নাগাসাকির নামই ছিল না মার্কিন-তালিকায়, তবু 'ফ্যাট ম্যান' ধ্বংস করেছিল গোটা শহর
World Nagasaki Day 2023: আজও সেই পারমাণবিক বোমার ভয়বহতা বুকে নিয়ে বসে রয়েছে জাপান। আজও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে জন্ম হয় বিকলাঙ্গ শিশুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে ভয়াবহতা বিশ্ব দেখেছিল, তা মুছে ফেলা কঠিন ছিল।
মাত্র একদিনের ব্যবধানে ধ্বংস হয়ে গেল দু-দু'টি শহর। হিরোসিমায় যখন আঘাত হানল লিটল বয়, তখনও জাপান জানত না, তার ঠিক দু'দিনের মাথায় ফের একই ঘটনার রদেভু দেখতে চলেছে দেশ। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা শেষে আর কিছু নয়, শুধু নেই হয়ে গেল দু'টো শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এমন ভয়াবহ পরিসমাপ্তি বোধহয় ভাবতে পারেনি গোটা বিশ্ব। আমেরিকার বিশ্বস্ত সেনাপতির মতো সমস্ত খেলা পাল্টে দিল 'ফ্যাট ম্যান'। নাগাসাকিতে ৯ অগস্ট সকালে আঘাত হানল যে পারমাণবিক বোমা, তার কোডনেম ছিল ওটাই।
প্লুটোনিয়াম দিয়ে তৈরি ফ্যাট ম্যানের ডিজাইন ছিল লিটল বয়ের থেকেও জটিল। আরও বড় ক্ষতি, আরও বড় সর্বনাশের আয়োজন বুকে নিয়ে নাগাসাকির রাত্তিরে নেমে এসেছিল সে। আমেরিকার কাছে প্রাথমিক তালিকায় ছিল জাপানের পাঁচটি শহরের নাম। কোকুরা, হিরোসিমা, ওকোহামা ও কোয়োতো। অদ্ভুত ভাবে সেই তালিকায় নাগাসাকির নাম ছিলই না কখনও। তবু কপাল পুড়ল নাগাসাকির। বোমা পড়ার কথা ছিল কোয়োতোতে। কিন্তু মার্কিন ওয়্যার সেক্রেটারি হেনরি স্টিমসনের আবার জাপানের সেই প্রাচীন শহরটি ভারী পছন্দের ছিল। ফলে সচিবের ইচ্ছায় বাদ পড়ল শহরটি। হাঁড়ি ভাঙল নাগাসাকির মাথায়।
আরও পড়ুন: এদেশেই মিলেছিল পারমাণবিক বোমার রসদ! ভারতের এই রাজ্যই ছিল ব্রিটিশদের পাখির চোখ
মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তির লড়াইয়ে প্রাণ গেল কয়েক লক্ষ নিরপরাধ বাসিন্দার। যারা মিত্রশক্তি বোঝে না, অক্ষশক্তি বোঝে না। বোঝে না কীসের লড়াই। বিশ্বের একদল সেরার সেরা বিজ্ঞানী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত এক করে বানিয়ে ফেললেন পরমাণু বোমা। যার পরে মিত্রশক্তির বিজয় একরকম নিশ্চিত ছিল। এমন ভয়াবহ একখানা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নাকি জাপানকে সতর্কও করেছিল আমেরিকা। বোমা পড়ার আগে জাপানের বেশ কিছু শহরে পড়েছিল প্যামফ্লেট। না, বিস্ফোরণের সতর্কতা সেখানে ছিল না, বরং অসামারিক নাগরিকদের পালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল মিত্রশক্তির সবচেয়ে বড় দেশ আমেরিকা। তবে কোন শহরে বোমা পড়তে চলেছে, এমন কোনও দিকনির্দেশ সেখানে ছিল না।
হিরোসিমায় যখন বোমাটি পড়েছিল, তখন সবে জাগতে শুরু করেছে শহর। ঘুম-তন্দ্রা ফেলে কাজে নামতে প্রস্তুত, ইনোলা বে নামে যুক্তরাষ্ট্রের বি-২৯ বোমারু বিমান বর্ষণ করল 'লিটল বয়'টিকে। বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথমবার পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হল যুদ্ধে। ১২ থেকে ১৫ হাজার টন টিএনটি বিস্ফোরণে যে প্রভাব পড়তে পারে, তার চেয়েও বড় ছিল এই আঘাত। প্রায় পাঁচ বর্গমাইল জায়গা ধ্বংস হয়ে গেল পুরোপুরি। দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ নেই হয়ে গেল সেই হামলায়। আর তার চেয়েও বড় সংখ্যক মানুষ বেচে রইলেন পুড়ে যাওয়া ত্বক, উড়ে যাওয়া পা আর ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে। রক্তে ক্রমাগত মিশতে লাগল তেজস্ক্রিয়তার বিষ, যা আগামী কয়েক প্রজন্ম, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষের জিনকে লালন করতে থাকবে। মাথার ভিতর জেগে থাকবে ভয়াবহ বিস্ফোরণের স্মৃতি।
এতটুকুতে 'সবক' শেখানো গেল না জাপানকে। মাথা মাটিতে মিশিয়ে দিতে আরও বড় পরিকল্পনা, আরও বড় ষড়যন্ত্রের নীল নকশা তৈরি ছিল আমেরিকার হাতেই। তাই ৬-এর পরেই ৯। কী ঘটে গেল, তা তখনও ঠিক ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনি জাপান। ৯ অগস্ট সকাল ১১টা ২ নাগাদ ফের আরও একটি বোমা নেমে এল নাগাসাকি শহরের মাথায়। এবার আরও বড় বিস্ফোরণ, আরও বড় ক্ষতি অর্থাৎ আরও বড় জয়। ২৩ শতাংশ বাড়ি ঘর আর প্রায় ৭০ শতাংশ শিল্পাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেল এই হামলায়। মারা গেল কয়েক হাজার মানুষ। এই হামলায় জনসংখ্যার প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষই 'খতম' হয়ে গেলেন। যারা বেঁচে রইলেন, তাঁদেরও পুরোপুরি জ্যান্ত বলা যায় না।
আজও সেই পারমাণবিক বোমার ভয়বহতা বুকে নিয়ে বসে রয়েছে জাপান। আজও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে জন্ম হয় বিকলাঙ্গ শিশুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে ভয়াবহতা বিশ্ব দেখেছিল, তা মুছে ফেলা কঠিন ছিল। যুদ্ধের ময়দানে জাপানও কিছু কম ছিল না। জাপানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটেন এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মোট ৭১ হাজার সৈনিক নিহত হয়েছিল। তার মধ্যে ১২ হাজার সৈনিক মারা যায় কেবল জাপানের হাতে যুদ্ধবন্দী অবস্থায়। বারবার মিত্রশক্তি বেধে দিচ্ছিল আত্মসমর্পণের সময়সীমা। তার পরেও বারবার তা এড়িয়ে যাচ্ছিল জাপান। জার্মান সরে আসার পর কোণঠাসা হয়েও ময়দান ছাড়তে রাজি ছিল না জাপান। আর তার পরেই জাপানের বুকে নেমে এল আমেরিকায় ভয়ানক ব্রহ্মাস্ত্র। ১৯৪৫ সালের ১৪ অগস্ট নিঃশর্ত ভাবে আত্মসমর্পণ করল জাপান। থামল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে গর্বিত ভাষণ দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। জানালেন, ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হয়েছে অবশেষে। অন্যদিকে, রেডিওতে দেওয়া বক্তৃতায় জাপানের সম্রাট হিরোহিত হারের জন্য দায়ী করলেন নিষ্ঠুর ওই বোমাকে। জানালেন, এর পরেও লড়াই চালানো মানে আসলে মানবসভ্যতার পতন ডেকে আনা, মানচিত্র থেকে জাপানকে মুছে ফেলা।
হেরে যাওয়া দেশ সই করল আত্মসমর্পণের দলিলে। জয়ের আনন্দে মাতল মিত্রশক্তির আওতায় থাকা দেশগুলি। বিজয় উৎসব পালিত হল ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়। ঘোষণা হল দু'দিনের জাতীয় ছুটি। রাস্তায় নামল কুচকাওয়াজ, মোড়ে মোড় অনুষ্ঠান।
কীসের বিনিময়ে ফিরল এই যুদ্ধশান্তি! তার প্রতিটি কণার হিসেব রাখা রইল পারমাণবিক বোমার স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে। যে মেয়েটি বোমায় রক্তাক্ত মানুষগুলোর জন্য নদীতে ছুটে গিয়েছিল জল আনতে, যে জল মুখে দিতে না দিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল মানুষ, সেই স্মৃতির কাছে তোলা রইল সব হিসেব। বোমার শিকার হয়েও যারা বেঁচে রইলেন আরও অপরিসীম যন্ত্রণা সহ্য করবেন বলে, তারা জাপানে 'হিবাকুশা' নামে পরিচিত। কয়েক দিন, কয়েক মাস এমনকী কয়েক বছর পরেও বিস্ফোরণের জেরে টপাটপ মরে যাচ্ছিল মানুষ। শুধু কয়েক বছর নয়, কয়েক প্রজন্ম পরেও শরীরে থেকে গিয়েছিল ভয়ানক নেই পারমানবিক বিষ। সেই মাশরুমের মতো বিস্ফোরণ আজও বসে রয়েছে মানুষের চোখে। ইতিহাসের সবচেয়ে নির্লজ্জতম পর্ব যদি কিছু থেকে থাকে, তা বোধহয় এই পারমাণবিক হামলা।
আরও পড়ুন: নেহাত সাধনা নাকি ঈশ্বরত্বের হাতছানি, কেন সর্বঘাতী পরমাণু বোমা বানিয়েছিলেন ওপেনহাইমার?
দেখতে দেখতে ৭৮ বছর কেটে গেল এই ভয়ঙ্কর ঘটনার। আজও এর ভয়াবহতা কমেনি একচুলও। এ বছর ভয়াবহ টাইফুনের প্রকোপে পড়েছে জাপান। তার মধ্যেই পালিত হয়েছে ইতিহাসের এই অভিশপ্ত দিন। বিজ্ঞান, ধ্বংস ও রাজনীতির যে ভয়াবহ রূপ সেদিন বিশ্ব দেখেছিল, তা বোধহয় নজিরবিহীন। অনেকেই মনে করেন, এই ভয়ঙ্কর হামলার কারণ ছিল তৎকালীন জাপান প্রশাসনের ব্যর্থতা। তারাই যুদ্ধপরিস্থিতিতে ঠিক ভাবে সামলাতে পারেনি। কূটনীতিগত বেশ কিছু ভুল পদক্ষেপের জন্যই জাপানের মাথায় নেমে এসেছিল এই প্রত্যাঘাত। তবে পারমাণবিক বোমার চেয়েও কি বেশি ছিল সেই ভুল! কয়েক লক্ষ নিরপরাধ মানুষের প্রাণের চেয়েও বড়! আসলে রাজাদের যুদ্ধে এমনটা হয়। উলু-খাগড়া, ঘুমচোখ মানুষ, শিশু-বৃদ্ধের এমন কত প্রাণই না যায়! আর এখানে তো লড়াই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলির মধ্যে। যার ছাপ আজন্ম থেকে যাবে এই অগস্ট মাস জুড়ে।