'মৃণাল সেনের চোখে দেখেছি আমার শহর': কথাবার্তায় অঞ্জন দত্ত
Anjan Dutta Mrinal Sen: মৃণাল সেন মানে তো একা মৃণাল সেন নন, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন যাঁরা, ওঁর বন্ধুবান্ধব, তাঁদের সকলকে নিয়েই ওঁর অস্তিত্ব, একা মৃণাল সেন এক্সিস্ট করেননি কখনও।
'চালচিত্র' থেকে 'অন্তরীণ', 'খারিজ' হোক বা 'মহাপৃথিবী' - মৃণাল সেনের ছবিতে তাঁর অভিনয় ও জড়িয়ে থাকা আমাদের মুগ্ধ করেছে বারবার। শতবর্ষের দোরগোড়ায় মৃণাল সেনকে নিয়ে ইনস্ক্রিপ্ট-এর সঙ্গে খোলামেলা কথায় অঞ্জন দত্ত
ক্যামেরার সামনে আপনার প্রথম অভিনয় মৃণাল সেনের 'চালচিত্র'-তে। ছবিটা রিলিজ করেনি। কিন্তু আপনি বারবার বলেন, আপনার সবচেয়ে নির্লজ্জ অভিনয় এই ছবিতে। কেন আপনার একথা মনে হয়?
অঞ্জন দত্ত: অভিনয়ের দিক থেকে দেখলে ওটা আমার প্রথম কাজ বলে নিজের মনে হয় না কখনওই। অনেক এফর্টলেস লাগে ওই অভিনয়টা। ওই অভিনয়টা দেখতে খুব সহজ লাগে। সেটার জন্য দায়ী হয়তো ওই কাজের পরিবেশটা। পরে আরও অনেক অভিনয় করেছি, সেগুলো খারাপ বলছি না। কিন্তু এতটা সহজে, এতটা ইজিলি আর অন্য কোনও কাজ হয়তো করিনি। অনেক সাবলীল লাগে ওই অভিনয়টা।
আপনি নাটকে অভিনয় করতেন। প্রথম সিনেমা করছেন মৃণাল সেনের পরিচালনায়। আপনাকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীনতা দিয়েছিলেন উনি?
অঞ্জন দত্ত: আমার যেরকম অভিনয় করতে ইচ্ছে করেছে, উনি অ্যালাউ করেছেন, আবার উনি যেরকম বলেছিলেন, সেটাও আমি করেছি। সেই বোঝাপড়াটা ওঁর সঙ্গে ছিল। উনি সকলের সঙ্গেই খুব ফ্রি হয়ে কাজ করতেন। স্ক্রিপ্ট একটা থাকত, তবুও উনি ইমপ্রোভাইজ করতেন। ইমপ্রোভাইজ করাটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা। উনি কী চান, সেটা মাথায় রেখেই সেটাকে ভেঙেচুরে, নতুন করে দেখতে চাইতেন। খুঁজতেন গল্পের ভেতরের সত্যটাকে। তাই নিজের লেখা নিজেই বদলাতেন, অভিনেতাদের সাহায্যে। মৃণাল সেন এতটাই বড় মাপের পরিচালক, যে অভিনেতার নিজস্বতাকে ছাড় দিতে কোনও অসুবিধে হত না তাঁর। বরং ইমপ্রোভাইজ না করতে পারলে রেগে যেতেন। কালেক্টিভ আর্টের মজাটা পেতে চাইতেন। খুবই ইনস্টিংকটিভ ছিলেন পরিচালক হিসেবে, তাই অভিনেতার থেকেও স্বতঃস্ফূর্ততা চাইতেন।
'চালচিত্র'-র ধাঁচ মৃণাল সেনের অন্য অনেক ছবির থেকে আলাদা। এখানে রাজনীতি বা সমাজের ছবিটা তুলনায় অনেক সূক্ষ্ম, অনেক সাটল। এই ছবির যে গল্প, এক যুবক জীবনের নানা দিক থেকে একটা গল্প, একটা প্রতিবেদন খুঁজে বেড়াচ্ছে, আপনার কাছে তা কতটা রক্তমাংসের মনে হয়েছিল?
অঞ্জন দত্ত: আমার আলাদা করে তা মনে হয় না। ছবিটা খুবই ভালো লাগে। মনে হয়, অসম্ভব ম্যাচিওর ছবি। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা ছবি। ছবিটা যা বলতে চাইছে... এই যুবকটি গল্পটা যখন খুঁজে পায়, তখন আপস করে ফেলে। গল্প যতক্ষণ খুঁজে বেড়াচ্ছে, ততক্ষণ সে জীবনের সঙ্গে আপস করছে না। যখনই সমাধান পাচ্ছে, তখনই কমপ্রোমাইজ করে ফেলছে। এই যে সমাধান খুঁজে যাওয়াটা, এটাই আসল। পেয়ে গেলে ইউ আর ওভার। এই দর্শনটা উপলব্ধি করা, এটাকে এক্সপ্রেস করা... এগিয়ে থাকা মানসিকতা না থাকলে সেটা সম্ভব নয়।
এই ছবির মধ্যে কলকাতার একটা আন্তর্জাতিকতা রয়েছে। হিপিদের দেখা যাচ্ছে, আবার কলকাতার বস্তিও। মৃণাল সেনের মধ্যেও কি সেই বিষয়টা ছিল?
অঞ্জন দত্ত: আসলে এটা একটা অ্যাটিটিউডের ব্যাপার! মৃণালদা বা মৃণালদার মতো আরও অনেকে সারা পৃথিবীর ব্যাপারে অ্যাওয়ার ছিলেন। তাই বলে তাঁদের হালচাল যে খুব সাহেবি ছিল, তা নয়। পৃথিবীর ইতিহাস, পৃথিবীর কোন দেশে কী ঘটছে, রাজনীতি থেকে আর্ট- সবটাই জানতেন। তাঁদের কাজে সেটা রিফ্লেক্টেড হত, থিয়েটার থেকে সিনেমা- সবেতেই। সকলে একরকম কাজ করেছেন তাও নয়, কেউ রাস্তায় নেমে থিয়েটার করেছে। কেউ গান করেছে, কেউ সিনেমা করেছে। সবাই না হলেও কিছু মানুষ তো এমন ছিলেন, যাঁরা বাদবাকি পৃথিবীর সঙ্গে এক ভাবনা ভাবতেন। দে ইউজড টু থিংক উইথ দ্য রেস্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। মৃণালদাও তেমন মানুষ ছিলেন। একটা ব্যতিক্রমী কালচারের অস্তিত্ব ছিল মৃণাল সেনের কলকাতায়, অলটারনেটিভ সিনেমাও ছিল সেজন্যই।
'খারিজ'-এ মধ্যবিত্তের প্রতি যে ক্রিটিক রয়েছে, সেখানে অভিনয়েও কি চরিত্রের প্রতি ক্রিটিকাল থাকতে হয়েছিল? চরিত্রের যে ভয়, যে গিল্ট, সেটা নিয়ে আসতে হয়েছিল?
অঞ্জন দত্ত: অভিনয়ের ক্ষেত্রে চরিত্রটা জরুরি, তাকে বিশ্লেষণ করাটা, তার ব্যাপারে জাজমেন্টাল হওয়াটা ইজ নট গুড অ্যাকটিং। 'খারিজ'-এ আমি অঞ্জন সেন, কিন্তু তার ওপর আমি কোনও ধ্যানধারণা চাপিয়ে দিতে চাইনি। মৃণালদাও চাননি। চরিত্রকে ভালবেসে, বিশ্বাস করে কাজ করতে দিতেন তিনি। সমাজের প্রতি, মধ্যবিত্তর প্রতি যে ক্রিটিক 'খারিজ'-এ রয়েছে, তা তো ছবিটার ভেতর থেকেই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু আলাদা করে সেটা বোঝানো, আলাদা করে শুটিং চলাকালীন সেটা ধরিয়ে দেওয়া, এটা কখনওই মৃণালদা করেননি। আমি অন্তত করতে দেখিনি। হি ওয়াজ নন জাজমেন্টাল অ্যাবাউট দ্য ক্যারেকটার। ফিল্মটা কী বলতে চাইছে, সেটা আলাদা।
'চালচিত্র' আর 'খারিজ'-এর মধ্যে অভিনেতা হিসেবে কোন চরিত্রকে বেশি মনে রাখতে চান? কোন ছবিতে মৃণাল সেনকে বেশি স্পষ্ট লাগে?
অঞ্জন দত্ত: ওরমভাবে আমি দেখি না, আমি আবারও এটা বলতে পারি, প্রথম কাজ হিসেবে 'চালচিত্র' অনেক বেশি এফর্টলেস। আমি কোনটা ভালো পারিনি, সেটা পুরনো ছবি দেখলে বলতে পারি। এই দুটো ছবি তার মধ্যে পড়ে না। যা এক্সপেক্ট করেছিলেন মৃণালদা, সেটা ডেলিভার করেছি। আর মৃণালদা বিভিন্ন চরিত্র বিভিন্নভাবে তৈরি করতেন, স্পষ্টতা সেই সব চরিত্রের মধ্যেই ছিল, চরিত্রদের তিনি স্বাভাবিক থাকতে দিয়েছেন। কাজেই এই দুটো চরিত্রের ক্ষেত্রে একটা বেছে নেওয়া যায় না।
'মহাপৃথিবী' আপনার নিজের গল্প। সোভিয়েত ভেঙেছে, নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার তৈরি হচ্ছে। সেই অবস্থায় 'মহাপৃথিবী'-তে একটা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলা হচ্ছে, যারা বার্লিন দেওয়াল ভাঙার অভিঘাতে নড়বড়ে হয়ে গেছে। এই গল্পের ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া ছিল মৃণাল সেনের? মৃণাল সেন আদ্যন্ত বামপন্থী। আপনি তা নন। 'মহাপৃথিবী'-র ভাবনায় দু'জনের সিন্থেসিসের জায়গাটা কী ছিল?
অঞ্জন দত্ত: আমি একটা নাটক লিখেছিলাম 'দেওয়াল' বলে। তার গল্পটা ওঁর খুব পছন্দ হয়েছিল, উনি নিয়েছিলেন। যেহেতু উনি চিত্রনাট্যকার, ডিরেক্টর, সেজন্য নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন গল্পটা। অনেকটা বদল এনেছিলেন। আমি যে জায়গা থেকে লিখেছিলাম, তার থেকে অন্যরকম অবস্থান নিয়েছিলেন। ওই ছবিটায় তো আমি শুধু অভিনয় করিনি, কোলাবরেটও করেছিলাম মৃণালদার সঙ্গে। গল্পটা আমার, কিন্তু ওঁর দেখাটা, দর্শনটা আলাদা। ওঁর কাছে একটা সার্টেন সেন্স অফ লস '৮৯-এর দেওয়াল ভাঙাটা, ওঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে। উনি একেবারেই উৎফুল্ল, উত্তেজিত হতে পারেননি, স্বাভাবিকভাবেই। আমি কিন্তু আমার নাটকে এই দেওয়াল ভাঙাটা সেলিব্রেট করেছিলাম। উনি উল্টোটা করেছিলেন ওঁর বিশ্বাস থেকে। তবে উনি ওঁর অতীতকে, রাজনীতিকে, আন্দোলনকে প্রশ্ন করেছিলেন এই ছবিটায়। সেটা 'পদাতিক'-এও করেছিলেন একভাবে, এই ছবিতে আরেকরকমভাবে করলেন।
'মহাপৃথিবী' বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছিল। আপনি সেখানে গিয়েছিলেন। কী ধরনের প্রশ্ন উঠে এসেছিল এই ছবি নিয়ে?
অঞ্জন দত্ত: বার্লিনে ছবিটা দেখানো হয়, সেখানে মৃণালদা যেতে পারেননি, শরীর ভালো ছিল না ওঁর। ফলত, আমি ছবিটা রিপ্রেজেন্ট করি, আমার লেখা ও অভিনয় বলে। বার্লিন শহরের ইস্টার্ন সাইডে দেখানো হয়েছিল। সেখানে সিভিয়ার ক্রিটিসিজম ফেস করি ছবিটা নিয়ে। মারাত্মক সমালোচনা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, এটা আমার গল্প, কিন্তু ছবিটা আমার কথা বলছে না, আমার ডিরেক্টর কী বলতে চাইছেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি জানি, ইভেন অ্যাজ এ হিউম্যান বিইং, অলসো অ্যাজ অ্যান অ্যাক্টর, অ্যাজ এ রাইটার-ডিরেক্টর আমি আপনাদের বক্তব্য বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার ডিরেক্টরের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে এভাবে দেখার অধিকার আছে। হতাশ হওয়ার, দুঃখ পাওয়ার অধিকার আছে। সেই অধিকারটা তাঁকে দেওয়া উচিত। খুব ইন্টারেস্টিং ডিবেট ছিল সেটা।
'অন্তরীণ' আরও একটু পরের দিকের ছবি। একদম অন্য ধরনের। একাকীত্ব, অব্যক্ত প্রেমের ছবি। হিউম্যান কনট্যাক্ট এই ছবির চরিত্রের কম। এই অভিনয়টা কি মৃণালের অন্য ছবিতে আপনার অভিনয়ের চেয়ে আলাদা?
অঞ্জন দত্ত: আলাদা বলব না। উনি সবসময়ই বিভিন্ন ধরনের গল্প বলেছেন, ওঁর দর্শনটা এক থেকে গেছে। দর্শনের ওজনটা হয়তো পালটে গেছে সময়ে সময়ে। কিন্তু নানা ধরনের গল্প, নানা ধরনের এক্সপ্রেশন, নানা ধরনের খাঁচা উনি তৈরি করেছেন। সেগুলো প্রত্যেকটাই স্বতন্ত্র। আমার মনে হয় না, 'অন্তরীণ' আলাদা করে প্রেমের ছবি। সেদিক দিয়ে দেখলে 'আকাশকুসুম'-ও একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প। কিন্তু তার ধাঁচটা আলাদা ছিল। 'অন্তরীণ' হয়তো দর্শনের নিরিখে আরেকটু ভারী, এখানে জঁরটা জরুরি নয় আসলে, দর্শনটা জরুরি। সেখানেই 'অন্তরীণ' আলাদা, 'মহাপৃথিবী' আলাদা, 'একদিন প্রতিদিন' বা 'পদাতিক' আলাদা।
চলচ্চিত্রের বাইরে মৃণাল সেনের সঙ্গে আপনার রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে অবশ্যই কথা হয়েছে। কখনও ওঁর ভাবনাচিন্তার গতিবিধিতে কোনও বদল লক্ষ করেছেন কখনও?
অঞ্জন দত্ত: আমি প্রথম যখন ওঁর ছবিতে কাজ করতে যাই, তখন আমার বয়স ২৪ বা ২৫। ওঁর তখন ৫৭-৫৮ বছর বয়স। কিন্তু বয়সের তফাৎটা কোনওদিন ফিল করতে দেননি উনি। ইনফ্যাক্ট, আমি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছিলাম, মানসিকভাবে, মানুষ হিসেবে। কাজেই, আমি কিছুটা পরিণত অবস্থাতেই কাজ করতে গিয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে। আমি তো থিয়েটারে অভিনয় করতাম না, লিখতাম, ডিরেকশন দিতাম। আমি প্রথম যেটায় অভিনয় করি, সেটা উনি পরবর্তীকালে দেখেন। ওঁর থেকে এক্সপেক্ট করতাম, উনি অন্যরকম কিছু করবেন। বেসিক চিন্তা থেকে উনি কখনও সরে যাননি। কিন্তু বারবার বদলেছেন নিজের কাজের খাঁচাকে। বামপন্থী হয়েও তো কখনও তিনি পার্টির মেম্বার হননি। নানা বামপন্থী ঘরানার দলকে, মানুষকে সাহায্য করেছেন। বিশ্বাস করেছেন বামপন্থায়। ওঁর যাপনটাও সেরকম ছিল।
নন্দীগ্রামের সময় আপনি ওঁকে মিছিলে নিয়ে এসেছিলেন। ওঁর পলিটিকাল ইনক্লিনেশন স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সেই মিছিলে উনি এসেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রে ওঁর সঙ্গে কোনও সংঘাত হয়েছে কখনও?
অঞ্জন দত্ত: উনি সোশ্যালিজমে বিশ্বাস করতেন। আমি এক্সিস্টেনশিয়ালিজমে। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে অজস্র কথা হয়েছে। কিন্তু কোনওদিন সেটা আমাদের বন্ধুত্বকে এফেক্ট করেনি। সংঘাত হয়েছে। সেটা চিন্তার, বিশ্বাসের। এবং উনি সেটা এনকারেজ করতেন। ওঁর কাছ থেকে যেটা পেয়েছি, সেটা ক্রমাগত প্রশ্ন করার ইচ্ছে। প্রশ্নকে ভালবাসা। নিজেকে কন্ট্রাডিক্ট করতে পারার সাহস। আটকে থাকা নয়। আর দিনের শেষে আমিও মানুষে বিশ্বাস করেছি, উনিও।
পরিচালক হিসেবে আপনি মৃণাল সেনের দ্বারা প্রভাবিত? কোথাও?
অঞ্জন দত্ত: ওঁর কম টাকায় স্টাইলিস্টিকালি ছবি করার যে ধরন, এক্সপেরিমেন্টের যে ধরন, তা আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ওঁর শুরুর দিকের স্টাইলটা আমি কিছুটা ধারণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার বিষয়ভাবনা, শিল্পভাবনা পপুলিস্ট। অনেক বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু মেকিংয়ের ধাঁচের দিক থেকে ওঁর প্রথমদিকের ছবি আমাকে উত্তেজিত করে বেশি। উনিও আমাকে বলেছেন, আমি যে অ্যান্টিসেপটিক ছবি বানাচ্ছি না, সেটা ওঁর ভালো লেগেছিল। পরিপাটি, গুছিয়ে গল্প বলাটা আমি ওঁর থেকে নিইনি, অগোছালো বলার ধরনটা নিয়েছি, তার মধ্যেও একটা সৌন্দর্য রয়েছে। হ্যান্ডহেল্ড হোক, বা জাম্পকাট হোক, এসবকিছুই আমি ওঁর থেকে নিয়েছি, ব্যবহার করেছি অতিরিক্ত। এর নেপথ্যে একটা দর্শনও রয়েছে, মানুষ যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত, তাকে অ্যাটাক করা। পরবর্তীতে সেটা আমি ওঁর কাজে পাইনি, তাই নিয়ে আমাদের বিতর্কও হয়েছে। আমি ওঁর প্রথমদিকের ধরনটাই চেষ্টা করেছি নিজের কাজে ধরতে। ন্যুভেলভাগের ইনফ্লুয়েন্স ওঁর সেই কাজের মধ্যে ছিল।
কলকাতা শহরটা ওঁর চোখের সামনে বদলে যাচ্ছিল। পৃথিবীটাও। ওঁর কাছে সেটা কেমনভাবে পৌঁছেছিল?
অঞ্জন দত্ত: বদল তো ইনএভিটেবল। কিন্তু মৃণাল সেনকে আমার কোনওদিন সিনাইল মনে হয়নি। কমপ্লেনিং মনে হয়নি। প্রথমদিনও আমাকে বলেছিলেন, কলকাতা ওঁর ভালো লাগে। যতদিন কথা বলতে পেরেছেন, ততদিন অবধি বলেছেন, কলকাতা ওঁর ভালো লাগে। রাজনীতিতে কোরাপশন থাকবে, বদল থাকবে, এগুলো তো উনি জানতেন, কিন্তু তাই নিয়ে কোনও খেদ ছিল না ওঁর। সবকিছুর পরে এটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগত। হ্যাঁ, আমাদের প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক হত। সেই পরিসরটা উনিই দিতেন। তবে আমি বলব, যদি আমি ওঁর থেকে কিছু পেয়ে থাকি, সেটা হল সিনাইল না হওয়াটা। সবকিছুর মধ্যে থেকেও ল্যামেন্ট না করা, বিলাপ না করা- এটা ওঁর ছিল। আগের সময়টা বেটার ছিল, এখন সময়টা খারাপ- এভাবে কোনওদিন ভাবতে শেখাননি। এই ক্ষমতাটা দিয়েছেন, টু অ্যাকসেপ্ট অ্যান্ড টু কোয়েশ্চেন। কিন্তু হতাশ হওয়ার শিক্ষা দেননি। বিজ্ঞানে বিশ্বাস করলে বদলটা মেনে নিতেই হয়। কিন্তু প্রশ্নটাও করে যেতে হবে। মৃণালদার এই জায়গাটা আমার কাছে গ্রেট। কিন্তু নিজের মতাদর্শ বজায় রেখে, নিজের বামপন্থী চিন্তা নিয়ে তিনি থেকেছেন, এই শহরেই থেকেছেন। শহরকে ভালবেসেছেন। যতদিন হাঁটতে পেরেছেন, শহরে হেঁটেছেন। নানা শহরে গেছেন, অন্য শহরকে ছোট করেননি। পৃথিবীর ব্যাপারে চোখ খুলে রেখেই কলকাতাকে ভালবেসেছেন তিনি।
আমি বরং ২৪ বছর বয়সে অনেক বেশি ডিপ্রেসড ছিলাম এই শহরটা নিয়ে, অনেককিছু দেখে, অনেককিছু পড়ে। আমার সেই ডিপ্রেশনটা পঞ্চাশোর্ধ্ব মৃণাল সেনই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পড়ো, জানো, কিন্তু তার মধ্যে আটকে যেও না। আমি সেসময় নিহিলিজম, অ্যানার্কিজমের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত, যা হয়, একটা চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলের। আমি আমার বিশ্বাস, ব্যক্তিস্বাধীনতার চিন্তা থেকে সরিনি, কিন্তু ওঁর প্রভাবেই আমি কাটিয়ে উঠেছিলাম হতাশা। কিন্তু আমার নিজস্ব বিশ্বাস আঁকড়ে থাকাটাও উনি পছন্দ করতেন।
আমার মনে হয়, ওরকম মানুষ আরও থাকলে ভালো হয়। মৃণাল সেন মানে তো একা মৃণাল সেন নন, তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন যাঁরা, ওঁর বন্ধুবান্ধব, তাঁদের সকলকে নিয়েই ওঁর অস্তিত্ব, একা মৃণাল সেন এক্সিস্ট করেননি কখনও। আমার সঙ্গে ওঁর সিনেম্যাটোগ্রাফার কে. কে মহাজনের আলাপ যখন হচ্ছে, তখন ওঁরও বয়স কম, চল্লিশের কাছাকাছি। সকলেরই নিজস্ব বিশ্বাস ছিল, অবস্থান ছিল, যেটা উনি অ্যালাউ করেছেন ওঁর পরিসরে। আর শহরটাও ওঁকে অ্যালাউ করেছে, শহরটাও ওয়ান ডাইমেনশনাল ছিল না কখনও। বারবারই বলেছেন, শেষাবধি, কলকাতা ওঁকে ফ্যাসিনেট করে। উনিই আমাকে প্রথম কলকাতাকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। আমি কলকাতাকে ভালবাসতাম না। ওঁর কাছে এসে আমার শহর আমি খুঁজে পাই।
আমার কাজে কখনও মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা আসেনি। যেভাবে এসেছে দার্জিলিং, মিশ্র কলকাতা, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জীবন। আমি ডিটেকটিভ গল্প ভালবাসি। তা নিয়ে ছবি করেছি, বই লিখেছি। কিন্তু ওঁর সঙ্গে আমার জায়গাটা ব্যক্তিগত, সেটা কখনও প্রকাশ্যে আনিনি, ভাগ করে নিইনি। এখন, এই বয়সে মনে হয়, করাই যায়। হয়তো ভবিষ্যতে করব কখনও।