সবুজ স্বচ্ছ জল, রোমাঞ্চকর গুহা! ভারতের সদ্য আবিষ্কৃত এই পর্যটনকেন্দ্রে যাবেন কীভাবে?

Meghalaya Cave Adventure: সবচেয়ে লম্বা আর দীর্ঘ যে ১০টি গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে ভারতে, তার প্রথম ৯টিই মেঘালয়ে।

উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী, পশ্চিমে থর মরুভূমি থেকে পূর্বে বঙ্গদেশ- সুবৃহৎ ভারতবর্ষ ভৌগলিক বৈচিত্র্যময়। নদী, পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি, জঙ্গল কী নেই ভারতে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষ। তাই ভ্রমণপিপাসুদের মন বারেবারে ভারতের এই প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে জানতে, সামনে থেকে চাক্ষুষ করতে চায়। এমনই এক প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর জায়গা মেঘালয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘের রাজ্য মেঘালয়। ব্রিটিশদের আমলে যাকে ডাকা হতো 'প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড' নামে।

নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কোমর পর্যন্ত জল, এক পা, এক পা করে আপনি এগিয়ে চলেছেন, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়, গা বেয়ে উঠছে পোকা! অনেকে এসব শুনে শিউরে উঠে ভাবছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শংকরের সেই রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের কথাই বোধহয় বলা হচ্ছে! তবে, সে গল্পের প্রসঙ্গ আনলেও খুব একটা ভুলও হবে না এক্ষেত্রে। প্রতিদিনের দৌড়ে এইভাবেই গল্পের চরিত্র আর জীবনের চরিত্রগুলোকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে মানূষ। গুহার সমস্ত অ্যাডভেঞ্চারকে উপভোগ করতে ভালোবাসেন যাঁরা তাঁদের জন্য মেঘালয় এক আশ্চর্য খাজানা। মেঘালয়ের গুহার কথা জানলে তাই স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। অনেকেই মেঘালয়ের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা জানেন। মেঘালয় বলতেই তাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দর পাহাড়, রুট ব্রিজ আর উচ্ছ্বল ঝরনার ছবি। তবে তার বাইরেও মেঘালয়ের এই আশ্চর্য গুহাগুলোর আকর্ষণও নেহাত কম নয়।

এক একটা প্রাকৃতিক গুহা তৈরি হতে যে কত হাজার বছর সময় লাগে তার ইয়ত্তা নেই। এক একটা গুহা যেন ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। মেঘের রাজ্য মেঘালয়ে প্রায় ১৭০০ চুনাপাথর ও বেলেপাথরের গুহা আছে। ৩০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এই গুহাগুলো মূলত পূর্ব খাসি পাহাড়, দক্ষিণ গারো পাহাড় ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবস্থিত। তবে বেশিরভাগ গুহাই এখনও লোক চক্ষুর অন্তরালে। গুহা মানেই যে সরু, ঘন অন্ধকার এক চিলতে পথ তা নয়। গুহার আকার কখনও কখনও হতে পারে ধারণার চেয়েও বড়! প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে মেঘালয় আজও বিশেষ আগ্রহের বিষয়। মেঘালয়কে বলা যায় ভারতের ‘গুম্ফারাজ্য’! মানে, গুহার রাজ্য। সবচেয়ে লম্বা আর দীর্ঘ যে ১০টি গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে ভারতে, তার প্রথম ৯টিই মেঘালয়ে। মেঘালয়ে এত গুহার একটা কারণ হল - চুনাপাথর আর বৃষ্টি, গুহার জন্ম প্রক্রিয়ার এই দু'টি উপকরণই মেঘালয়ে পর্যাপ্ত!

আরও পড়ুন- জলের উপর ভাসমান আস্ত জাতীয় উদ্যান রয়েছে ভারতেই! কীভাবে পৌঁছবেন আশ্চর্য এই ঠিকানায়

জানলে অবাক হতে হয়, এই মেঘালয়েই অবস্থিত ক্রেম লিয়াত প্রাহ্, যা কিনা দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম প্রাকৃতিক গুহা। ক্রেম লিয়াত প্রাহ্ গুহা চুনাপাথরের তৈরি। এই গুহার দৈর্ঘ্য ৩০-৩৪ কিমি এবং এটি মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে অবস্থিত। খাসি ভাষায় ‘ক্রেম’ শব্দের অর্থ গুহা। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের শননগ্রিম রিজের ১৫০ টি জ্ঞাত গুহার মধ্যে এটি অন্যতম। ১৯৯২ সালে হওয়া 'Caving in the Abode of the Clouds Project' প্রকল্পের আওতায় ৪ জন ইউরোপীয় মেঘালয়ের এই গুহা অনুসন্ধানে যাত্রা শুরু করে। এই গুহাতে স্ট্যালাগমাইট (গুহার মেঝে থেকে উপরে ওঠা শিলা) ও স্ট্যালাকটাইট (গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকে) দেখা যায়। এই গুহার মধ্যে একটি প্রশস্ত পরিসর (৪০ মিটার চওড়া) রয়েছে যার নাম দেওয়া হয়েছে 'Aircraft Hanger'। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের যেখানে এই গুহা অবস্থিত সেখান থেকে এক ধরনের সিলেট গোত্রীয় চুনাপাথর পাওয়া গেছে, মনে করা হয়, ওই চুনাপাথর ইয়াসিন যুগের। ২০০৪ সালে যখন আবার নতুন করে এই গুহার অনুসন্ধান চালানো হয় তখন দেখা যায়, আরও অনেক গুহা এই ক্রেম লিয়াত প্রাহ গুহার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে যা তার উল্লেখযোগ্যতা আর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০০৫-২০০৬ সালে ক্রেম লিয়াত প্রাহে আরও দু'টি নতুন গুহার সংযুক্তিকরণ হয়। ১) Krem Um Im-5 ২) Krem Labbit (Khaidong)। ২০০৮ সালে আবার অনুসন্ধানের পরে আরও একটি গুহা ক্রেম লিয়াত প্রাহের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং এরপর এই গুহার দৈর্ঘ্য বেড়ে হয় ৩০.৩৯৭ কিমি. ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম গুহা যা ৩০ কিমি দীর্ঘ।

ক্রেম লিয়াত প্রাহের পরে মেঘালয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য গুহা হিসেবে যার নাম উঠে আসে তা হল ‘ক্রেম পুরী’। ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম গুহা হিসেবে পরিচিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,০২৫ ফুট (১২২৭ মিটার) উচ্চতায় এবং একটি গভীর উপত্যকাকে উপেক্ষা করলে, গুহার মুখটি একটি খাড়া পাহাড়ের গোড়ায়। গুহাটি ২৪.৫ কিমি (১৫ মাইল) দীর্ঘ এবং ১৩ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে রয়েছে, যা আকারে জিব্রাল্টার দ্বিগুণ – মৌসিনরামের এই সবুজে ভরপুর গুহা, পৃথিবীর সবচেয়ে আর্দ্র স্থান হিসাবে খ্যাত।

বিশ্বের দীর্ঘতম বেলেপাথরের গুহা হিসাবে নাম উঠে এল মেঘালয়ের ক্রেম পুরীর। মেঘালয়ের পূর্ব খাসি জেলার মৌসিনরামের লেইতসোহাম গ্রামের কাছে গুহাটির খোঁজ মেলে। ২০১৬-তে প্রথম গুহাটির খোঁজ পাওয়া গেলেও এর দৈর্ঘ্য নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। ক্রেম পুরী-তে ২৫ দিনের একটি অভিযানে গিয়েছিলেন মেঘালয় অ্যাডভেঞ্চার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এমএএ) প্রায় ৩০ জন বিশেষজ্ঞ। ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত অভিযান চালানো হয় গুহাটিতে। গুহাটির মাপজোক করে দেখা যায়, এর দৈর্ঘ্য ২৪, ৫৩৮ মিটার, যা এভারেস্টের উচ্চতার প্রায় তিন গুণ। সবচেয়ে উল্লখযোগ্য যে, এই গুহায় ডাইনোসরের জীবাশ্মও উদ্ধার হয়েছে। জীবাশ্মবিদদের ধারণা, ওই জীবাশ্ম মোসাসরাসের। এরা এক প্রকার জলচর মাংসাশী প্রাণী। এদের অস্তিত্ব ছিল সাড়ে ৬ থেকে ৭ কোটি বছর আগে।

ক্রেম পুরী গুহাটি যদিও দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে তবুও মেঘালয় সরকার সতর্ক করে দিয়েছে, যেহেতু এই গুহাটি খুবই নতুন আবিষ্কৃত এবং এই গুহার মধ্যে এমন অনেক জায়গা আছে যার সম্বন্ধে তাদের কোনও ধারণা নেই তাই কোনও দর্শকই যেন একা একা এই গুহা আবিষ্কারে না যান। কারণ গুহাটি নিরাপদ নয়। এই গুহার প্রবেশপথ এতটাই সরু যে নিঃসন্দেহে কোনও ক্ষীণ-হৃদয় ব্যক্তির পক্ষে উপযুক্ত নয়। ক্রেম পুরী গুহার ভেতরে কিছু কিছু অংশে গুহা অন্বেষণকারদের পেটের উপর ভর করে চলতে হয়। এই গুহার ভেতর শত শত প্যাসেজ এবং করিডোর দিয়ে এমনভাবে সাজানো যেন এক জটিল গোলকধাঁধাঁ।

বেশিরভাগ গুহা দেখলে বোঝা যায় যে সেখানে হাজার বছর ধরে কোনও মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি কিন্তু কিছু অংশ এমনও আছে যা যুদ্ধের আশ্রয়স্থল, শিকারির আশ্রয় এবং সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

ক্রেম পুরী গুহার তাপমাত্রা সবসময় ১৬-১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। গুহার ভেতরে কখনও অক্সিজেনের অভাব হয় না কারণ গুহার বাইরের তাপমাত্রা যাই হোক না কেন গুহার ভেতরে বিভিন্ন ফাটল, ছোট ছিদ্র এবং দুটি প্রবেশদ্বার দিয়ে সর্বদা বাতাস প্রবাহিত হয়। তাও গুহার গাইড খাপরানের কথায়, “You have got to be careful all the time when you are inside. You can never take chances with a cave”.

আরও পড়ুন- পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, বাংলাদেশ, জলপথেই ঘটছে মেলবন্ধন

বিশ্বের মধ্যে মেঘালয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। তাই বিশেষজ্ঞের ধারণা, মেঘালয়ে সৃষ্টি হওয়া বেলেপাথরের এই চিত্তাকর্ষক গুহাগুলি যে এমন প্রাকৃতিক উপায়ে গড়ে উঠবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাদের মতে, ক্রেম পুরী ও ক্রেম লিয়াত প্রাহের মতো গুহাগুলি মেঘালয়ের জলবায়ু ও প্রাণিজগৎকে বোঝার চাবিকাঠি। রাজ্যের সমৃদ্ধ কয়লা খনি এবং চুনাপাথর উত্তোলন ব্যবসা এই গুহাগুলির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গুহা অন্বেষণ এতদিন শুধু ভারতীয় গুহা মন্দিরগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গুহা অন্বেষণ এখন ক্রমবর্ধমান 'অ্যাডভেঞ্চার অ্যাক্টিভিটি' হয়ে উঠেছে। অ্যাডভেঞ্চার প্রেমিক মানুষ এখন 'অফবিট' বা অনাবিষ্কৃত এইসব জায়গা খোঁজের চেষ্টা করছেন। সদ্য আবিষ্কৃত নতুন গুহার থেকে অফবিট আর কীই বা হতে পারে। তবে এসব জায়গায় অবশ্যই প্রয়োজন একজন গাইড।

কীভাবে যাবেন

ক্রেম লিয়াত প্রাহ যেতে হলে শিলংয়ের লেংপুই এয়ারপোর্টে নেমে সেখান থেকে গাড়ি করে এই গুহাতে যেতে হবে।

আর ক্রেম পুরী গুহা যেতে হলে শিলং এয়ারপোর্টে নেমে গাড়ি করে এক ঘণ্টার দূরত্ব। যদি মেঘালয়ের দৃশ্য উপভোগ করতে চান তাহলে গুয়াহাটি থেকে চার ঘণ্টার সফরও করতে পারেন।

কখন যাবেন

মেঘালয়ের এই গুহা দর্শনের সবথেকে ভালো সময় এপ্রিল থেকে জুন, সেটাকে পুজো অবধি টেনে নিয়ে যাবেন না। অক্টোবরে মেঘালয়ের আবহাওয়া এতটাই আর্দ্র যে গুহা দর্শন শিকেয় তুলতে হবে। এপ্রিল থেকে জুনে মৌসিনরাম এবং তার আশেপাশের অঞ্চলের আবহাওয়া অনুকূল থাকে এবং বাতাসে অল্প হিমেল হাওয়াও অনুভূত হতে পারে। তাই বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে বর্ষাকালে ব্যবহৃত সব জিনিস নিয়েই বেরোতে হবে।

 

More Articles