শরীরের সবচেয়ে উপেক্ষিত অংশ! গোপনে আপনার মৃত্যুর কারণ হতে পারে এটিই

The Most Neglected Part Of Body : ফ্যাসিয়াতে, বিশেষত পৃষ্ঠের কাছাকাছি স্তরগুলিতে, ত্বকের পরেই দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ সংখ্যক স্নায়ু রয়েছে।

দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না বোঝার নানা উদাহরণ সারা জীবনে টের পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ অংশকে অবহেলা করতে করতে একসময় সেই অংশও যে পাল্টা বদলা নেয় তা তো জানা কথাই। কিন্তু দাঁতের কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে আমাদের শরীরের সবচেয়ে উপেক্ষিত একটি অংশের কথা যা অকালে ভয়াবহ বিপাকে ফেলতে পারে আপনাকে, যত্ন না নিলে। ব্যায়াম আমাদের হাড় ও পেশির স্বাস্থ্যের উপকার করে বা চর্বি কমায় সে সম্পর্কে সকলেই প্রায় 'বিশেষজ্ঞ' এখন। তবে আমাদের উপেক্ষিত অংশ, আমাদের ফ্যাসিয়া নিয়ে তেমন হেলদোল নেই কারও।

ফ্যাসিয়া হচ্ছে সংযোজক টিস্যুর একটি পাতলা আবরণ, প্রধানত কোলাজেন দিয়ে তৈরি। ফ্যাসিয়া হচ্ছে খানিক দড়ির মতো একটা গঠন যা শরীরের অনেক অংশে শক্তি জোগায় এবং সুরক্ষিত রাখে। এটি প্রতিটি অঙ্গ, রক্তনালী, হাড়, নার্ভ ফাইবার এবং পেশিকে ঘিরে রাখে। পেশি এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব ব্যাপক। শরীরের মধ্যে ফ্যাসিয়াকে দেখা কঠিন, তবে জিনিসটা আসলে কী তা বুঝতে মাংসের দিকে তাকাতে পারেন। মাংসের স্টেকের দিকে তাকালে ফ্যাসিয়া দেখতে কেমন তা খানিক আন্দাজ করা যায়। মাংসের স্তরগুলির মধ্যে পাতলা সাদা যে রেখা দেখতে পান, তাই হচ্ছে ফ্যাসিয়া।

মাংসের পৃষ্ঠের সবচেয়ে কাছেরটি হচ্ছে সুপারফিশিয়াল ফ্যাসিয়া, চর্বির স্তরগুলির মধ্যে ত্বকের নীচে থাকে এটি। তারপরে থাকে গভীর ফ্যাসিয়া রয়েছে যা পেশি, হাড় এবং রক্তনালীগুলিকে আবৃত করে। ফ্যাসিয়া, পেশি এবং হাড়ের স্বাস্থ্য ও কার্যকারিতার জন্য চরম গুরুত্বপূর্ণ। পেশির কাজ করতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ফ্যাসিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শক্তি তৈরি করতে এবং পেশির দৃঢ়তাকে প্রভাবিত করতে, পেশির কোশগুলির সংকোচনে সহায়তা করে ফ্যাসিয়া।

আরও পড়ুন- আক্কেল দাঁত ভুগিয়েছে আপনাকেও? অবাক করবে এই দাঁতের লক্ষ বছরের ইতিহাস

আমাদের প্রতিটি পেশিই ফ্যাসিয়ায় আবৃত। এই স্তরগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এরা একে অপরের পাশে বা উপরে বসে থাকা পেশিগুলিকে একে অপরের কাজকে প্রভাবিত না করেই অবাধে চলাফেরা করতে সাহায্য করে।

ফ্যাসিয়া সঠিকভাবে কাজ না করলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিন্তু চরম বিপদ। আমাদের দেহের পেশিতে কোনও আঘাতের পরে এই স্তরগুলি একে অপরের উপর সহজে চলাচল করতে পারে না, শক্তি স্থানান্তর হতে পারে না। ফ্যাসিয়ার আঘাত সারতে অনেক সময় লাগে কারণ এটিতে টেন্ডনের (ফাইব্রোব্লাস্ট) মতো কোশ রয়েছে এবং এখানে রক্ত সরবরাহও সীমিত।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ফ্যাসিয়াতে, বিশেষত পৃষ্ঠের কাছাকাছি স্তরগুলিতে, ত্বকের পরেই দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ সংখ্যক স্নায়ু রয়েছে। খেলাধুলো বা ব্যায়ামের ফলে চোট লাগলে এবং বার্ধক্যজনিত পেশির আঘাতের সঙ্গেও ফ্যাসিয়ার যোগ বেশি। পেশির ব্যথায় আক্রান্ত ৩০% মানুষের মূল সমস্যা কিন্তু ফ্যাসিয়াতেই।

১৯৮০-র দশকে ইতালির ফিজিওথেরাপিস্ট লুইগি স্টেকোর তৈরি ফ্যাসিয়াল ম্যানিপুলেশন নামে এক ধরনের ম্যাসেজ, প্যাটেলার টেন্ডিনোপ্যাথি (হাঁটুর নীচের টেন্ডনে ব্যথা), স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি দুই ক্ষেত্রেই পেশির ব্যথার উপশম করেছে। দীর্ঘস্থায়ী কাঁধের ব্যথার চিকিৎসাতেও ফ্যাসিয়াল ম্যানিপুলেশন কাজে এসেছে। ফ্যাসিয়ার আঘাত থেকে বাঁচতে এখন কিনেসিও টেপ ব্যবহার করেন অনেকেই, বিশেষত খেলোয়াড়রা।

আরও পড়ুন- রাতদিন সমানে জিম করেন, হার্ট সুস্থ আছে তো? নিজের অজান্তেই যে বিপদ ডেকে আনছেন

ফ্যাসিয়া নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, তার পাশাপাশিই ফ্যাসিয়া পেশির সংক্রমণের কারণও হতে পারে। ফ্যাসিয়াল স্তরগুলির মধ্যবর্তী স্থানগুলিতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে, মৃত টিস্যু অপসারণ এবং সুস্থ অবশিষ্ট টিস্যু সংরক্ষণ করার জন্য প্রায়ই অস্ত্রোপচারও করতে হয়। পায়ের গোড়ালি কাছে ফ্যাসিয়ার ক্ষতি হওয়া খুব সাধারণ এক ঘটনা। খেলোয়াড়দের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সমস্যা দেখা দেয়।

নেক্রোটাইজিং ফ্যাসাইটিসের মতো গুরুতর ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত্যুও ঘটাতে পারে। স্ট্রেপ্টোকক্কাস বা স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস ব্যাকটেরিয়া প্রাথমিক সংক্রমণ ঘটায় একটি সাধারণ কাটা বা ক্ষত থেকে। তারপর ব্যাকটেরিয়াগুলি ফ্যাসিয়ার মধ্যে সংখ্যাবৃদ্ধি করে।

ফ্যাসিয়া এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও উপেক্ষিত ছিল তার একটি কারণ হচ্ছে, আধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তি ছিল না। ফলে পেশির এত গভীরে দেখা কঠিন ছিল। অতি সম্প্রতি এমআরআই এবং আল্ট্রাসাউন্ড ইমেজিংয়ের সাহায্যে ফ্যাসিয়া, বিশেষ করে প্ল্যান্টার ফ্যাসাইটিস এবং কাঁধ ও ঘাড়ের ফ্যাসিয়াতে প্যাথলজিকাল পরিবর্তনগুলি সহজেই দেখা যাচ্ছে। ফলে চিকিৎসাও সহজ হচ্ছে।

More Articles