান ছিল। আজ যেটা শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার। এই দোকানেই ছিল কালী ঘোষের আড্ডা। দলবল নিয়ে রোজ কালী ঘোষ বসে থাকতেন মিষ্টির দোকানের বেঞ্চ আলো করে। চুপচাপ। বেশি কথা বলতে প্রায় কেউই দেখত না কিন্তু সবাই সমীহ করত। সবাই কমবেশি জানত লোকটার কী ক্ষমতা! এই ক্ষমতার একটা কারণ অবশ্যই অস্ত্র। কানাঘুঁষো ছিল, আন্তঃরাজ্য অস্ত্র সরবরাহ চক্রে যুক্ত ছিলেন কালী ঘোষ। কালী ঘোষের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে যেত ছোটখাট উঠতি মস্তানরা। কালীর অস্ত্রেই পাড়ায় পাড়ায় মস্তানরা হয়ে উঠত বিপজ্জনক।
এহেন চরিত্রটিকে বুঝতে গেলে কতগুলি বিষয় একটু বোঝা দরকার। মধ্য কলকাতার মস্তানরা যেমন রাজ্যের তৎকালীন শাসক দল ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দক্ষিণের সুপারস্টার কালী ঘোষ কিন্তু ছিলেন বামঘেঁষা। তিনি সরাসরি রাজনীতি না করলেও তাঁর পরিবারে সিপিআই রাজনীতি করা ডাকাবুকো লোক ছিল। কালী ঘোষ ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এসইউসিআই নেতা সুবোধ ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ। কারও কারও মতে, কালী ঘোষের সঙ্গে নকশাল নেতাদেরও যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয় পরবর্তী সময়ে। এ কথা হলফ করেই বলা যায়, আর যাই হোন তিনি কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ ছিলেন না।
আরও পড়ুন- ভিড়, ভক্ত, ফাংশান, উন্মাদনা! উত্তমকুমারকে যেভাবে আগলে রাখতেন এই মস্তানরা
তাঁর মস্তান সংস্কৃতিটাও ছিল একটু আলাদা। কলকাতার বর্ধিষ্ণু মস্তানরা যখন কালীপুজো করছে জাঁকজমক করে, দক্ষিণের কালী ঘোষ করতেন সরস্বতী পুজো। পূর্ণ সিনেমার উল্টোদিকের রাস্তায় ঢুকেই প্রথম বাঁহাতে যে গলি ঢুকে গেছে, সেই গলিতেই ছিল কালী ঘোষের ক্লাব ছাত্র সংঘ। তাদেরই বাৎসরিক বিদ্যাদেবীর আরাধনায় ভিড় জমতো এলাকায়। তবে ছাত্র সংঘ ক্লাবে ছাত্র ছাড়াও অন্য যুবকদের আনাগোনা ছিল ভালোই। কালী ঘোষের এক শিষ্য পরে বিখ্যাত মস্তান হয়ে গুরুর মুখ উজ্বল করেছিলেন। তিনি বুলু মজুমদার, এই ছাত্র সংঘ ক্লাবেরই বিশিষ্ট সভ্য। শুধু একটাই ব্যাপার, বুলুকে ছাত্র বলা যাবে না, এই আর কী! এছাড়াও, খিদিরপুর-টালিগঞ্জের ডাকাবুকো ছেলেরা আসত ছাত্র সংঘে। তুলনায় পাড়ার ছেলে কম। তবে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ভালোই সম্পর্ক রাখতেন কালী। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আরেকটা ব্যাপার ছিল! রইস মস্তানদের মতো কালী ঘোষের কোনও জলসা ছিল না। তবে তাঁর এক শাগরেদ ছিল, সুপ্রকাশ গড়গড়ি। তিনি পরর্বতীকালে বিশিষ্ট জলসা আয়োজক হয়েছিলেন । সুপ্রকাশ ছিলেন কালী ঘোষের ছায়াসঙ্গী । মূলত তিনিই ছাত্র সংঘে অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন।
কালী ঘোষের গল্প শুনিয়েছেন সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তম কুমারের পাড়ার লোক এই ভদ্রলোক রাজনীতিবিদ। এখনও মনে রেখেছেন হারানো সময় আর বিস্মৃত কিছু চরিত্রকে। কালী ঘোষের প্রসঙ্গ উঠতেই বলে উঠলেন,
"কালী দা ছিল বিশাল ব্যাপার। বিরাট তাঁর নেটওয়ার্ক। আমরা তখন সাউথ সিটিতে পড়ি। গড়চা অঞ্চলের কিছু ছেলে প্রতিদিন ডিস্টার্ব করত। উপায় না দেখে একদিন কালীদার কাছে যাই। গিয়ে বলি বিষয়টা। সব শুনে কালীদা শান্ত গলায় বলল, গড়িয়াহাট মোড়ে বাবলু মামা আছে। ওর কাছে গিয়ে আমার কথা বল। পরের দিনই গড়িয়াহাট মোড়ে বাবলু মামার খোঁজ করলাম। পেয়েও গেলাম। দেখি ছোটখাট চেহারার মানুষ। কালী ঘোষের পাড়া থেকে এসেছি শুনে খুব খাতির করলেন। সব শুনে পরের দিন যেতে বললেন। পরের দিন ছিল আমাদের চমকে ওঠার পালা। বাবলু মামার ঠেকে গিয়ে দেখি, আমাদের উত্যক্ত করা গোটা গ্যাং কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই জামাই-আদর পেয়েছে তা ওদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কাঁদো কাঁদো মুখে সব দাঁড়িয়ে। ওদের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে বাবলু মামা। ওই দিনই শেষ। আর কোনওদিন কলেজে আমাদের কেউ উত্যক্ত করেনি।"
শুধু এটুকুই না! সচ্চিদানন্দের স্মৃতিতে রয়েছে কালী ঘোষকে নিয়ে অসংখ্য কথা। "সেবার শবনম সিনেমা রিলিজ করবে। কোথাও টিকিট নেই। কালীদার কাছে গিয়ে বললাম, ও কালীদা কয়েকটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দাও। সন্ধেবেলাই এক গোছা টিকিট চলে এল হাতে। নিজেরা দেখলাম, কলেজের বন্ধুদেরও দেখলাম। কলেজে তো আমার খাতিরই বেড়ে গেল। দক্ষিণের যত বড় বড় হল, প্রতি শো-এর টিকিট কালীদাকে দিয়ে যেত।"
তবে কালী ঘোষের সব গল্প এতটাও নিরামিষ ছিল না। অস্ত্র সরবরাহ, খুন সহ বহু সিরিয়াস অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে! কিন্তু অভিযোগই সার। প্রমাণ করতে কেউ পারত না। তবে শেষের দিকে মস্তানতন্ত্রের নিয়ম মেনেই অনুগামীদের তরফে চ্যালেঞ্জ ধেয়ে আসছিল। বৃদ্ধ বাদশাকে কেউ কেউ মানতে চাইছিল না।
একবার হলো কী, কালী ঘোষের এক শাগরেদ কাল্টু ওপেন চ্যালেঞ্জ করে বসল। কালীকে ও দেখে নেবে! ভবানীপুরের ঠেকে কালী ঘোষের চোখে চোখ রেখে বলে দিল কাল্টু। কাল্টু উঠতি মস্তান। দেখতে নায়কোচিত। নিয়মিত ব্যয়াম করা, পেশিবহুল শরীর। কালীর বাড়ি ভবানীপুরের বকুল বাগানে আর কাল্টু থাকে চিত্রাভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকদের পাড়ায়। ভবানীপুরের অপর প্রান্তে। কী নিয়ে যেন ঝামেলা একটা চলছিল। একদিন এক হাট লোকের সামনে কালী ঘোষকে অপমান করে বসল কাল্টু। ছোট শ্রীহরির দোকানে কালী ঘোষকে রীতিমতো চমকে পাড়ার দিকে চলল কাল্টু। ভবানীপুরের ডনকে চমকাবারও লোক তাহলে আছে! সবাই চুপচাপ। ঠান্ডা চোখে কাল্টুর চলে যাওয়া দেখছিলেন কালী। দুটো পেশিবহুল হাত ঝলকাতে ঝলকাতে চলেছে কাল্টু। ওঁর একদা অনুগামী।
"তোমার তৈরি চামচা আজ পাছা দেখিয়ে চলে গেল গুরু," পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল। বক্তার মুখের দিকে না তাকিয়েই উত্তরে হিম শীতল গলায় কালী বললেন, "দেখা যাক"।
আরও পড়ুন- মস্তান থেকে মন্ত্রী! দাঁড়িয়ে থেকে গোটা বাজার লুঠ করিয়েছিলেন রাজ্যের এই মন্ত্রী
এই ঘটনার কিছুদিন পর ভবানীপুর কেঁপে উঠল বোমার আওয়াজে। প্রতিদিনের ব্যয়াম সেরে বাড়ি ফিরছিল কাল্টু। ঠিক সেই সময়ই কে বা কারা কাল্টুর পাছা লক্ষ্য করে বোমা মারল। দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, এমনই শক্তিশালী বিস্ফোরক! কারও বুঝতে বাকি ছিল না, এই ঘটনার নেপথ্যে কে? কিন্তু প্রমাণ কে দেবে? কাল্টু খুনে জেল হলো রঘুর। কালী ঘোষ দিব্যি ঠেকবাজি চালিয়ে গেলেন। কালী ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আরও একটা গল্প! কলকাতার জলসার ইতিহাসে একটা কলঙ্কজনক রাত অশোককুমার নাইট। মুম্বইয়ের বড় বড় তারকাদের নিয়ে সেই জলসা করার কথা ছিল। ঢাউস বিজ্ঞাপনে শহর ছেয়ে গিয়েছিল কিন্তু প্রচুর টাকার টিকিট কেটে অনুষ্ঠানের দিন কাউকেই মঞ্চে দেখতে পেল না দর্শক। ভয়ংকর পরিস্থিতি! ক্ষোভে, রাগে কারা যেন ভাঙচুর শুরু করল। সব থেকে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল ওই রাতে। দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত একদল, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করল। কলকাতা জুড়ে শোরগোল পড়ে গেল। পরের দিন সব দৈনিকে ছিছিক্কার, নিন্দা। ঘটনার বিশদ বিবরণ। এই জলসার আয়োজন করেছিলেন মস্তান টুলু মুখার্জি। কালী ঘোষেরই চ্যালা ছিলেন এককালে। তখন কালী ঘোষকে ছেড়ে নিজের দল বানিয়েছিল টুলু মুখার্জি কিন্তু মজার কথা হলো, অশোক কুমার নাইট নিয়ে যখন কলকাতায় চর্চা তুঙ্গে, সবাই টিকিট খোঁজ করছে, ঠিক তখনই ভবানীপুরের ছেলেদের জলসায় যেতে বারণ করেছিলেন কালী ঘোষ। বলেছিলেন, "যাস না! গণ্ডগোল হবে কিন্তু!" বারে বারে বারণ করেছিলেন তিনি। পরে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল, রাতের গণ্ডগোলের কথা কালী ঘোষ আগাম জেনেছিলেন কীভাবে? তবে কি... প্রশ্ন যাই জাগুক না কেন, প্রমাণ তো কিছুই নেই। শাগরেদ টুলু আলাদা হয়ে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে নেমেছে বলেই কি বকলমে সব কিছু কালী ঘোষই করালেন? প্রমাণ নেই কিছুই। শুধুই অনুমান।
লালবাজারের হিস্ট্রি শিট বলছে, ১৯৫৮ সাল নাগাদ কালী ঘোষের দল ছেড়ে নিজের দল বানান টুলু। টুলুর জীবনের নানা দুষ্কর্মের মধ্যে অবশ্যই একটি অশোক কুমার নাইট এবং ভয়ংকর বিপর্যয়। তাতে অবশ্য টুলুর কিছু যায় আসেনি। তিনি দিব্যিই ছিলেন । বাংলা চলচ্চিত্রের এক নামী তারকার পুত্র সেই সময় নানা অনুষ্ঠানে সক্রিয় থাকতেন। তিনি এক অদ্ভুত তথ্য দিলেন! তাঁর মতে, অশোক কুমার নাইটের বিপর্যয় টুলু নিজেই করাতে পারেন, কালী ঘোষ বা অন্য কেউ এর নেপথ্যে নাও থাকতে পারেন! কেন এমন ভাবছেন, ব্যাখ্যা চাইতে গেলে ওই তারকা পুত্র বলেন,
"আসলে ঘটনার আগের বছরই কিশোর কুমার নাইট করে বারীন ঘোষাল। বাম্পার হিট হয়। বারীনকে টক্কর দিতে টুলু আয়োজন করল অশোক কুমার নাইটের এবং বিপর্যয় হলো। বাস্তবে অশোক কুমার এসেছিলেন। গ্র্যান্ডে বসেছিলেন। বাকি মুকেশ সহ অন্যান্যরা আসেননি । তারপরই ভাঙচুর, মেয়েদের উপর অত্যাচার শুরু হলো। এখন এমন তো হতেই পারে প্রচারটা মিথ্যা ছিল। মানে, আয়োজক যত বম্বের শিল্পীর নাম বলেছেন, বাস্তবে কারও সঙ্গে চুক্তিই করেননি। তাই নিজেই বিপত্তি ঘটিয়েছিল টুলু। এতে লাভ তো সে ছাড়া আর কারও হয়নি। কারণ টিকিট বিক্রির বিপুল টাকা ফেরাতে হলো না। বিরাট রোজগার হয়ে গেল। একটু বদনাম হলো এই যা। সে তো এমনিই আছে। তাই না?"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিনেতা পুত্রের কথায় একটু খটকাই লাগে। সত্যিই কেউ এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে? চরিত্রটি সম্পর্কে বিশদে খোঁজ নিতে পুলিশের হিস্ট্রি শিটের পাতা উল্টালাম। হিস্ট্রি শিট টুলুর নামের পাশে লিখেছে, 'ডেস্পারেট ক্রিমিনাল'। যা খুশি তাই করতে পারে। ফলে ওই অভিজ্ঞ অভিনেতা পুত্রের অনুমান ভুল নাও হতে পারে।
টুলু মুখার্জি ছিলেন নেশাগ্রস্ত। মদের নেশা। নেশার জন্য চুরি, ছিনতাই, অপহরণ কিছুতেই বাধা ছিল না তাঁর । মদের খরচ তুলতে ১৯৫৬ সালের ২৮ অক্টোবর টুলু অনিল কুমার চক্রবর্তীকে অপহরণ করে এবং ১৭০০ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এই ঘটনায় বেকাদায় পড়েন টুলু এবং গ্রেফতার হন। পরে ছাড়াও পান। টুলু চেতলা, খিদিরপুর অঞ্চল জুড়ে তাঁর দুষ্কর্মের মুক্তাঞ্চল তৈরি করেন। ১৯৫৯ সালে আবার অপহরণ করেন টুলু। এরপরই আসে ১৯৬১ সাল। টুলু অপকীর্তিতে এক অনন্য নজির তৈরি করেন ওই বছরই।
যামিনী কান্ত রায় নামে এক শিক্ষাবিদ ছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশে জওহরলাল নেহরুর সরকার বিদ্যালয় স্থাপনে উৎসাহিত করছিল। এই পরিসরে সরকারি এবং বেসরকারি বহু স্কুল তৈরি করেছিলেন যামিনী কান্ত রায়। অনেকে গোপনে তাঁকে বিদ্যালয় ব্যবসায়ী বলতেও শুরু করে। যামিনী পড়ে যান টুলুর নজরে। যামিনীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতে মতলব আঁটেন টুলু।
যামিনী কান্ত রসা রোডে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালাতেন। সেই স্কুলে যূথিকা বসু নামে এক শিক্ষিকা চাকরি করতেন। একদিন সকালে হঠাৎই স্কুলে চড়াও হয় টুলু বাহিনী। সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফার।
কী ব্যাপার? কী ব্যাপার, অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করেন যামিনী।
সব বলছি, আগে বসুন। আপনার রস মজাতে হবে। অনেক বিদ্যাদান করেছেন। এবার চাঁদা দান করুন। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে টুলুর সাফ কথা।
- কীসের চাঁদা? এখন তো কোনও পুজো নেই।
- চাঁদার জন্য পুজো লাগে নাকি? অ্যাই ওকে আর দিদিমণিকে পাশাপাশি বসা। স্বামী আর ইস্তিরির মতো ।
- একী, একী! এসব কী করছ?
- যা করতে বলছি করো, নাহলে জান যাবে।
যামিনী ও যূথিকাকে পাশাপাশি বসিয়ে ছবি তুলল ফটোগ্রাফার। এরকম ছবি বাড়ির কর্তা গিন্নীরা তুলতেন মধ্যবিত্ত সংসারে। সেই রকমই ছবি প্রিন্ট হয়ে এল। ছবি যামিনীর টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে টুলু বললেন, "ভালো মানিয়েছে না, নতুন ইস্তিরির সঙ্গে ছবিটা! এক কাজ করি, আপনার বাড়ি, নেতা-মন্ত্রী সবার বাড়িতে একটা করে ফটো দিয়ে আসি। বলি, যামিনী বাবু বে করেছেন বুড়ো বয়সে। লজ্জায় বলতে পারছেন না। আপনারা সবাই মিলে ওঁর বিয়েতে মত দিলে তিনি নতুন সংসার শুরু করতে পারেন। বলি, বলে দিই?" হাসতে হাসতেই বলতে থাকেন টুলু। যামিনী মাথা নিচু করে বসে। বুঝতে পারছেন, বড় ফাঁসা ফেঁসেছেন।
নিচু স্বরে যামিনী বলেন, "তুমি জানো আমার যোগাযোগ কত উচুঁতলায়?"
নির্বিকার টুলু বলেন, "আপনি জানেন, আমার যোগাযোগ কত নীচে? পাতাল পর্যন্ত। আপনার উঁচুতলা ওখানে পৌঁছবে না।"
যামিনী বুঝলেন, এ বস্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গম্ভীরভাবে বললেন, "তা আমাকে এখন কী করতে হবে?"
টুলু এক গাল হেসে বলেন, "এই তো! মাথায় বুদ্ধি আছে দেখছি। বেশি কিছু না বুঝলেন, মাসে মাসে এক হাজার টাকা করে দেবেন, কেমন?"
এই ঘটনার পর যামিনীর কাছ থেকে দফায় দফায় মোট দশ হাজার টাকা নিয়েছিলেন টুলু। ষাটের দশকে সেই টাকা বড় অঙ্কের তো বটেই। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন যামিনী। মস্তান সাম্রাজ্যে এই টুলু চরিত্রটি যে দায়িত্বজ্ঞানহীন, উশৃঙ্খল এবং নেশার টাকা জোগাড় করতে যা খুশি তাই করতে পারে এমনই এক চরিত্র। টুলুর পক্ষে সব করা সম্ভব। টাকার জন্য টুলু এমন কাজ নেই যা করত না!
আরও পড়ুন- ধোঁয়াটে ক্রিক রো-র ঝলমলে জলসা! কলকাতা কাঁপাত মস্তান ভানু বোসের কালীপুজো
দক্ষিণের আরেক এলাকা কাঁপানো মস্তান ছিলেন বুলু মজুমদার। আর ছিলেন টালিগঞ্জ ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর পাশে ফ্যাতন গোস্বামী। এরা সবাই কমবেশি কালী ঘোষের অস্ত্রে বলীয়ান। দক্ষিণের মস্তানতন্ত্রে রাজনীতির ছায়া ছিল গভীর। এখানে রাজনৈতিক দলের হয়ে ঘাত প্রতিঘাত লেগেই থাকত। নকশাল আমলে যেমন ননী আইচের সশস্ত্র বাহিনী ছিল। এঁকে কখনই মস্তান বলা যাবে না কিন্তু বহু হামলার অভিযোগ, রাজনৈতিক খুনের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আছে। আবার রাসবিহারী অঞ্চলের বিধায়ক লক্ষ্মীকান্ত বসু এনএলসিসি বলে একটি সংগঠন করেছিলেন যা মস্তানদের সংগঠন বলেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত ছিল। এনএলসিসি ও দক্ষিণের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত মস্তানতন্ত্র একটা স্বতন্ত্র অধ্যায়। আবার সিপিএমের নিয়ন্ত্রিত মস্তান ছিল অনেক, যার মধ্যে টালিগঞ্জের রোবো খান অন্যতম। নকশাল আমলে বহুবার রোবোর উপর হামলা হয়। বরাত জোরে বারে বারে বেঁচে গিয়েছিল রোবো। সারাজীবন সিপিএমের ছত্রছায়ায় থেকেছে রোবো খান। আজীবন কংগ্রেস বিরোধী এক চরিত্র।
এছাড়া সত্তরের দশকে নব কংগ্রেসি গুন্ডা পর্যায়ে বেশ কিছু নাম উঠে আসে। যেমন, কানা অজিত। কুঁদঘাটের বোম, যার ভালো নাম পিকে সেনগুপ্ত আর খারাপ নাম বোম। নকশাল রুখতে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি একটা মডেল চালু করলেন কলকাতায়। পাড়ায় পাড়ায় গড়েন যুবক সমিতি, যাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ কালীপুজো করা। এই সব ঘিরেই গড়ে ওঠে সশস্ত্র যুবক বাহিনী। এই মডেলের অন্যতম সেরা উদাহরণ কুঁদঘাটের বোম। মিসা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল বোমকে। তবে মৃত সময়ের একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি তিনি। আজও বেঁচে আছেন। বাৎসরিক পুজোও হয় ধুমধাম করে। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, কালো অ্যাম্বাসেডর। যার সামনে দু' মাথায় দুটো ওয়ারলেস অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে আছে। দেখে শুনে যে কেউ বুঝে যাবে, জমানা বদলালেও বোমের মেজাজ বদলায়নি। এখনও তিনি মুকুটহীন সম্রাট। তার রেলার কাছে অতি বড় প্রভাবশালীও ফিকে এই ২০২৪-এও। নিজের পরিচয় দিতে এই ভদ্রলোকের একটা সিগনেচার টোন আছে! দেখা হলে খাঁটি বরিশালি টানে তিনি জানাবেন, "নমস্কার স্যার আমি পিকে সেনগুপ্ত। এইডা আমার ভালো নাম। আমার একখান খারাপ নামও আসে, বোম। কুঁদঘাটের বোম।" বলেই হাসতে শুরু করবেন তিনি। এই ফাঁকে বন্ধুত্ব জমে উঠলে, আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন, "আচ্ছা আপনার নাম বোম কেন? বোম মারতেন?" উত্তরে তিনি বলবেন, "একেবারেই না, আসলে হইছিল কী আমি যেই বছর জন্মাইছিলাম সেই বছরে বোম পড়ছিল। আমারে লইয়া নার্সরা দৌড় লাগাইল আর উনারা বোম বোম কইয়া চিৎকার করতে আসিল। সেই থিক্যা আমি বোম।"
এ নিয়ে বিস্তারিত লিখব পরে। শুধু এটুকু জানাই, এই ভদ্রলোক সম্পর্কে সিপিআইএমের মুখপত্রে রিপোর্ট বের হয়েছিল তিনি নাকি ঘোড়ায় চড়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে যেতেন। বোম অবশ্য বলেন, "এক্কেরে মিছা কথা স্যার।"