গণেশের কাটা মাথা লুকিয়ে রয়েছে এখানেই! চমক আর রহস্যে মোড়া পাতাল ভুবনেশ্বর গুহা
Patal Bhuvaneshwar: গুহার ভেতরে ঢুকতে গেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। যদিও নামেই সিঁড়ি আসলে তা ভয়ঙ্কর এবড়ো খেবড়ো কিছু পাথরখণ্ড। দুই দিকে শক্ত করে চেন ধরে বসে বসে এক এক করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়।
মানুষের কৌতূহলী মন বারবারে জানতে চায় মাটির নীচে থাকা পাতালের রহস্য। মাটির নীচে আসলে কী রয়েছে তা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। পাতাল শব্দটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক অজানা, অচেনা, রহস্যময় জগত। আর পাতালের গুহার সঙ্গে যদি পৌরাণিক কোনও কাহিনি জড়িয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই, আগ্রহ যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেরকমই এক গুহা মন্দির হল উত্তরাখণ্ডের পাতাল ভুবনেশ্বর মন্দির। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গুহার বয়স আর পৃথিবীর বয়স নাকি সমান! উত্তরাখণ্ডের প্রতিটি শহর, প্রতিটি গ্রাম যেন নিজের মতো করে সুন্দর। এখানে যেমন রয়েছে নানা মন্দির, তেমনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও ভরপুর উত্তরাখণ্ডের প্রতিটি পাহাড়। আর উত্তরাখণ্ডকে কেন দেবভূমি বলা হয় তা এই পাতাল ভুবনেশ্বর মন্দিরে প্রবেশের পর খানিকটা টের পাওয়া যাবে।
গঙ্গোলিহাট থেকে ১৮ কিমি দূরে পাইনের ঘন বন আর পাহাড়ে ঘেরা গা ছমছমে পরিবেশে রয়েছে এই মন্দির। নাম মন্দির হলেও আদতে একটি চুনাপাথরের গুহা। প্রবেশদ্বার থেকে ৯০ মিটার গভীর এবং ১৬০ মিটার দীর্ঘ এই গুহা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৩৫০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। কথিত আছে, পাতাল ভুবনেশ্বর গুহায় একসঙ্গে কেদারনাথ, বদ্রিনাথ এবং অমরনাথের দর্শন পাওয়া যায়। এই গুহার কথা স্কন্দপুরাণেও বর্ণিত আছে।
গুহা আবিষ্কার
এই গুহা কীভাবে তৈরি হল, মানুষই বা কবে এর দেখা পেল এই নিয়ে অনেক মতামত উঠে এসেছে। তার মধ্যে একটি হল, স্কন্দপুরাণের মানসখণ্ডে বলা আছে যে, পাতালমণ্ডলে মানুষ দর্শন করতে আসবেন না, যতদিন না বল্কল নামে একজন মহাদেবকে লোকসমক্ষে নিয়ে আসবেন। বল্কল দেবাদিদেবের আরাধনা করার পরই এই গুহা সমস্ত মানুষের কাছে প্রবেশযোগ্য হবে। কেউই জানে না বল্কল নামে কোনও ব্যক্তি পাতাল ভুবনেশ্বরের এই গুহায় প্রথম প্রবেশ করে মহাদেবের আরাধনা করছিলেন কী না। আবার স্কন্দপুরাণের মানসখণ্ডেই বলা হয়েছে, অযোধ্যার রাজা ঋতুপর্ণ নাকি প্রথম এই গুহায় প্রবেশ করেন। পুরাণ আর ইতিহাস এমন ভাবে তালগোল পাকিয়ে যায় যে সত্য বিচার করা কঠিন।
পুরাণ অনুসারে, শিব এই গুহায় বাস করেন৷ তাঁর উপাসনার জন্য বাকি দেবতারা পাতাল ভুবনেশ্বরে উপস্থিত হন৷ দ্বাপর যুগে পাণ্ডবরা নাকি এখানেই পাশা খেলেছিলেন৷ আবার ত্রেতা যুগে অযোধ্যার রাজা ঋতুপর্ণ একটি হরিণকে ধাওয়া করতে করতে এই গুহাতেই পৌঁছেছিলেন৷ সেইসময় মহাদেব সহ ও অন্যান্য দেবতাদের দর্শন পান ঋতুপর্ণ৷ তবে অযোধ্যায় সূর্যবংশের কোনও রাজার নাম ঋতুপর্ণ ছিল না, তবে এই বংশের শেষ রাজা সুমতির পর নন্দ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয় নন্দের দ্বারা, সেই নন্দ বংশে ঋতুপর্ণ নামে এক রাজা এক সময়ে অযোধ্যায় রাজত্ব করেছিলেন। ঋতুপর্ণের সঙ্গে নল ও দময়ন্তীর নাম কয়েকটি কারণে জড়িয়ে আছে। তবে রাজা ঋতুপর্ণের এই গুহা আবিষ্কার সংক্রান্ত যে কাহিনি প্রচলিত, তাও কম চিত্তাকর্ষক নয়।
আরও পড়ুন- দশপ্রহরণধারিণী, দশ হাতের দশ অস্ত্রের অর্থেই লুকিয়ে সৃষ্টি থেকে প্রলয়ের রহস্য
ঋতুপর্ণ কোনও এক সময়ে শিকার করতে গিয়ে এক হরিণের দেখা পান। হরিণকে কিছুতেই তাঁর তিরের পাল্লার মধ্যে সুবিধাজনক অবস্থায় পান না, মায়াবী হরিণের মতো সর্বদাই সে দূরে চলে যেতে থাকে। শিকার করার জন্যে মরিয়া হয়ে হরিণকে ঋতুপর্ণ তাড়া করতে থাকেন। শেষে হঠাৎ সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। হরিণ অদৃশ্য হওয়ার জায়গায় গিয়ে পাহাড়ের গায়ে এক গর্ত দেখতে পেয়ে সেখান দিয়ে ঋতুপর্ণ পাহাড়ের গহ্বরে প্রবেশ করেন। হরিণের খোঁজ না পেলেও সেই গুহার রক্ষাকর্তা শেষনাগের দেখা পান। শেষনাগ ঋতুপর্ণকে তার ফণায় বসিয়ে গুহার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে দেখান। রাজাকে প্রভূত শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে বলিয়ান করে এবং প্রচুর ধনরত্ন দান করেন (কেন? তা অবশ্য জানা নেই)। গুহার বাইরে পৌঁছে দেওয়ার আগে শেষনাগ ঋতুপর্ণের শপথ আদায় করে নেন যে তিনি তাঁর এই নতুন পাওয়া গুণাবলি ও ধনরত্নের উৎসের কারণ কাউকেই জানাবেন না। এমন কি গুহার কথাও কাউকেই বলবেন না। অন্যথায় তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু হবে।
রাজা তাঁর প্রাসাদে ফিরে আসলেন প্রচুর ধনরত্ন সঙ্গে করে আর তাঁর নতুন আহরিত শক্তির কথাও কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হতে থাকল। স্বাভাবিকভাবেই সকলের মনেই কারণ জানার জন্য প্রশ্ন জাগতে থাকল। অন্যান্যদের থেকে বাঁচতে পারলেও রানির নাছোড়বান্দা জেরার সামনে শেষ পর্যন্ত তাঁকে নতি স্বীকার করতেই হল এক সময়। ফল, মৃত্যু। রানি সত্যই সাহসীনি, কিছুদিনের মধ্যেই রাজার দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী গুহা খুঁজে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। ভিতরে যাতায়াতের পথ সুগম করলেন, নিচে নামার জন্য গুহার গায়ে পাথর কেটে সিঁড়ি তৈরি করালেন। এক কথায় গুহার আবিষ্কারক ও সংস্কারক হলেন। তবে পুরাণে রানির নাম উল্লেখ নেই।
আবার কলিযুগে, ৭২২ খ্রিস্টাব্দে জগৎগুরু শঙ্করাচার্য গুহাটি খুঁজে পাওয়ার পর গুহায় স্থিত শিবলিঙ্গটিকে তামা দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন৷ কারণ নাকি শিবলিঙ্গ থেকে ঠিকরানো আলোর তেজ এতটাই যে যে কোনও ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যেতে পারত৷ এরপর চন্দ রাজারা এই গুহা খুঁজে পেয়েছিলেন৷
পৌরাণিক কাহিনি
এ তো গেল গুহা আবিষ্কারের কথা, কিন্তু এই গুহা মন্দির নিয়েও কিছু পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে। গণেশের জন্ম নিয়ে অনেক কথাই প্রচলিত। তেমনই এক কাহিনি হল, পার্বতীর ইচ্ছায় জন্ম হয়েছিল গণেশের। এরপর পার্বতী গণেশকে কৈলাসের দ্বারপাল হিসেবে নিযুক্ত করেন। গণেশ শিবকে কৈলাসে ঢুকতে বাধা দেন। একে অপরের পরিচয় না জেনেই যুদ্ধ শুরু হয়। আর শিব গণেশের মাথা কেটে দেন। এরপর পার্বতীকে শান্ত করতে তিনি হাতির মুণ্ড গণেশের ধড়ে স্থাপন করেন। শিব পুরাণ পড়লে জানা যায়, শিব বলছেন, “গণেশের ছিন্ন মস্তক অপ্সরাগণ অবশ্যই ধরেছিল, তা এখন কোথায় কে জানে! যা হোক এখন গণেশের দেহ ধুয়ে তাঁর পূজা কর। তারপর উত্তর দিকে গমন করে প্রথমেই যে ব্যক্তির দেখা পাবে তার মস্তক ছেদন করে তা গণেশের দেহে সংযোজিত করবে।” অর্থাৎ মস্তক ছিন্ন করার পরে তা অপ্সরাগণ নিয়েছিলেন কিন্তু তারপর তা কোথায় গেল তার শিব পুরাণে বলা নেই।
কিন্তু লৌকিক মতে, গণেশের কাটা মাথা কোথায় আছে তা নিয়ে একটি অদ্ভুত গল্প শোনা যায়। উত্তরাখণ্ডের পাতাল ভুবনেশ্বর মন্দির এলে এই লোককথার বিষয়ে আরও ভালো করে জানা যায়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মন্দিরেই আছে গণেশের কাটা মাথা আর সেই মাথা পাহারা দিচ্ছেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। ভুবনেশ্বর মন্দিরের ভূগর্ভে একাধিক গুহা রয়েছে। আর এই একাধিক গুহাগুলি একটি জায়গায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। লোককথা অনুযায়ী, এই সকল গুহার মিলনস্থলে যে উঁচু পাথরের ঢিবিটি রয়েছে সেটি গণেশের মাথা।
গুহার ভেতরে কী কী আছে?
পুরাণ অনুযায়ী, পাতাল ভুবনেশ্বর ছাড়া এমন কোনও স্থান নেই যেখানে একসঙ্গে চারধামের দর্শন করা যায়৷ পাতাল ভুবনেশ্বর দর্শন করলেই নাকি চারধাম যাত্রার ফল মেলে৷ গুহায় চারটি যুগের সঙ্গে যুক্ত দ্বার রয়েছে৷ এই গুহাতেই ৩৩ কোটি দেবদেবীর বাস৷ তক্ষক নাগের আকৃতির পাথরও দেখা যায়৷ পাশাপাশি পাতাল ভুবনেশ্বরে এলে দর্শন হবে কালভৈরবের জিভের৷ কথিত আছে, কালভৈরবের মুখ থেকে গর্ভে প্রবেশ করে লেজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে মোক্ষলাভ হয়।
আরও পড়ুন- দিঘা-মন্দারমণি ফেল! এই ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’-ই এখন বাংলার সেরা উইকেন্ড ট্যুরিস্ট স্পট
গুহার প্রবেশপথটি একটি সংকীর্ণ। গুহার ভেতরে ঢুকতে গেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। যদিও নামেই সিঁড়ি আসলে তা ভয়ঙ্কর এবড়ো খেবড়ো কিছু পাথরখণ্ড। দুই দিকে শক্ত করে চেন ধরে বসে বসে এক এক করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। দাঁড়িয়ে নামার উপায় নেই। নামতে নামতে মনে হবে যেন চিমনির ভিতরে নামতে হচ্ছে। এক এক করেই নামতে হয়, পাশাপাশি দু’জন নামার জায়গা নেই। তবে গুহা যেন মহাবিশ্বের এক অনন্ত গর্ভ। গুহার ভেতরে চারটি প্রবেশদ্বার আছে যার নাম– রণদ্বার, পাপদ্বার, ধর্মদ্বার এবং মোক্ষদ্বার। বলা হয়, রাবণের মৃত্যুর পর পাপদ্বার বন্ধ হয়ে যায় এবং মহাভারতের যুদ্ধের পর রণদ্বার, আক্ষরিক অর্থে যুদ্ধের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। গুহার প্রবেশপথেই আছে নরসিংহের মূর্তি। একটু নীচের দিকে নামলে শেষনাগের ফণার আকারে পাথর চোখে পড়ে। যত গুহার ভেতরে যাওয়া যায় ততই তার আকৃতি গরুর স্তনের মতো হয়ে যায়, বিশ্বাস করা হয় এটিই কামধেনু। আর একসময় এখান থেকেই দেবতাদের জন্য দুগ্ধ বেরত।
গুহার আরেকটি বৈশিষ্ট্য তার ভাস্কর্য। গুহার দেওয়ালে সাদা রাজহাঁস, গলার কাছ থেকে উল্টো দিকে ঘোরানো। সামনে ছোট ছোট কয়েকটা কুণ্ড। লৌকিক মতে, ব্রহ্মা এই হাঁসকে কুণ্ডের জল রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হাঁস নিজেই সেই জল পান করে ফেলেছিল তাই ব্রহ্মার অভিশাপে হাঁসের মাথা বেঁকে গেছে। এছাড়াও গুহার দেওয়ালে দেখা যায় ঐরাবতের পা, স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ, মহাদেবের জটা ইত্যাদি আরও অনেক কারুকার্য। লোকচক্ষুর অন্তরালে পাইনের বনে ঘেরা এই গুহা মন্দির ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী মানুষ তারা একবার গিয়ে ঢুঁ মেরে আসতেই পারেন।
কীভাবে যাবেন – কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে কাঠগুদাম পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতে করে পাতাল ভুবনেশ্বর গুহা।
কখন যাবেন - জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, এপ্রিল, মে, জুন, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর।