বাংলার বুকে এক টুকরো ইউরোপ, পর্যটকদের চোখ ধাঁধাবে 'হেরিটেজ' ধান্যকুড়িয়া!

Dhanyakuria, West Bengal Tourism: ১৯ শতকের দিকে গড়ে ওঠা ধান্যকুড়িয়ার একাধিক প্রাসাদ, দুর্গের আকৃতির অট্টালিকাগুলি তৈরি হয়েছিল ইউরোপীয় শৈলির অনুকরণে।

পর্যটন লক্ষ্মী। আর কোনও মতেই সেই লক্ষ্মীকে ছাড়তে নারাজ রাজ্য সরকার। একদিকে শ্রীক্ষেত্র পুরীর ধাঁচে দিঘায় গড়ে তোলা হচ্ছে জগন্নাথ মন্দির। অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের ধান্যকুড়িয়াকে পর্যটকবান্ধব করে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না সরকার। ইউরোপীয় শৈলির দুর্গগ্রাম হিসেবেই পরিচিত উত্তর ২৪ পরগনার এই গ্রামটি। বছর খানেক আগেই হেরিটেজ তকমা পেয়েছে ধান্যকুড়িয়া। তবে তার পরেও তেমন ভাবে শ্রী ফেরেনি ধান্যকুড়িয়ার। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দৈন্যদশা সেখানকার দুর্দান্ত সব প্রাসাদ ও দুর্গের। তবে আর নয়। নতুন বছর পড়তে না পড়তে ধান্যকুড়িয়াকে নতুন রূপে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে কোমর বাঁধছে  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। ইতিমধ্যেই গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের একটি দল। যার নেতৃত্বে ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন আমলা ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।

ধান্যকুড়িয়ার আনাচে কানাচে আজও ইতিহাসের ছোঁয়া। গ্রামের প্রতিটা দুর্গ ও প্রাসাদে আজও রয়ে গিয়েছে ইউরোপীয় স্থাপত্যের স্বাদ। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ধান্যকুড়িয়া ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। শোনা যায় একসময়ে সুন্দরবনের অংশ ছিল এই ধান্যকুড়িয়া। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে জগন্নাথ দাস নামে এক ব্যক্তি ধান্যকুড়িয়ায় আসেন এবং সেখানেই তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। ধান্যকুড়িয়াকে বসবাসের যোগ্য করার নেপথ্যে ছিলেন এই জগন্নাথ দাসই। ক্রমে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় আঁখ, পাট ও ধান ব্যবসায়ী গাইন, সাউ, বল্লভ এবং মণ্ডল পরিবারের। বলাই বাহুল্য তাঁদের সঙ্গে বাণিজ্য়িক সম্পর্কও তৈরি হয় তাঁর। ক্রমে দাসেদের সঙ্গে সখ্যতার সূত্রেই ধান্যকুড়িয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন তাঁরাও। গড়ে তোলেন নিজেদের প্রাসাদোপম অট্টালিকা। এককালের পরিত্যক্ত ভূমি ধান্যকুড়িয়া ক্রমশ হয়ে ওঠে জনবহুল। আদতে এই ব্যবসায়ী পরিবারগুলির দৌলতেই ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৮৮৫ সালে ধান্যকুড়িয়ায় প্রথম ইংরেজি মাধ্যম স্কুল তৈরি হয় মহেন্দ্রনাথ গাইন ও উপেন্দ্রনাথ সাউয়ের যৌথ উদ্যোগে। ১৮৮৮ সালে ধান্যকুড়িয়ায় একটি দাতব্য হাসপাতাল তৈরি করেন ১৮৮৮ সালে। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় মেয়েদের স্কুল। দুর্ভিক্ষের সময় বিনামূল্যে আহার থেকে শুরু করে বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় ত্রাণ , সবই জুগিয়েছিল এই সমস্ত ব্যবসায়ী পরিবারগুলি।

আরও পড়ুন: কলকাতার হাতের কাছেই ইতিহাসের শহর, একদিনেই দেখে আসুন পোর্তুগিজদের ঘরবাড়ি

গাইন, সাউ, বল্লভ ও মণ্ডল পরিবারের তৈরি করা দুর্গ ও প্রাসাদগুলি আজও ধান্যকুড়িয়ার সম্পদ। গাইন ক্যাসেল, গাইন ম্যানশন, সাউ ম্যানশন, সাউ বাগানবাড়ি, বল্লভ ম্যানশন, নয়-চূড়া রাসমঞ্চ, গাইন প্রাসাদের ঠাকুরদালান- এই সমস্ত দেখতে আজও ভিড় জমান মানুষ। তবে মূল ধারা পর্যটনের আলো থেকে কীভাবে যেন আজও অনালোকিতই রয়ে গিয়েছে বসিরহাটের ধান্যকুড়িয়া। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ধান্যকুড়িয়ার প্রতিটি স্থাপত্যের আদলে ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া। সারা ভারতের আর কোথাও এই ধরনের স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায় না। সেই সব দিকগুলো খতিয়ে দেখেই গত বছর ধান্যকুড়িয়াকে হেরিটেজ আখ্যা দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

West Bengal government exploring scope of tourism in Dhanyakuria, the village of European-style castles

তবে হেরিটেজ আখ্যা পেলেও তেমন শ্রী ফেরেনি ধান্যকুড়িয়ার প্রাসাদ-দুর্গগুলির। রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে প্রায় ভগ্নদশা সেগুলির। ধান্যকুড়িয়া গাইন-গার্ডেনের অবস্থাও তথৈবচ। অভিযোগ উঠেছিল, ঘাস ও আগাছায় ভরে ছিল চৌহদ্দি। সীমানা পাঁচিল ভেঙে সেখানে অবাধ অনুপ্রবেশ করথে দুষ্কৃতি। এই ধরনের প্রাচীন ঐতিহাসিক জায়গা রক্ষণাবেক্ষণের দাবি এসেছিল স্থানীয়দের পক্ষ থেকেই। বসিরহাট-বেড়াচাঁপার টাকি রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছে ধান্যকুড়িয়ার গাইন গার্ডেন। প্রায় দেড়শো বছর আগে ধান্যকুড়িয়ার পাট ব্যবসায়ী মহেন্দ্রনাথ গাইন দুর্গের আদলে ৩৩ বিঘা জমি জুড়ে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। ইন্দো-ইউরোপীয় মিশ্র আঙ্গিকের সুদৃশ্য অট্টালিকাটি এখনও মানুষকে অবাক করে। ওই বাগান বাড়িতে জমিদার ও তাঁদের ব্যবসায়িক সহযোগী ইংরেজদের বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। সে সময়ে টাকি রোড বরাবর মার্টিন রেল চলত। ধান্যকুড়িয়ায় তার স্টেশন ছিল। ওই রেলে করে ইংরেজরা আসতেন গাইন গার্ডেনে। ক্রমে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে এর জৌলুস কমতে শুরু করে। আগে অট্টালিকার পুকুর ঘাটে দু’টি বড় মার্বেলের সিংহ ছিল। নব্বইয়ের দশকে গাইন পরিবারের কয়েক জন সেই সিংহ দু’টি বিক্রি করে দেন। তবে বাগান বাড়ির গেটে দু’জন ইংরেজ একটি সিংহকে বধ করছে— এ রকম একটি ভাস্কর্য নাকি এখনও রয়েছে। শোনা যায়, তিরিশের দশকে এখানে ‘কপালকুণ্ডলা’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল।

West Bengal government exploring scope of tourism in Dhanyakuria, the village of European-style castles

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমাজকল্যাণ দফতরের পরিচালনায় এখানে দীর্ঘ দিন পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একটি সরকারি বালিকা হোম-সহ মেয়েদের স্কুল চলত। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে ২০০৮ সালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ গাইন পরিবারের কাছ থেকে এই সম্পত্তিটি কিনে নেয়। ২০১৯ সালে সংস্কারের কথা বলে মেয়েদের হোম ও স্কুল তুলে দেওয়া হয়। সেই থেকে এই ভবনটি অনাদরেই পড়ে রয়েছে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশনের সদস্যেরা গাইন গার্ডেন পরিদর্শন করেন। ২০২২ সালে হেরিটেজ হিসাবে স্বীকৃতিও মেলে। ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল বিশ্ব ঐতিহ্য দিবসে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের ব্রশিওরে ধান্যকুড়িয়া গাইন গার্ডেনের ছবি দিয়ে এই স্থাপত্যকে সম্মান জানানো হয়। তবে নতুন বছর আসতে না আসতেই সেই ধান্যকুড়িয়ার শ্রী ফেরাতে উঠেপড়ে লাগল রাজ্য সরকার।

রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই একটি দল ধান্যকুড়িয়া পরিদর্শন করেছেন। বিশেষ করে গাইন ক্যাসেল গোটাটাই ঘুরে দেখেন পর্যবেক্ষক দল। রাজ্য সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে চলেছে ধান্যকুড়িয়া নিয়ে, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি।

West Bengal government exploring scope of tourism in Dhanyakuria, the village of European-style castles

১৯ শতকের দিকে গড়ে ওঠা ধান্যকুড়িয়ার একাধিক প্রাসাদ, দুর্গের আকৃতির অট্টালিকাগুলি তৈরি হয়েছিল ইউরোপীয় শৈলীর অনুকরণে। শুধু যে তাঁদের প্রাসাদগুলোই ওই আঙ্গিকে সেজে ওঠে তাই নয়, স্থানীয় স্কুল, স্থাস্থ্য ক্লিনিক এবং লাইব্রেরিতেও ছিল ওই স্থাপত্য শৈলির ছোঁয়া। রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ইতিমধ্যেই তিনটি স্থানকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। তার মধ্যে রয়েছে গাইন ক্যাসেল, ধান্যকুড়িয়া হাইস্কুল ও ধান্যকুড়িয়া হাসপাতাল। দীর্ঘদিন ধরেই বহু চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সিরিয়ালের শুটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয় ধান্যকুড়িয়ায় একাধিক প্রাসাদ, দুর্গ। ১৯ শতকের জমিদার গোবিন্দ চন্দ্র গাইন ও তাঁর পুত্র মহেন্দ্রনাথ নির্মিত এই গাইন দুর্গ কিন্তু হয়ে উঠতেই পারে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।

আরও পড়ুন: সবুজ স্বচ্ছ জল, রোমাঞ্চকর গুহা! ভারতের সদ্য আবিষ্কৃত এই পর্যটনকেন্দ্রে যাবেন কীভাবে?

আর পর্যটনের সেই শ্রী ফেরাতেই এবার নতুন করে কোমর বেঁধেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক পরিকল্পনা নিয়েছেন রাজ্যের পর্যটন বাড়াতে। ধান্যকুড়িয়া পরিদর্শনের পরে বিস্তারিত একটি রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়ার কথা রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তার পরেই ধান্যকুড়িয়ার শ্রীবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীল নকশা তৈরি করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

More Articles