হজ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ১,৩০০ পুণ্যার্থী, কেন মৃত্যুনগরী মক্কা?
Hajj Deaths: এই মুহূর্তে সৌদি আরবের মক্কার তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে ৫১ ডিগ্রি। ফলে চরম গরমে তীর্থ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বহু পুণ্যার্থী।
প্রতিবছরই হজ করতে পুণ্যতীর্থ মক্কায় যান লক্ষ্য লক্ষ্য ধর্মপ্রাণ মুসলিম। কিন্তু সেই পুণ্য অর্জনই যে কাল হবে, তা কি এ বছর হজে যাওয়ার আগে জেনেছিলেন তাঁরা? ভয়ঙ্কর দাবদাহে পুড়ছে সৌদির পবিত্র নগরী মক্কা। আর সেই গরমের বলি এখনও পর্যন্ত অন্তত ১,৩০০ জন হজযাত্রী। একের পর এর হজযাত্রী করতে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। যার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ভারতীয়ও। যারা হজের জন্য গিয়েছিলেন সৌদি আরবে।
এই মুহূর্তে সৌদি আরবের মক্কার তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে ৫১ ডিগ্রি। ফলে চরম গরমে তীর্থ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বহু পুণ্যার্থী। সৌদি আরবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহাদ আল-জালাজেল রবিবার বলেছেন, চলতি বছরের হজযাত্রায় এ পর্যন্ত মোট ১,৩০১ জন মারা গেছেন। সৌদি কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত যে কজন হজযাত্রীর মৃত্যুর খবর মিলেছে, তাঁদের বেশিরভাগই সরকারি অনুমতি ছাড়াই হজ করতে এসে পড়েছে এ দেশে। ফলে তাঁদের থাকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। সঠিক নথিপত্র না থাকায় বহু ক্ষেত্রেই হোটেলে জায়গা হয়নি। খোলা জায়গাতেই কোনও মতো দিনযাপন করতে হয়েছে তাদের। সৌদি আরবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহাদ আল-জালাজেল জানিয়েছেন, এ বছর মৃত ১৩০১ জন হজযাত্রীর মধ্যে অন্তত ৮৩ শতাংশ যাত্রীর কাছেই সরকারি অনুমোদন নেই। ফলে মাইলের পর মাইল রোদের মধ্যে হাঁটতে হচ্ছে তাদের। অনেকেরই বয়স বেশ বেশির দিকে, কারওর রয়েছে বয়সজনীত বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা। এই ভয়ঙ্কর গরম তাঁদের শরীর আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ৫৫ বছরে উষ্ণতম রাত, শতাধিক মৃত্যু! কেন মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে দিল্লি?
প্রবল গরমে হজযাত্রা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া বহু যাত্রীকেই চিকিৎসার জন্য বিমানে করে রিয়াধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, বহু যাত্রীর কাছেই সঠিক পরিচয়পত্র না থাকায় তাঁদের মৃতদেহ শনাক্তকরণেও বহু সময় লেগে গিয়েছে। বহু নিহতেরই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে মক্কাতেই। ওই ১,৩০১ জন মৃত হজযাত্রীর মধ্যে অন্তত ৯৮ জন ভারতীয় রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। মৃতদের মধ্যে ৬৬০ জন মিশরীয় রয়েছেন। প্রায় সকলেই বেআইনিভাবে হজ করতে গিয়েছিলেন। এই অভিযোগের পরে বেআইনিভাবে হজযাত্রার ব্যবস্থা করা ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মিশর সরকার কড়া পদক্ষেপ করেছে বলে খবর। মৃতদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া-সহ অন্তত ১০টি দেশের নাগরিক।
ইতিমধ্যেই ভারতের বিদেশমন্ত্রকের তরফেও সেই তথ্য মিলেছে। মোট ৯৮ জন ভারতীয়ের মৃত্যুর খবর মিলেছে এখনও পর্যন্ত। প্রতিবছরই হাজার হাজার ভারতীয় হজযাত্রায় যান। এবার সরকারি হিসেবে ভারতীয় হজ যাত্রীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৭৫ হাজারের কাছাকাছে। যার মধ্যে ৯৮ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এর মধ্যে আরাফাতের দিন ৬ ভারতীয়ের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি দুর্ঘটনার জেরে ৪ ভারতীয়ের মৃত্যু হয়েছে ইতিমধ্যেই। গত বছরও হজ যাত্রা করতে গিয়ে অন্তত ১৮৭ জন ভারতীয়ের মৃত্যুর খবর মিলেছিল।
ইসলাম ধর্মের প্রধান পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হল এই হজযাত্রা। সেই জন্যই প্রতি বছর মক্কা-মদিনা দর্শনে ভিড় জমান পুণ্যার্থীরা। আমজনতা থেকে শুরু করে বহু তারকাও হজযাত্রায় সামিল হন অনেকেই। প্রতি বছর হজযাত্রা উপলক্ষে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ সৌদি আরবে যান। প্রায় প্রতিবছরই হজে কোনও না কোনও দুর্ঘটনা ঘটে। কখনও পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু তো কখনও মহামারী। এবার মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছে হজযাত্রায় এই ভয়াবহ গরম। একটি রিপোর্ট বলছে, প্রতিবছরই কম আয়ের দেশ থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ হজে আসেন। যাঁদের মধ্যে বহু মানুষই আবার হজ-পূর্ব স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
যদিও এ বছর হজ মৌসুমে স্বাস্থ্য পরিকল্পনার সাফল্যের দিক তুলে ধরেছে সৌদি আরব। “বড় সংখ্যক হজযাত্রী এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে চ্যালেঞ্জ হলেও হজ মৌসুমে কোনও ধরণের জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকিমুক্ত” বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহাদ আল-জাল্লায়েল। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে এই বছর প্রায় ১৮ লাখ ৩০ হাজারের মতো হাজী এই তীর্থযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছেন যার মধ্যে ১৬ লাখই এসেছিলেন বিদেশ থেকে। দুই ডজনের বেশি দেশ থেকে মানুষ হজ পালন আসা মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মৃত্যু হয়েছে মিশরীয়দের। একজন আরব কূটনীতিক জানিয়েছেন, মিশরের যে ৬৫৮ জন ব্যক্তির মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে তাদের সকলেরই মৃত্যু হয়েছে চরম তাপের কারণে। তাঁদের বেশিরভাগের কাছেই যথাযথ হজ পারমিট ছিল না বলে অভিযোগ। ফলে নির্ধারিত সহযোগিতা বা সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি ছিল।
নাইজিরিয়া থেকে আসা হজযাত্রী আইশা ইদ্রিস জানিয়েছেন, "শুধু আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে গেছি, কারণ সেখানে অত্যধিক গরম ছিল, তারা কাবার সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, আমাদের ছাদ ব্যবহার করতে হয়েছিল, সেখানে প্রচণ্ড তাপে যেন পা জ্বলছিল। কোনওমতে ছাতা ব্যবহার করে এবং ক্রমাগত জমজম পানি (পবিত্র জল) খেয়ে প্রাণে বাঁচি।" হিটস্ট্রোকে মারা যান নাইম নামে এক হজযাত্রী। তাঁর ছেলে জানান, "আমার মায়ের সাথে হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পেরেছি তিনি হজের সময় মারা গেছেন।” মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে মক্কাতেই দাফন করা হয়।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুতে ব্যবহৃত হতো চাকা! নারকীয় যে ইতিহাস অবাক করবে
হজের সময় গরমের কারণে মৃত্যু অবশ্য নতুন কিছু নয়। সেই ১৪০০ সাল থেকেই হজ করতে গিয়ে গরমে মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। প্রতিবছর একটু একটু করে বাড়ছে বিশ্বের তাপমাত্রা। তবু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মাথাব্য়থা নেই তাবড় দেশগুলির। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস বলছে, পৃথিবীর উষ্ণতা ২০৩০ এর দশকের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি বেড়ে যাবে যা ভবিষ্যতে হজযাত্রীদের আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
অনেকেই এই মৃত্যুর জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থার কথাও তুলে ধরেছেন। বহু হজযাত্রীদেরই অভিযোগ, থাকার জায়গা বা সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে ভালো ছিল না, ফলে তাঁবুগুলোতে অতিরিক্ত ভিড় এবং পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত সুবিধার ঘাটতি ছিল। ঘাটতি রয়েছে পর্যাপ্ত পরিবহনেরও। যে কারণে বহু হজযাত্রীকেই দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়েছে ওই ভয়ঙ্কর গরমে। পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থার গাফিলতি নিয়েও সওয়াল করেছেন অনেকে। বহু ক্ষেত্রেই তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স বা প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি। এদিকে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ পাল্টা অভিযোগের আঙুল তুলেছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর দিকে। রবিবার সৌদি প্রশাসনের তরফে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ১৬টি ট্রাভেল এজেন্সি হজযাত্রীদের প্রয়োজনীয় পরিষেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ওই সংস্থাগুলি মক্কা যাওয়ার অনুমতি না থাকলেও সৌদি আরবে ভিসা নিয়ে আসা পর্যটকদের অবৈধভাবে সেখানে হজ করতে নিয়ে গেছিল। তাদের বিরুদ্ধ তদন্ত শুরু করা হয়েছে বলেও খবর।