মহৎ সাজতে কোনও নির্বিষ লেখা লিখতে হয়নি কুন্দেরাকে

Milan Kundera: জোকসের ইংরাজি অনুবাদ তাঁর অপছন্দ আর ফরাসি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছেন অদ্বিতীয় মার্ক্সবাদী কবি লুই আরাগঁ

আজ এই শ্রাবণের রাতে মিলান কুন্দেরার প্রয়াণ সংবাদে আমার কেবলই মনে পড়ে সুবিনয় মুস্তফী-র কথা। একসঙ্গে বেড়াল ও বেড়ালের-মুখে-ধরা ইঁদুর হাসাতে এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল এই দুই ভুয়দর্শী যুবার! বস্তুত, ইওরোপ, বৈকুণ্ঠ ও নরকের থেকে কত দূরে আছে এটা বোঝানোর জন্য আমাদের মধ্যে আর কোনও ইওরোপিয় স্রষ্টাই রইলেন না। প্রথমে চলে গেলেন প্রায় সমবয়সি জাঁ লুক গোদার আর তারপরেই সওয়া বছরের বড় মিলান কুন্দেরা। গোদার মধ্য ষাটে তাঁর অবিস্মরণীয় ছবি পিয়েরো ল্যো ফু-তে জানিয়েছিলেন, ‘আমার ইজেরের তলায়... স্ক্যান্ডাল... তারুণ্যের রেখা। একদা ছিল গ্রিক সভ্যতা, ছিল রেনেসাঁ, এখন আমদের সভ্যতা প্রবেশ করছে পায়ুপথে।' এই ছবির মাত্র কয়েক বছর পরেই বসন্তের উত্থান প্রাগে ও প্যারিসে। কুন্দেরা দুনিয়ায় পরিচিত হলেন 'দ্য জোকস’-এর লেখক হিসেবে। আর আশ্চর্য, এই লেখাটিকে আমরা অনেকেই রাজনৈতিক ইস্তেহার হিসেবে পড়তে চেয়েছিলাম। স্তালিনের বিরুদ্ধে জঙ্গি ঘোষণা যেন। কিন্তু সমস্ত মহৎ সৃষ্টিই যেমন হয়, গোদার বলেছিলেন সমস্ত টেক্সটই শেষ পর্যন্ত প্রণয় পত্র, কুন্দেরাও এক টেলিভিশন আলোচনাকে বিলম্বিত করেছিলেন এই বলে যে, জোকস শেষ পর্যন্ত প্রেমের গল্প। "স্পেয়ার মি ইওর স্ট্যালিনিজম, প্লিজ। দ্য জোকস ইজ আ লাভ স্টোরি।" আমাদের যৌবনে মিলান কুন্দেরা আমাদের ভাসিয়েছিলেন তেতো কফির উল্লাসে, বোকা বোকা নীতিকথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আমরা খুঁজে ফিরছিলাম পাতালের চিরকুট। আর সবচেয়ে বড় কথা যে, বাংলা উপন্যাস তো কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল; কপালকুণ্ডলা, চতুরঙ্গ, পুতুল নাচের ইতিকথা ও ইছামতী। তাই আমাদের ভালো লেগেছিল যখন কুন্দেরা দাবি করলেন, মাদাম বোভারি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই উপন্যাস উন্নীত হয়ে গেছে কবিতার স্তরে আর প্রকৃত উপন্যাসিক তাঁর শব্দে ততটাই চুম্বন রাখেন যতটা একজন কবি রাখেন তাঁর প্রতিটা শব্দে।

কুন্দেরাকে আমরা কেন আমাদের আত্মার আত্মীয় ভেবেছিলাম? তিনি বড় লেখক কি মাঝারি, এসব আমাদের মাথায় ছিল না। আমরা জানতাম, জোকসের ইংরাজি অনুবাদ তাঁর অপছন্দ আর ফরাসি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছেন অদ্বিতীয় মার্ক্সবাদী কবি লুই আরাগঁ- যাঁর মতে শতাব্দীর অন্যতম মহৎ উপন্যাস এই গ্রন্থ। তবু আমরা দেখলাম কুন্দেরা পোষ মানছেন না। তিনি গৃহপালিত জন্তু নন। সেই জন্যই বোধহয় চেক সভ্যতা থেকে নোবেল কমিটির সবচেয়ে বড় কলঙ্ক উন্মোচিত হচ্ছে- না ফ্রানৎস কাফকা না মিলান কুন্দেরা নোবেল পেলেন। এই নির্বুদ্ধিতা লুকিয়ে ফেলতে সাহেবদেরও অনেক সময় লাগবে। তাঁর দ্য 'বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এর পাতা উল্টোচ্ছিলাম। সেখানে দেখি, তিনি দেবদূত শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ লিখেছেন আর সেখানেই কুন্দেরার অন্তর্ঘাত আবিষ্কার করি। ইউজিন ইউনেস্কোর 'গণ্ডার' পড়া হচ্ছে নিয়মানুগত্যের মধ্যে এবং সেই নিয়ম একটি কমিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। যে মুহূর্তে পড়ুয়া বালিকাটি আবিষ্কার করে এই কৌতুক সঙ্গে সঙ্গে ইওরোপ জুড়ে গণ্ডারের অট্টহাসি শোনা যায়। এরপর কুন্দেরা আমাদের কোনও বিস্ময়ের অবকাশ না রেখে পঞ্চম পরিচ্ছেদে একটা নাচের কথা বলেন যা তিনি স্বয়ং নেচেছিলেন ১৯৪৮ সালে যখন নাৎসিদের হাত থেকে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং তিনি পার্টি সদস্য। তারপর একদিন বুঝলেন, দার্শনিকও হিম হয়, প্রণয়ের সম্রাজ্ঞীরাও মলিন হয়ে আসে। যা বলার ছিল তা না বলা হলেই ভালো হতো। "দেন ওয়ান ডে আই সেইড সামথিং আই উড বেটার লেফট আনসেইড।" এই অকথিত শব্দমালাই তিনি সারাজীবন সাংকেতিক ভাষায় প্রকাশ করে গেছেন।ভাগ্যিস পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার জন্য তাঁকে কোনও নির্বিষ লেখা লিখতে হয়নি।

আরও পড়ুন- ‘রসিকতা’ ও উত্তরাধিকার: এক ছিন্নমূলের ‘শো-অফ’

মিলান কুন্দেরা সেই অর্থে রাজনৈতিক লেখক নন বরং তিনি দর্শনের অনুবর্তী। এই নাচ তিনি ১৯৫০ সালেও দেখেছিলেন যখন একজন সুররিয়ালিস্ট লেখক কালান্দ্রাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো দেশদ্রোহীতার অপরাধে। আর্ত কুন্দেরা তখন ফরাসি সাম্যবাদী দলের প্রতিনিধি আন্দ্রে ব্রেতোঁ ও পল এলুয়ারকে অনুরোধ করেছিলেন প্রতিবাদ জানাতে। কিন্তু কী মর্মান্তিক হাহাকারে কুন্দেরা লিখলেন, এলুয়ার বড় ব্যস্ত ছিলেন প্যারিস, মস্কো, প্রাগ এথেন্সে নাচের স্টেপগুলো দেখতে। এবং এই জুন মাসেই কুন্দেরা দেখলেন এলুয়ার তাঁর ভাবাবেগময় কবিতা পড়ে চলেছেন প্রাগেই একটি তরুণীর কাঁধে হাত রেখে আর জানাচ্ছেন, যদি কোনও মানুষ শান্তির দ্বারা অধিকৃত হয় তাঁর মুখ থেকে হাসি মুছে যাবে না। কুন্দেরা চাপা বিদ্রূপে চলে গেলেন, হায় হাসি, হায় দেবদারু, কী করে বুঝব কোনটা হাসি কোনটা শান্তি, এই যে লেখা তা একান্তভাবেই ইওরোপিয়। এই স্বপ্ন ও বাস্তবের অন্তর্বতী প্রতিবেদনকে আমি গার্সিয়া মার্কেজ, গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে তুলনা করব না। অক্ষরের প্রতিরোধ বলতে যে বিস্মরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা কুন্দেরা বলেন তা আসলে ইওরোপের মূল প্রাণসত্ত্বার সন্ধান। ইওরোপ অন্তত আধুনিকতার অর্থে বুঝেছিল, জ্ঞানের অধিকার তার মৌলিক অধিকার। আর কুন্দেরা তরুণ বয়সে উপলব্ধি করছিলেন যে বিজ্ঞান, বিশেষত প্রায়োগিক বিজ্ঞান এসে ইওরোপ মহাদেশকে এমনভাবে প্লাবিত করেছে যে তার প্রধান সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে, হাইডেগারের ভাষায় 'দ্য ফরগেটিং অব বিয়িং'। কুন্দেরা মনে করেছিলেন যে, উপন্যাস এক বিকল্প পন্থা নেবে ইতিহাস লেখার জন্য। যে জন্য তিনি থেরভান্তেস, বালজাক, তলস্তয়, টমাস মানকে খেয়াল করছিলেন। নজর রাখছিলেন তাঁরই স্বদেশবাসী ফ্রানৎস কাফকার দিকেও। এবং ক্রমশই তাঁর এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হচ্ছিল যে, দেকার্তে যদি বুদ্ধিমান জগতের প্রবক্তা হন তাহলে দোলাচল এবং দ্বিধাগ্রস্ততার অন্য মেরু ডন কুইকজোটের লেখক থেরভান্তেস। আর উপন্যাসকে কোনও নৈতিক অবস্থান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না, তা একধরনের অসমাপ্ত তদন্ত কার্য। তিনি চাইছিলেন এমন এক সীমান্তবর্তী পথ যা জোসেফ কে-কে নিষ্পাপ শহিদ মনে করে না আবার আদালতকেও স্বর্গীয় বিচারালয় মনে করে না। 'আইদার-অর' তত্ত্বটি তিনি সমূহ পরিত্যাগ করেছিলেন।

কুন্দেরা জানতেন, লেখা লেখককে অতিক্রম করে যায়। ধার্মিকরা যেভাবে ঈশ্বরের উপাসনা করে, কমলকুমার মজুমদার যেমন বলেন, 'লেখাও একরূপ তাহাকে ডাকা'- মিলান কুন্দেরা ঠিক তাই মনে করতেন। ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত চেকোস্লোভাকিয়ায় তাই তাঁর পক্ষে সহজ ছিল জর্জ অরওয়েলের মতো কোনও ১৯৮৪ লেখা। অথচ কুন্দেরা মনে করলেন, এই উপন্যাস একটি প্রচার পুস্তিকা হতে পারে কারণ তার উৎস এবং সমাপ্তি আগে থেকেই অরওয়েলের জানা। অন্যদিকে, বড় লেখকরা তাই আবিষ্কার করেন যা উপন্যাসই আবিষ্কার করতে পারে। যেমন দস্তয়ভস্কি ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসে থ্রিলার টপকে চলে গেলেন পাপ ও পুণ্যের পরপারে। আমরা কাকে রোমাঞ্চকর অভিযান বলব যদি কাফকার নায়ক জোসেফ কে-র সমস্ত আচরণই এক ধরনের স্বপ্নে ঘটে থাকে? আসলে মিলান এক ধরনের প্র্যাকসিসের সন্ধান করছিলেন, ফ্লোবেয়ার যা উদযাপন করেন তা জেমস জয়েসের ইউলিসিসে উন্মোচিত হয়। আর সেই বহুস্রোত ও বহুস্বর সমন্বিত সঙ্গীতকেই মিলান কুন্দেরা পেতে চেয়েছিলেন তাঁর রচনার পর রচনায়। তিনি নেহাত সমালোচক নন, সভ্যতার সংকটও তাঁর উপজীব্য নয়। তিনি জানতেন ইওরোপের আত্মা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। তাঁর কর্তব্য হচ্ছে এই মহাদেশের অন্ত্যেষ্টিতে পা মেলানো। দূর ভারতবর্ষ থেকে আমি মিলান কুন্দেরাকে শ্রদ্ধা জানাই, তার কারণ তিনি ঈশপের নীতিমালা প্রণয়ন করেননি, বার্তাজীবী সমাজে নোয়ার নৌকাবৎ ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেননি, বরং অনেকদিন বাদে তাঁর লেখায় আমরা আবিষ্কার করেছিলাম হত্যা ঝলমলে ফাঁসির কাঠ। লেখকের অন্তিম কাজ তো সত্যকে দেখা। যমালয়ে প্রশ্ন করার অধিকার সবার থাকে না। নচিকেতা ও মিলান কুন্দেরার থাকে।

বিদায় কুন্দেরা।

More Articles