গ্রাম দখলের টোটকা এখনও শুভেন্দুর অধরাই! নন্দীগ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপি কেবলই বুদবুদ?
Nandigram Panchayat Election 2023: পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের ৭০টি আসনের মধ্যে ৫৬ টিই পেয়েছে তৃণমূল। বিজেপি পেয়েছে মোটে ১৪টি আসন।
লাঙল যার জমি তাঁর। বামেদের এই রাজ্যে ভিত পোক্ত করার নেপথ্যে ছিল জমি আন্দোলন। সেই জমি আন্দোলনই কেড়ে নিয়েছিল দীর্ঘদিনের লালিত মসনদ। সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের আন্দোলন বাস্তবিকই ছিল রাজ্যে পালাবদলের মাইলফলক। সেই যে বাঁক থেকে রাজ্যের রাজনীতি ঘাসফুলের দিকে ঘুরল, তারপর একের পর এক ‘ধামাকা’। যে বিজেপি এই রাজ্যে কোনওদিনও যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে ভাবা যায়নি, সেই গেরুয়া শিবির রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেয় শাসকের মনে। বিধানসভা ভোট হয়ে দাঁড়ায় ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’। অবস্থা সামলাতে বাইরে থেকে নির্বাচনী কৌশলীকে ডেকে আনতে হয় জেতার মন্ত্র শিখতে। কোণঠাসা হয়ে একপ্রকার টিমটিমে অস্তিত্ব হয়ে যায় এককালের শাসক বামেদের। সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতির আকর। তবে সময় বদলায়, মানুষকে নিয়েই বদলায়। যে শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রাম আন্দোলনে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডানহাত, তিনিই হয়ে গেলেন বিজেপি! তারপর শুরু ঘাসফুল উপড়ে পদ্ম ফোটানোর খেলা। শুভেন্দু অধিকারী দল বদলানর পর এটিই ছিল প্রথম পঞ্চায়েত ভোট। ভোট গণনা হতেই দেখা গেল নন্দীগ্রাম-সহ গোটা জেলাতেই গেরুয়া ঘ্রাণ। বেলা বাড়তেই দেখা যায় ঘ্রাণ ক্রমেই কমছে। কীভাবে, কোন মন্ত্রে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছিলেন শুভেন্দু? নাকি গ্রাম দখলের লড়াইয়ে এখনও শাসক দলের কাছে নেহাতই শিশু তিনি?
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে অমিত শাহের হাত ধরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তার আগে অবধি তৃণমূলের হয়ে নন্দীগ্রাম সামলানোর কাজ করতেন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোতে যে তিনি আলোকিত নন তা বিধানসভাতেই প্রমাণ করে দেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রাম আসনের লড়াই এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে প্রার্থী হন! তৃণমূল বনাম বিজেপির চেয়েও মরিয়া লড়াই হয়ে যায় মমতা বনাম শুভেন্দুর প্রেস্টিজ ফাইট! রাজ্যকে চমকে দিয়ে বিধানসভা ভোটে নিজের কেন্দ্রে জয়ী হন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বুঝিয়ে দেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপগ্রহ নন, নিজের দাপটেই এতকাল রাজনীতি করেছেন, করছেন! ব্যবধান একেবারে কাঁটায় কাঁটায় হলেও, জয় তো জয়ই! ১৯৫৬ ভোটে জেতেন শুভেন্দু, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জয়কে চ্যালেঞ্জ করে বসেন কলকাতা হাইকোর্টে! সেই মামলা এখনও চলছে। এবার তাই নন্দীগ্রামের পঞ্চায়েতে বিজেপির দাপট দেখাতেই হতো শুভেন্দুকে। পেরেছেন কিছুটা, পারেননি অনেকটাই!
আরও পড়ুন- সন্ত্রাস ছাড়া জয় নেই! শেষ ২০ বছরে বাংলার পঞ্চায়েত মানেই লাশের রাজনীতি
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে নন্দীগ্রামে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল তৃণমূলের। স্বাভাবিক, তেমনই তো হওয়ার কথা। সেই বছর নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতই তৃণমূল দখল করে। নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের ৭ টি পঞ্চায়েতও ছিল তৃণমূলেরই দখলে। পাঁচ বছর পর চিত্রটা বেশ পালটে গেল। নন্দীগ্রামে একাধিক পঞ্চায়েত চলে এল বিজেপির দখলে। কিন্তু অত সহজ অঙ্ক তো গ্রামের রাজনীতিতে কষে না কেউই!
Big Breaking:
— Kunal Ghosh (@KunalGhoshAgain) July 12, 2023
In Nandigram, @AITCofficial is enjoying a lead of 10,457 votes according to Zilla Parishad results.
So the distorted story of 1956 floated by Loadshedding MLA stands cancelled and is dropped in the waste paper box.
নন্দীগ্রামের দু’টি ব্লক মিলিয়ে মোট ১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। গণনার দিন অনেক রাত পর্যন্ত সরকারিভাবে এই ১৭টি পঞ্চায়েতের ফলাফল স্পষ্ট হয়নি। তবে তৃণমূলের থেকে যে এগিয়ে ছিলবিজেপি তা স্পষ্ট। গণনা অনুযায়ী ১৭টির মধ্যে ১০টি পঞ্চায়েত দখল করছে বিজেপি। ৬টি পাচ্ছে তৃণমূল এবং একটি ত্রিশঙ্কু। তৃণমূল যতই সংখ্যা নিয়ে এদিক সেদিক করুক না কেন, তারা যে পিছিয়ে তা স্বীকার্য। কিন্তু তৃণমূলের পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে বিজেপির কঠোর পরিশ্রমকে মোটেই কৃতিত্ব দিচ্ছে না শাসক। বরং খানিক নিজেরই নাক কেটে যাত্রাভঙ্গের চেষ্টা হচ্ছে। তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলকে দুষছেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীদের ভোটেই বিজেপি পুষ্ট হচ্ছে বলে তাঁর বিশ্লেষণ। তবে বিজেপি মাথা ব্যথার কারণ হলেও, তা আস্ত তৃণমূল দলের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতোও না। প্রমাণ করল পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের ফল। সবটা প্রকাশ্যে আসেনি, তবে যতটা জানা যাচ্ছে, গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করতে পারলেও পঞ্চায়েত সমিতি আর জেলা পরিষদের তৃণমূলেরই রবরবা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের ৭০টি আসনের মধ্যে ৫৬ টিই পেয়েছে তৃণমূল। বিজেপি পেয়েছে মোটে ১৪টি আসন। সিপিএম বা কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত কোনও জেলা পরিষদ আসন পায়নি।
আরও পড়ুন-স্নেহ না সৌজন্য! শুভেন্দু অধিকারীকে কেন ‘ক্ষমা’ করে দিলেন মমতা?
নন্দীগ্রামের হারানো জমি ফিরে পেতে কম চেষ্টা করেনি তৃণমূল, আর শুভেন্দুও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বিজেপির এই সম্ভাব্য শক্ত ঘাঁটিতে যেন কোনওভাবেই দাঁতও না ফোটাতে পারে তৃণমূল। ক্রমাগত নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করে যেতে হয়েছে শুভেন্দু অধিকারীকে। বাংলার ক্ষেত্রের বিজেপির মধ্যে বাকি নেতাদের থেকে তিনি যে কোথায় আলাদা তা প্রতি পদে প্রমাণ করতে হয়েছে। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা বর্তমান সর্ভারতীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষের বুথে প্রার্থী দিতে পারেনি বিজেপি। বর্তমান রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার নিজের এলাকায় মাত্র একটি পঞ্চায়েতে জিতেছেন। দুই দলীয় ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র থেকে ঢের এগিয়ে আছেন শুভেন্দু। তবে এগনোর সীমা তৃণমূলের ধারে কাছে না।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের বেশ কিছু এলাকা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। সেখানে কিন্তু বিজেপির ফল ভালো না। মাঝেসাঝেই তৃণমূলনেত্রীকে 'ফুফা', 'খালা', বেগম বলে ডাক দেন শুভেন্দু। বুঝিয়ে দেন নেত্রী আসলে 'কাদের লোক'! রাজনীতিতে এই মেরুকরণ সারারাজ্যের একটা বড় অংশই ভালোভাবে নেয়নি, নেয় না। নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ভেকুটিয়া, হরিপুর ও নন্দীগ্রামে দুর্দান্ত ফল করে বিজেপি। নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকের বয়াল ১, ২ এবং খোদামবাড়ি ২ নম্বর পঞ্চায়েত বিজেপির দখলে চলে আসে। বয়াল ১-এর মোট ১৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি ৮টি আসন জেতে, তৃণমূল জেতে ৫টি। বয়াল ২-এর ১৬টির মধ্যে ৯টিই দখক করে বিজেপি। খোদামবাড়ি ২-এর মোট ১৭টি আসনের মধ্যে ১২ টিই ছিনিয়ে নেয় বিজেপি। শুভেন্দু অধিকারীর নিজের ভোটকেন্দ্র নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের নন্দনায়কবাড়ে। সেখানে ৭৭ নম্বর বুথে জিতে যান বিজেপি প্রার্থী রুম্পা দাস। কিন্তু জেলা পরিষদ দখলের লড়াইতে এখনও পোক্ত হলেন না শুভেন্দু।