নির্লজ্জতার মধ্যে দিয়েই প্রতিবাদ করতে হবে

The Shameless: কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত কন্সতান্তিন বোজানভ পরিচালিত ছবি ‘দ্য শেমলেস’ এর জন্য কলকাতার মেয়ে অনসূয়া সেনগুপ্ত সেরা অভিনেতার পুরস্কারে সম্মানিত হন।

নির্লজ্জতার পরিমাপ নির্ণয়ের কি কোনও মাপকাঠি আছে? নির্লজ্জতা কী? নির্লজ্জ কে? স্থান-কাল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিসরে নির্লজ্জতার মাপকাঠি কি সর্বদা এক? এক নারীকে যত সহজে আমরা 'নির্লজ্জ' আখ্যা দিয়ে থাকি বিভিন্ন সময়ে, পুরুষদের ক্ষেত্রে আমরা কি বেশি সাবধানী এই শব্দের ব্যবহারে? সম্প্রতি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত কন্সতান্তিন বোজানভ পরিচালিত ছবি ‘দ্য শেমলেস’ এরকম বেশ কিছু প্রশ্নের আবহ তৈরি করে। কান উৎসবের ‘উন সার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে দেখানো ছবিটির জন্য কলকাতার মেয়ে অনসূয়া সেনগুপ্ত সেরা অভিনেতার (সাবেকি ধরনে বললে ‘অভিনেত্রী’) পুরস্কারে সম্মানিত হন। আমরা জানি, বাংলা ছবির সঙ্গে কান চলচ্চিত্র উৎসবের নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল ‘পথের পাঁচালী’-কে কেন্দ্র করে। তবে অভিনয়ের জন্যও কান-এ সম্মানলাভ অভিনব। কোনও ভারতীয় অভিনেতা এই প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হলেন। এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যের। সদ্য সমাপ্ত ৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হলো ‘দ্য শেমলেস’ ছবিটি। উপস্থিত ছিলেন অনসূয়া এবং তাঁর সহ-অভিনেতা (অভিনেত্রী) ওমারা।

অনসূয়া সেনগুপ্ত এবং ওমারা মুখোমুখি হয়েছিলেন সাংবাদিকদের। পরে অনসূয়ার সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। এই বিষয়ে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাতে হবে KIFF কর্তৃপক্ষকে। সেইসঙ্গে ফিল্ম উৎসবের বাংলা বুলেটিন সম্পাদক চিত্র-সমালোচক নির্মল ধর এবং সজল দত্তকেও বিশেষ কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতার ঊর্ধ্বে অভিজিৎ গোস্বামী (চন্দনদা)। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ছিলেন অরিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও। ‘দ্য শেমলেস’ ছবিটি প্রদর্শিত হওয়ার পর আয়োজিত দীর্ঘ সাংবাদিক বৈঠকে কারও মুখে শোনা যায়নি বিকল্প যৌনতা নিয়ে সরাসরি কোনও প্রশ্ন। ‘বোল্ড’, ‘সাহসী’ ইত্যাদি শব্দের মধ্যেই আপাতত শান্তি-কল্যাণ। সাংবাদিক বৈঠক শেষে অনসূয়ার কাছে আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল—

প্র: এই ‘বোল্ড পারফরম্যান্স’ কথাটাই কি যথেষ্ট? এক আকাশের নীচে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্মতির ভিত্তিতে শরীর-বিনিময়কে কি সহজভাবে দেখে আমাদের সমাজ?

অনসূয়া: বিকল্প যৌনতা বিষয়ে যে অস্বস্তি চারিদিকে, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, তা কাটতে সময় লাগবে। আমাদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় কীভাবে ‘decent’, ‘proper’ হতে হয়। এমনকী যৌনক্রিয়া বা রতিক্রীড়ায় মত্ত দু’জন মানুষের জন্যও প্রথাসিদ্ধ ডিসেন্সি বজায় রাখার নানা ধারণার চাপ বহন করতে হয় সকলকেই। এটা একটা propriety এবং sobriety-র প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া, দুই নারী বা দুই পুরুষের প্রেম বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মহলে আজও নিন্দিত, ধিকৃত। অনেকে মনে করেন, এই আকাঙ্খাও বুঝি বা বিকৃত। এক্ষেত্রে সিনেমা এবং অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমগুলির সম্ভাবনা এবং সমস্যা অশেষ। সার্বিকভাবে পরিবর্তন হয়তো দূরের কথা। অন্তত এই বিষয়টিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে পারে সিনেমা। আধুনিক এই শিল্পমাধ্যমটি পারে মানুষের মনের মধ্যে অবদমিত যৌন আকাঙ্খা থেকেই উৎসারিত ঘৃণা, দ্বেষ এবং অসহিষ্ণুতার ওপর সরাসরি আঘাত করতে।

প্র: আমরা জানি, বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের যুগেই বিকল্প যৌনতার বয়ান উপন্যাসে দেখা গেছে কিন্তু বাংলা সিনেমা বা ভারতীয় সিনেমায় এই বিষয়ে কাজের নিদর্শন অকিঞ্চিৎকর।

অনসূয়া: আমি মনে করি, এই বিষয়ে ছবি নির্মাণ হলে এবং সেই ছবি খানিকটা সাড়া জাগালে নিশ্চয়ই তার প্রভাব পড়বে অন্যান্য চিত্রনির্মাতা বা ফিল্ম প্রযোজকদের ওপর। ‘দ্য শেমলেস’ ছবিটিকে ঘিরে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। আমরা হয়তো জরুরি কাজ করতে পেরেছি। কিন্তু এটা ভাবা ভুল যে রাতারাতি সব পাল্টে যাবে। আরও সময় লাগবে। সাহিত্যে যে বিষয় রয়েছে তা সিনেমায় দেখা গেলে প্রভাব হয় অনেক বেশি। সেই জন্য এই বিষয়ে যখনই একটা-দুটো ছবি হয়েছে, তখনই চারদিকে আবার ওই নির্লজ্জতার প্রশ্ন উঠেছে।

আরও পড়ুন- বাংলা সিনেমার উচ্চতা থেকে পতন নিয়ে দু’চার কথা

প্র: সাংবাদিক বৈঠকে ‘বোল্ড’ কথাটা এতবার ব্যবহার করা হলো। অথচ বিকল্প যৌনতা বিষয়ে এত কম কথা কেন? এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তোলাতেও কি সামাজিক অনুজ্ঞার অবরোধ রয়েছে?

অনসূয়া: ঠিকই বলেছেন। একটা ভয়ের পরিবেশ আছে। আমরা এখনও ‘বোল্ড’ বা ‘সাহসী’ এই জাতীয় শব্দের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি না। একটা কথা বলে রাখা দরকার – আমরা অভিনেত্রীরা, এই ধরনের শব্দ-ব্যবহারকে খুবই অপছন্দ করি। কারণ, মানব চরিত্র বিচিত্র। ফলে এই ধরনের শব্দ-ব্যবহার নিতান্তই লঘু করে বলার চেষ্টা। কিন্তু আশা করি এখন না হলেও, আগামী চার-পাঁচ বছরে আমাদের দেশে ছবিটা অনেকটা পালটাবে। বিকল্প যৌনতা বিষয়ে আরও বেশি ছবি হবে। তর্ক-বিতর্কের আবহ আরও তৈরি হবে। আমি বলতে চাইছি, এই বিষয়ে আরও কথা হোক। মত বিনিময় হোক। যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের সঙ্গেও গড়ে উঠুক সংলাপের পথ। এই ছবি দিয়েই হোক সেই যাত্রাপথের সূচনা।

প্র: বিকল্প যৌনতা বিষয়টা না হয় শিকেয় তোলা হলো। মানব-মানবীর প্রেম বা শারীরিক আদানপ্রদান বিষয়েও তো হাজার বিধিনিষেধ। এই ছবিতে আপনি অভিনয় করেছেন যৌনকর্মীর চরিত্রে। ওমারার অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে আপনার প্রেম। অন্যদিকে, ওই মেয়েটিকে পেশায় আনতে চাইছেন স্বয়ং তাঁর গর্ভধারিণী। বাধ সাধছেন ঠাকুমা, অর্থাৎ মিতা বশিষ্ঠ।

অনসূয়া: এই ছবিটি শেমলেস হওয়া বা নির্লজ্জ হওয়ার মধ্যে দিয়েই স্বাধীন হয়ে ওঠার গল্প। আমি যে চরিত্রটি করেছি, সে তো এক খদ্দেরের বুকে ছুরি বসিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সে আবার হিন্দু দেবীর রূপ ধারণ করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের বিরুদ্ধেও এটা তার বিবৃতি। উগ্র জাতীয়তাবাদী দু-একজনের সঙ্গেও তার বাদানুবাদ হচ্ছে, কখনও তিক্ত বিনিময়ও। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে সঞ্চিত রয়েছে প্রতিবাদের আকাঙ্খা। যেকোনও কেন্দ্রপ্রবণ শক্তি মূলত নির্ধারণবাদী। পৌরুষের ব্যাখ্যায়, নারীত্বের মহিমা-কীর্তনেই প্রচলিত সামাজিক বয়ানের অঙ্গীভূত করতে চাওয়া হয় সাধারণ মানুষকে। এই মেয়েটি যেন তার সারা শরীর জুড়ে প্রতিরোধের ভাষ্য রচনা করে। তার প্রতিবাদের ভাষা লেখা আছে মেয়েটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। তার মুখের ভাষা খারাপ— সামাজিক অর্থে অশ্লীল। ঘনঘন ধূমপান করে। নারী হয়েও সে কামনা করে আরেক নারীশরীর। এই শরীরী অনুষঙ্গ এবং মুখের ভাষা হয়ে ওঠে লড়াইয়ের আহ্বান। তার লড়াই নির্ধারণবাদের বিরুদ্ধে। সে বোঝে, এই সমাজ তাকে যেকোনও সময় পেড়ে ফেলতে পারে। অতএব সে সবসময়ই প্রস্তুত লড়তে। তার অস্ত্র তার শরীর।

আরও পড়ুন- বৃদ্ধ মেষপালক, বিষণ্ণ গুহা ও একটি নিশ্চুপ সিনেমা; কেন দেখব ‘দ্য হোল’?

প্র: কলকাতা শহর, বাংলা ভাষা এসব নিয়েও কিছু বলুন।

অনুসূয়া: আমার বেড়ে ওঠার শহর কলকাতা। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতায় এসে নিজেকে নন্দন-১-এর বড় পর্দায় দেখব— এই স্বপ্ন তো আমার বহু দিনের। বিদেশে সমাদৃত হলেও এখানে এই ছবি নিয়ে এরকম আলোড়ন দেখে মনে হচ্ছে, কান-এর চেয়ে এটা বড় প্রাপ্তি। এ আমার স্বপ্নপূরণ। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে দীর্ঘ লাইন এবং ভেতরে ফিল্মের নানা মুহূর্তে দর্শকদের সমবেত দীর্ঘশ্বাস বা উচ্ছ্বাসের প্রকাশ— এই স্মৃতি আমার চিরদিনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। আমার ফেসবুক প্রোফাইলের কথা একটু বলা দরকার। এই ছবির পরিচালক কন্সতান্তিন বোজানভের সঙ্গে আমার যোগাযোগ গড়ে ওঠে বেশ বিচিত্রভাবে। আমি নিজে প্রোডাকশন ডিজাইনার। ফেসবুকে নানারকম কার্টুন, স্কেচের বিস্তার ঘটেছে। আমার অনেকগুলো ফেসবুকের ফটো দেখে বোজানভের মনে হয়, এই চরিত্রটির জন্য আমি উপযুক্ত। আমার ফেসবুক ওয়ালে সেইসব ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি আমাকে নস্ট্যালজিক করে। কিন্তু ক'টা আর হলুদ ট্যাক্সির দেখা মিলবে শহরে! তাই, ঝরে পড়ে আমার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। এই শহরে যেসব চিত্রনির্মাতারা কাজ করেছেন, তা তো বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্বের কিন্তু শহরেও ভিন্ন ভাবনার ছবি তেমন দেখা যাচ্ছে কোথায়! বরং আমি বলব, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে পরিবেশ আমরা দেখেছি, সেটা খুব উল্লেখযোগ্য।

প্র: কান-এ সম্মানপ্রাপ্তি প্রথম বাঙালি অভিনেতা হিসেবে – এবিষয়ে আপনার ভাবনা...

অনসূয়া: একটা কথা বলি। আমি কখনও ভাবিনি যে, এই সম্মান বা পুরস্কার শুধু আমার জয়। এর একটা অন্যতম কারণ অবশ্যই এই যে, ছবিটি একটি যুগ্ম প্রযোজনা। ফলে, এটা আমাদের সকলের জয়। আমি এখানে বিশেষ করে ওমারার কথা বলব। আমরা দু'জনে একসঙ্গে অনেক দিন কাটিয়েছি – বেশ কয়েক বছর ধরে চলছিল এই ছবির প্রস্তুতি। আমরা দু’জনে একসঙ্গে ওয়ার্কশপ করেছি, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেছি, বহু দিন-রাত একসঙ্গে কাটিয়েছি। দরকার মতো চিত্রনাট্যেও অদলবদল করেছি আমরা। ফলে একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে শুটিংয়ের আগেই। সেটিই ছবিতে দেবিকা ও রেনুকার সম্পর্কে প্রতিফলিত হয়েছে খুব কার্যকারীভাবে। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যৌনকর্মীদের হামেশাই শোষিত এবং ‘শেম’ করা হয়। সেই শিকল ভেঙে ছবির দুই প্রধান চরিত্র পরস্পরকে কাছে পায়। তাদের সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রথাসিদ্ধ সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে জোরালো সওয়াল উঠে এসেছে এই ছবিতে।

প্র: কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভাল শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই ধর্মতলা মেট্রো স্টেশনে এক তরুণ-তরুণী জোড় প্রকাশ্যে, ভিড়ে ঠাসা স্টেশনে মেতে ওঠেন প্রগাঢ় চুম্বনে। এখন ধর্মতলা মেট্রোয় মানুষের ভিড় বেড়েছে। হাওড়ার দিকে যেতে হয় এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন থেকে। গ্রাম-মফসসলের যাত্রীরাও সাক্ষী ছিলেন ওই তরুণ-তরুণীর সংরক্ত মুহূর্তের। গুঞ্জন শুরু হয় তখনই। নির্লজ্জতার কথা ফিরে ফিরে শোনা গিয়েছে সেই সময়ে।

অনসূয়া: আগেই বলেছি, নির্লজ্জতার মধ্যে দিয়েই প্রতিবাদ করতে হবে। যাঁদের ইচ্ছা হয়েছে প্রকাশ্যে চুম্বন করতে, তাঁদের আকাঙ্খাকে স্বাভাবিক বলেই মানতে হবে। কেউ চাইলে বলতেই পারেন তাঁরা নির্লজ্জ। আমার ধারণা, এরকম ঘটনার সংখ্যা আগামী দিনে বাড়বে। কারণ, প্রথম থেকেই অবদমনের শিক্ষা পাই আমরা। মেয়েদের কাজ উৎপাদন, পুনরুৎপাদন ও প্রজনন। এটাই রাষ্ট্র এবং সমাজ-অনুমোদিত ব্যবস্থা। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালে বিপদ-সংকেত শুনতে পান ক্ষমতাসীনরা। কারণ পুরুষকে হতে হবে সংযমী এবং দৃঢ় চরিত্রের। নারীর আত্মনিবেদনেই পুরুষের সেই গরিমা সার্থক হবে। এখন সময় বদলাচ্ছে। বন্ধুরা খোলামেলাভাবে যৌনতা বিষয়ে নানা কথা বলছেন। অন্তত আমি নিজের যাদবপুরের দিনগুলোর কথা তো বলতেই পারি। ফলে, সহজভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ সাধা হবে আর কত দিন? এই ধরনের subversion আরও ঘটবে। এও এক ধরনের প্রতিবাদ বলে আমি মনে করি। একজন মানুষের নিজস্ব স্বাধীনতার দিকে দু-পা এগিয়ে যাওয়া এভাবেই হয়তো ঘটবে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কথাই ধরা যাক। এঁদের অধিকাংশই সুশোভন, প্রথাসিদ্ধ নাগরিক-জীবনের ধ্বজাধারী। কিন্তু মার্জিত, সুশোভন, সমাজ-স্বীকৃত হয়ে ওঠার দৈনন্দিন প্রচেষ্টার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অট্টালিকা ভেঙে পড়ার মালমসলা।

আরও পড়ুন- নিরাপদ নির্মাণ: শ্যাম বেনেগালের সিনেমা

প্রসঙ্গত—

১) এই বার্তালাপের কিছুদিন পরেই কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে পুনরায় এমনই দৃশ্যের জন্ম হয়। সেই কথা উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়ও।

২) এই প্রতিবেদকের সংযোজন, অর্থশাস্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে যে, শিল্পকর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য চিত্তবিনোদন। ধরা যাক নাটক। ‘কুশীলব’-এর প্রবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যৌনকর্মী বা ‘গণিকা’-র প্রবৃত্তি। গণিকার মতোই কোনও নট, নর্তক বা কথকের শরীরকে কেন্দ্র করে যে রস-সঞ্চার ঘটে, তার সঙ্গে ওই প্রবৃত্তির দূরত্ব সামান্যই। মার্জিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষকে উৎপাদন ব্যবস্থার পুনরুৎপাদনের বিষয়ে হতে হবে ক্রিয়াশীল। কারণ, রাষ্ট্রই সদা-সর্বদা এই উৎপাদন ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। দায়িত্ববান নাগরিককে কথক-নর্তকদের ঘোর বা spell-কে দীর্ঘমেয়াদি হতে দিলে চলবে না। তাতে পরিবার গঠন ও রাষ্ট্র-হিতে ঘটে যেতে পারে বিপর্যয়। অতএব, বারবনিতাদের মতোই শিল্পীর অবস্থানও সমাজের প্রান্তেই।

৩) প্রাবন্ধিক-অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘স্যাফোর দিকে’ প্রবন্ধে ‘ইলিয়াড’ উদ্ধৃত করে বলেছেন— ‘যার স্পর্ধার কারণে এত বড় কাণ্ড, এত প্রাণহানি, অনন্তর এত ধ্বংস, সেই প্যারিসই কি না যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন-উদ্যত।’ ভাইয়ের কাণ্ড দেখে হেক্টরের মুখে তীব্র বাক্যবাণ— ‘তুই বিষ-কীট! অপদার্থ একখান— চেহারা ছপ্পর বই তোর আছেটা কী... ঘেন্নার জানোয়ার একটা...।’ প্যারিস যুদ্ধ ছেড়ে নর্মসঙ্গিনী প্রিয়া হেলেনের ঘরে গিয়ে সেঁধোয়। হেলেনের নরম বিছানায় আশ্রয় পেতে মরিয়া প্যারিস। এই পর্বের নাম ‘হেলেন প্যারিস আফ্রোদিতে’। গ্রিস ট্রয়ের সেনানীরা যখন মৃত্যু-ডঙ্কা বাজাচ্ছে, সেই লগ্নেই প্রণয়ের দেবী আফ্রোদিতের ভজনায় মত্ত প্রেমিক-প্রেমিকা জোড়। খোলামেলা ধ্বংসলীলার পাশেই চলছে (অনবদ্য) যুগল-সংগম।

গ্রন্থ সহায়:

১) ‘Sacred to Profane : Writings on Performance and Worship’, Ed. Anjum Katyal, Seagull Books. Introduction (‘The Laughing Performer – The World of Thieves’) by Sibaji Bandyopadhyay.

২) ‘আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার : প্রবন্ধ সংকলন’, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গাঙচিল।

More Articles