হু হু করে বাড়ছে মানসিক রোগ, নতুন মহামারীর সামনে ভারত?
Mental Health: এখনও মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সেই মাত্রায় সচেতন নয়। লোকভয়, লজ্জা এমন নানা শব্দ এসে চেপে ধরে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে গেলেও।
শরীরের সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করে না মানুষ। কিন্তু আজও মনের অসুখে ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবলেও হাজার রকম ট্যাবু, লোকভয় পা জড়িয়ে ধরে। 'লোকে কি বলবে', 'আমি কি তবে পাগল' এমন হাজারটা সমাজের তৈরি করে দেওয়া বস্তপচা বাক্যের কাছে এসেই হাঁটু মুড়ে বসে সাধারণ মানুষ। মানসিক সমস্যা বাড়তে বাড়তে অবসাদ, অবসাদ থেকে আরও ক্রনিক কোনও সমস্যায় রূপান্তরিত হয়। অথচ সাহস করে ডাক্তার দেখানো আর হয়ে ওঠে না। তবে এখন এই পরিস্থিতিকে পিছনে ফেলে অনেকটাই সচেতন হয়েছে দেশ। ট্য়াবুর অন্ধকার সরিয়ে ধীরে ধীরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে দেশ। তার জন্যই সম্ভবত বাড়ছে নথিভুক্ত হওয়া কেসের সংখ্যা। দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির পরিসংখ্যান বলছে, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে দেশ জুড়ে। তবে সেই সব সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো কি সত্যিই রয়েছে দেশে?
দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি সম্প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও তার পরিকাঠামোর উপরে ১৪৮তম রিপোর্ট জমা করেছে সংসদে। যেখানে দেখা গিয়েছে দেশ জুড়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা। এর আগেও তারা জানিয়েছিল, সেই সমস্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো, স্বাস্থ্যকর্মী, এমনকী নেই প্রয়োজনীয় সরকারি বরাদ্দও। কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে এক লক্ষ মানুষে মাত্র ০.৭৫ জন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। যা রোগীর তুলনায় ভয়ানক রকম কম।
আরও পড়ুন: হু হু করে বাড়ছে মানসিক অসুখে আক্রান্ত! কোন চরম পরিণতির দিকে এগোচ্ছে ভারত
কমিটি আরও দাবি করেছে, যদি প্রতি এক লক্ষ জন রোগীতে তিন জন করে মনরোগ বিশেষজ্ঞকে ধার্য করা যায়, তাহলেও এখন অন্তত ২৭,০০০ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন ভারতে। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্য পেশার ক্ষেত্রেও সংখ্যাটা একই রকম কম। শুধু সাইকিয়াট্রিস্টই নয়, সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিক সমাজকর্মী এবং নার্সেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে এই মুহূর্তে দেশে। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাইকিয়াট্রি কোর্সগুলিতে আসন সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছে কমিটি।
করোনাকালীন ওই দু-আড়াই বছর মানুষের মনে এক দীর্ঘমেয়াদি ছাপ রেখে গিয়েছে। টলে গিয়ে মানুষের সাইকো-সোশ্যাল স্থিতাবস্থা। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের উপর। একই সঙ্গে, তাদের যত্ন নেবেন যাঁরা, অসুখ-অতিমারি-লকডাউন প্রভাব ফেলেছে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও। ফলে গোটা সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যও কোনও না কোনও ভাবে বিঘ্নিত হয়েছে অতিমারি পর্বে। অনেকেই বাধ্য হয়েছেন এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগত পরিকাঠামোর অভাব কিন্তু সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা। আর সেই অবস্থাটা বদলাতে মানসিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে সরকারকেই। আর তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নীতি পরিবর্তন। এই মুহূর্তে দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে পলিসি রয়েছে সরকারের, তা যথাযথ করে তুলতে নজর দিতে হবে কেন্দ্রকেই।
গত তিন বছরে মাত্র ১২ জন রেজিস্টার্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট পেয়েছে তেলঙ্গানা। ২০১৫-১৬ সালে হওয়া স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ দফতরের একটি মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমীক্ষাতেই সামনে এসেছে এই তথ্য। দেখা গিয়েছে, ২০১৫-১৬ সালের সমীক্ষার ফলাফল এবং ২০২৩ সালে হওয়া সমীক্ষার ফলাফলে বিশেষ পরিবর্তন নেই। কারণ পরিস্থিতি বদলায়নি এতটুকু। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের যে ঘাটতি তা কিন্তু কোনও ভাবেই মেটানো যায়নি এতগুলো বছরে। তার পাশাপাশি রয়েছে দুর্বল পরিকাঠামো ও সামাজিক ট্যাবু।
এখনও মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সেই মাত্রায় সচেতন নয়। লোকভয়, লজ্জা এমন নানা শব্দ এসে চেপে ধরে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে গেলেও। ফলে শুধু স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুললেই হবে না। মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতাও বাড়িয়ে তুলতে হবে। চালাতে হবে প্রচার। সেই খাতেও সরকারকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এমনিতেও গত কয়েক বছরে টারশিয়ারি কেয়ার প্রোগ্রামের ফান্ডিং কমেছে ক্রমশ। যার ফলে এই সব মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলির পরিকাঠামোও ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ওই কমিটি।
২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের মোট বাজেট মোটামুটি ৮৯,১৫৫ কোটি টাকার কাছে। যার মধ্যে থেকে ২,৯৮০ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণার কাজে। বাজেটের বাদবাকি অংশ বরাদ্দ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের বিভাগের জন্য। ২০২৪ অর্থবর্ষে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ সেই তুলনায় প্রায় নেই-এর কাছাকাছি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্থ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স, বেঙ্গালুরু পেয়েছে ৭২১ কোটি, লোকপ্রিয় গোপিনাথ বরদোলোই রিজিওয়ানাল ইনস্টিটিটিউট অব মেন্টাল হেল্থ, তেজপুর পেয়েছে ৬৪ কোটি এবং ন্যাশনাস তেলে-মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামকে বরাদ্দ করা হয়েছে ১৩৪ কোটি। যা দিয়ে দেশের মানসিক স্বাস্থ্যের হাল ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করছে অভিজ্ঞরা।
এদিকে দেশজুড়ে বাড়ছে নানাবিধ মানসিক সমস্যা। মনখারাপ, ঘুম না হওয়া, মানসিক চাপ, অ্যাংজাইটি, অবসাদ তার মধ্যে রয়েছে শীর্ষে। এই সমস্ত রোগের চিকিৎসার জন্য সরকারের এই বরাদ্দ একেবারেই যথেষ্ট নয়, এমনটাই মনে করছে ওই কমিটি। তাদের দাবি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের উচিত পরিস্থিতি ভালো ভাবে খতিয়ে দেখা। একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে প্রথমেই ফাঁক এবং ঘাটতির জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে হবে মন্ত্রককে। তবেই পদক্ষেপ সম্ভব বলেও মনে করছে কমিটি।
২০১০ সাল থেকেই যে ভাবে বিশ্ব অর্থনীতি মার খেয়ে চলেছে, দেশের মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগত পরিকাঠামোর পতনের জন্য তাকেই দায়ী করেছেন, সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র রেসিডেন্ট ডক্টর যশবন্ত। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের খাতে অবিলম্বে বরাদ্দ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে। এই মর্মে কেন্দ্রীয় সরকারকে আর্জিও জানান তিনি। বাড়াতে হবে সাইকিয়াট্রি রেসিডেন্ট প্রোগ্রাম, যাতে আরও বেশি করে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী পায় দেশ। তার পাশাপাশি মানসিক হাসপাতালেরও অভাব রয়েছে দেশে, সে ব্যাপারটিও সামনে এনেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: এই বিশেষ পদ্ধতিতে বাগান করলে পাওয়া যাবে মানসিক শান্তি, বাড়বে স্মৃতিশক্তি
শুধু কি তাই, মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে ধরনের ড্রাগ ও ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তাও দেশে বেশ অমিল। সেই ব্যাপারটিতেও নজর দিতে হবে সরকারকেই। একই সঙ্গে মানসিক স্বাস্য সংক্রান্ত সমস্যাতেও যাতে রোগীরা টেলি-মেডিসিন সুবিধা পেতে পারেন, তার আর্জি জানিয়েছে ওই কমিটি। একই সঙ্গে ক্লিনিকের সুবিধাও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে তারা। আর তবেই দেশ জুড়ে বেড়ে চলা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে ভারতের মতো জনবহুল দেশের পক্ষে। নাহলে হয়তো কোনওদিন মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মহামারীর মুখোমুখি হবে দেশ।