অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় বসে 'ম্যাজিক' শুরু, যেভাবে তৈরি হল 'নাটু নাটু' গান
Naatu Naatu Golden Globe: ‘মিরাপা টোক্কু’ (লাল লঙ্কা) ‘দুমুকুল্লাদাতাম’ (উপরে নিচে লাফানো) শব্দগুলি তেলেঙ্গানায় খুব সাধারণ কথ্য শব্দ। সেই সময় তেলেঙ্গানার প্রধান খাবার ছিল জোয়ার। এই খাবার খাওয়া হতো ঝাল ঝাল লাল লঙ্কা দি...
তেলগু সিনেমা 'RRR'-এর বিখ্যাত গান 'নাটু নাটু' সেরা মৌলিক গানের গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জিতেছে। বলাবাহুল্য, বেশ কয়েক বছর ধরেই বলিউডি সিনেমার জনপ্রিয়তাকে হেলায় পিছনে ফেলে দিয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা। বিষয়ে হোক বা নির্মাণে, অভিনয়ের সাবলীলতা হোক বা প্রযুক্তির ব্যবহারে মালয়ালম, তামিল, তেলগু ভাষার সিনেমা প্রকৃত সিনেপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে অচিরেই। দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা তার 'লার্জার দ্যান লাইফ'- ঘরানার জন্য পরিচিত ছিল। এখনও অনেকক্ষেত্রে তাই রয়েছে, তবে তাতেও যেভাবে বিষয়, অভিনয় আর যাবতীয় প্রযুক্তিকে তুলে ধরা হচ্ছে তাতে শুধু ভারত নয়, বিশ্বই হাঁ! দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের আভিজাত্য সুপ্রাচীন। ধ্রুপদী ঘরানার পাশাপাশিই সমসাময়িক সঙ্গীতও বিশ্বের কাছে ভারতীয় সঙ্গীতচর্চার মাটি-ধুলো মাখা গন্ধ নিয়ে গেছে। দক্ষিণ ভারতীয় সুরের জাদুতে গোল্ডেন গ্লোবের মতো মঞ্চও মুগ্ধ! সারা দেশ নাটু নাটু অথবা তার হিন্দি ভার্সন নাচো নাচোতে মেতে রয়েছে বেশ কিছুকাল ধরেই। কীভাবে তৈরি হল এই গান?
'নাটু-নাটু' (হিন্দিতে নাচো-নাচো) গানটিতে নেচে তাক লাগিয়েছেন এনটিআর আর রামচরণ। গোল্ডেন গ্লোবের মঞ্চ অবধি এই ভারতীয় গানের যাত্রাপথও ছিল আসলে সিনেমার মতোই। এই গানটি বড়পর্দায় আনার আগে সিনেমার পরিচালক এসএস রাজামৌলি, সঙ্গীত পরিচালক কিরাবাণী এবং গীতিকার চন্দ্রবোস ঠিক কী পরিকল্পনা করেছিলেন জানলেও অবাক হতে হয়। সেরা মৌলিক গান বলতে সেই গানটিকেই বোঝানো হয় যা বিশ্বের যে কোনও ভাষায় একটি চলচ্চিত্রের জন্য ব্যবহৃত গান, যে গানে আগের কোনও গান, সুর, বিষয়বস্তু বা অর্থের কোনও প্রভাব নেই। এই বিভাগে নাটু নাটুকে লড়তে হয়েছে মনোনয়ন পাওয়া অন্য ৮০টি গানের সঙ্গে।
‘নাটু-নাটু’ শব্দ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় একটি ‘জনগণের গান’। এসএস রাজামৌলি জানতেন এনটিআর জুনিয়র এবং রাম চরণ দুজনেই তেলগু সিনেমা জগতের সেরা নৃত্যশিল্পী। দু’জনেই নিজেদের মেধা আর প্রতিভার বহু প্রমাণ বারবার দিয়েছেন। দু'জনকে পর্দায় একসঙ্গে নাচানোর সুযোগ তাই হাতছাড়া করতে চাননি রাজামৌলি। নিজের এই ইচ্ছার কথা সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক কিরাবাণীকেও জানান রাজামৌলি। এর আগে বিবিসিকে এই বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে কিরাবাণী জানিয়েছিলেন, "রাজামৌলি আমাকে বলেছিলেন, বড় ভাই, আমি এমন একটা গান চাই যেখানে দুই বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নাচবে।" কিরাবাণী তখন গানটি লেখার জন্য তেলগু চলচ্চিত্রের এই যুগের অন্যতম বিখ্যাত এবং তাঁর প্রিয় গীতিকার চন্দ্রবোসকে বেছে নেন।
আরও পড়ুন- জনপ্রিয় গানের সুর নকল করেই বাজিমাত? কোন জাদুতে ৫০ বছরেও অমলিন ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে’!
কিরাবাণী চন্দ্রবোসকে বলেছিলেন, গানটা এমন হবে যাতে দুই অভিনেতাই প্রচণ্ড উত্তেজিত থাকবেন আর তাঁদের নাচের মাধ্যমেই এক উত্তেজনা এবং উত্সাহ দর্শক শ্রোতার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। সুতরাং যা ইচ্ছা লেখা যায়, শুধু মাথায় রাখতে হবে সিনেমাটি ১৯২০ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তাই শব্দগুলো যেন সেই সময়েরই হয়। ব্যাস! শুরু হলো কাজ। রাজামৌলি, কিরাবাণী এবং চন্দ্রবোস ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি এই গানটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। হায়দরাবাদের অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় ‘RRR’ অফিসে বসে কাজ শুরু হয়।
চন্দ্রবোস গানের নির্দেশ মাথায় নিয়ে গাড়িতে চাপলেন। রাজামৌলি এবং কিরাবাণীর কথাগুলো তখন মনের মধ্যে ঘুরছে। গাড়ি অ্যালুমিনিয়াম কারখানা থেকে জুবিলি হিলসের দিকে ছুটে চলেছে তখন। হাত গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আছে, আর মন খুঁজছে ম্যাজিক। সেই ম্যাজিক যা এনটিআর-রামচরণ আর রাজামৌলিকে নয় সারা দেশকে নাচাবে। মনে মনে শব্দ দুটো বারবার ধাক্কা দেয়, নাটু-নাটু। কিন্তু একে বসাবেন কোন সুরে? সুর তো তৈরিই হয়নি। চন্দ্রবোস তাল গুনতে শুরু করলেন। কিরাবাণীর প্রিয় তালের দিকেই এগোচ্ছে এই নাচের ছন্দও। বছর ২৫ আগে কিরাবাণী চন্দ্রবোসকে বলেছিলেন, এই বিশেষ তাল যে কোনও মানুষকেই উত্তেজিত করতে পারে।
নাটু নাটু এমনই এক গান যা এই তালে শুধু দেশের মানুষকে নয়, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের মানুষকে পা নাচাতে বাধ্য করতে পারে। দুই দিনে গানের তিনটি অংশ তৈরি করে কিরাবাণীর সঙ্গে দেখা করলেন চন্দ্রবোস। প্রথমে দুইখানি শুনিয়ে শেষে নিজের প্রিয় কবিতাটি পড়ে শোনালেন চন্দ্রবোস।
"পোলামাগাট্টু ধুম্মুলোনা পোটলগিত্তা ধুকিনাত্তু / পোলেরাম্মা জাতরালো পোথারাজু ওগিনাত্তু / কিরুসেপলু এসিকোনি কারাসামু সেসিনাত্তু / মারিসেত্তু নিদালোনা কুরাগুম্পু কোডিনাত্তু।"
আরও পড়ুন- সিনেমা নয়, ওয়েবসিরিজই মাত করেছে ২০২২! কোন কোন সিরিজ, সিনেমা জিতেছে মন?
কিরাবাণী তো চমৎকৃত! এইটাই হবে! এই কথাতেই বসবে সুর! দুই দিনেই গানটির নব্বই শতাংশ কাজ শেষ। তারপর অবশ্য একেবারে ফাইনাল করতে সময় লেগে যায় ১৯ মাস!
সিনেমাতে, ভীম মানে জুনিয়র এনটিআরে চরিত্রটি তেলেঙ্গানার এবং রাম অর্থাৎ রাম চরণের চরিত্রটি অন্ধ্র প্রদেশের। তাই গানটিতে দুই ক্ষেত্রেই ১৯২০ সালের কথ্য ভাষার শব্দ নেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘মিরাপা টোক্কু’ (লাল লঙ্কা) ‘দুমুকুল্লাদাতাম’ (উপরে নিচে লাফানো)। এই শব্দগুলি তেলেঙ্গানায় খুব সাধারণ কথ্য শব্দ। সেই সময় তেলেঙ্গানার প্রধান খাবার ছিল জোয়ার। এই খাবার খাওয়া হতো ঝাল ঝাল লাল লঙ্কা দিয়ে। তেলগুতে অনেক লোককাহিনি আছে যাদের চরিত্রগুলোও ব্যবহার করা হয়েছে এই গানে। গানটি গেয়েছেন কালভৈরব ও রাহুল সিপলিগঞ্জ।
'নাটু নাটু' গানে এনটিআর এবং রাম চরণের নাচের ক্ষমতা দেখে বলিউডের তাবড় শিল্পীরাও স্তব্ধ! কোরিওগ্রাফার প্রেম রক্ষিত এই গানটির জন্য প্রায় ৯৫টি স্টেপ তৈরি করেছিলেন। সেই স্টেপের ৩০ খানা সংস্করণও তৈরি করেছিলেন। বিশেষ করে সেই দৃশ্যে যেখানে এনটিআর এবং রামচরণ হাত ধরে নাচছেন। গানটি ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে শুট করা হয়েছে। এখানে শুটিং চলাকালীনই রাজামৌলি এবং কিরাবাণী গানের শেষ স্তবকটি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন। চন্দ্রবোস তখন ‘পুষ্পা’ ছবির সেটে ব্যস্ত। কনফারেন্স কলে জুড়লেন তিন জন। শেষ স্তবকটি পালটে গেল ১৫ মিনিটের মধ্যে।
বাকিটা? ইতিহাস...