রিভলভার থেকে তরোয়াল, সত্যজিতের ছবির হাতিয়ার জোগাত কলকাতার এই দোকান

Narasingha Chandra Dan & Co, Kolkata : কলকাতায় গোলা বারুদের বিক্রি শুরু করেছিল দাঁ পরিবার, আজও দুশো ছুঁইছুঁই এ দোকান আজও বয়ে বেড়াচ্ছে বহু ইতিহাস

“ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই...” নিছক কোনও শব্দ নয়, সত্যজিৎ রায়ের ছবির বিখ্যাত সংলাপ! জটায়ুর ভাষায় এটাই ফেলুদার হাতের রিভলভারের যথাযথ ব্যাখ্যা। সত্যজিতের গল্পে রহস্য মানেই ফেলুদা। আর ফেলুদা মানেই পরিচিত সেই কোল্ট ৩২ রিভলভার। ছটা গুলি, তাতেই ঘায়েল শত্রুপক্ষ। “সোনার কেল্লা” ছবির এক্কেবারে শেষদিকে, দুষমন যখন পালাতে যাচ্ছে, তখন ওই রিভলভার থেকেই ছুটে আসা গুলিতে টুপি উড়ে যায়। এরপর পরবর্তী সবকটি ছবিতেই ফেলুদার হাতে দেখা গিয়েছে ওই একই রিভলভার। চরিত্রের সঙ্গে ওই অস্ত্রটার যেন অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ।

শুধু ফেলুদার রিভলভার নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবির সেই বিখ্যাত তরোয়াল, এ নিয়েও রয়েছে বিস্তৃত তরজা। সত্যজিৎ মানেই ছবির চুল ছেড়ে বিশ্লেষক। দৃশ্যের প্রতিটি কোণ তাই অসাধারণ দক্ষতায় সাজানো। ছবিতে ব্যবহৃত প্রতিটি প্রপ নিয়েই তাই তিনি ছিলেন যথেষ্ট মনোযোগী। সত্যজিতের একটাই ভাবনা, তার প্রতিটি ছবিই যেন হয় মাস্টারপিস। তাই ছবির কোনও কিচুবনিতেই আপোস করতে রাজি ছিলেন না কোনওদিনই। তাই হয় তো আজ এতগুলো দিন পেরিয়ে এসেও সত্যজিৎ রায় নামের সঙ্গে তিলেক জড়িয়ে থাকা মানুষের কাছেও ওটাই কাজের দুনিয়ায় একটা বড়ো সার্টিফিকেট।

আরও পড়ুন - মৃত্যুশয্যায় শুয়ে নিয়েছিলেন সোনালি ট্রফিটি, কেমন ছিল সত্যজিৎ রায়ের অস্কার প্রাপ্তির মুহূর্ত?

কিন্তু ছবির এই সব শান দেওয়া হাতিয়ার পরিচালক কোথা থেকে খুঁজে আনতেন জানেন? কলকাতা শহরের সঙ্গে এ দোকানের যোগাযোগ অনেককালের। ব্যস্ত ডালহৌসির বুকে আজও দাঁড়িয়ে আছে পড়ে দুশো ছুঁইছুঁই দোকানটি। নাম ‘নরসিংহচন্দ্র দাঁ অ্যান্ড কোং, গান অ্যান্ড রাইফেল মেকার্স’। রিভলভার থেকে শুরু তরোয়াল বিভিন্ন সময়ে পর্দায় বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সেই অস্ত্রগুলির হদিশ মিলেছিল এখানেই। পোশাকি নামের বাইরে এ দোকান অবশ্য পরিচিত অন্য নামে। এনসি দাঁ-এর বন্দুকের দোকান।

satyajit ray birthday feluda colt revolver to sword of shataranj ki khiladi rays film tool by this shop in kolkata

শতাব্দীপ্রাচীন এই দোকান জুড়ে রয়েছে অজস্র রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্রও। রয়েছে রাজরাজড়াদের আমলে ব্যবহৃত ঢাল তরোয়াল, বর্শা। এবং বহু অ্যান্টিক বন্দুকও। যার মধ্যে কয়েকটি আবার সেই ষোড়শ শতকের। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কেবল ত্বকের অঙ্কে দামের হিসেব করা যায় না এর। এক কথায় অমূল্য এইসব অস্ত্র। আর এইসব পুরনো অস্ত্রের পাশপাশিই সাজানো রয়েছে সত্যজিৎ, ফেলুদার স্মৃতিমাখা তলোয়ার, কোল্ট রিভলভারও। স্মৃতির পাশাপাশি সেই সময়ের আরও অনেক কিছুই লেগে রয়েছে এইসব অস্ত্রে।

সত্যজিৎ রায় আজ নেই ঠিকই, কিন্তু রয়ে গিয়েছে তবে তৈরি সবকটি মাস্টারপিস থেকে যাবে আরও একশো বছর। তাই সত্যজিৎ রায়কে নিতে কৌতূহলও থেকে যাবেই, আর সেইসব কৌতূহলের টানেই আজও বহু মান্য ছুটে যায় এই প্রাচীন দোকানে। জানা যায়, রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য ছবির জন্য ফেলুদার প্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র সেই কোল্ট রিভলবারের জন্য সন্দীপ রায়ও এসেছিলেন এই দোকানেই। এখানেই শেষ নয়, ওই ছবির ফেলুদার চরিত্রে থাকা অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী নিজেও এসে রিভলবারের খুঁটিনাটি জেনে গিয়েছিলেন। তাছাড়া শুধু ফেলুদা নয়, ব্যোমকেশের অস্ত্রেরও জোগান দিয়েছিল এ দোকান। আজও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু নামজাদা মানুষ এখান থেকে পিস্তল, রিভলবার কিনে নিয়ে যান। সেগুলো মেরামতের জন্য তাঁরা এখনও আসেন অতি পরিচিত এনসি দাঁ-এর বন্দুকের দোকানে।

আরও পড়ুন - অর্জন নয়, অস্কারের ‘ঘুষ’ দেওয়া হচ্ছে ভারতকে?

কিন্তু কে এই এনসি দাঁ? সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলই বা কী করে? দোকানে বন্দুক, তরোয়াল খুঁজতে খুঁজতে সত্যজিৎ রায় যখন এ দোকানে আসেন তখনই উঠে আসে আরেক গল্প। কথায় কথায় জানা যায়, এ দোকানের মালিকের সঙ্গে পরিচালকের যোগাযোগের প্রথম ভিত হল প্রেসিডেন্সি কলেজ। দুজনেই নাকি ছিলেন সহপাঠী। ফলে ব্যবসায়িক সম্পর্ককে ছাপিয়ে যায় পুরনো স্মৃতি। তারপর থেকেই ছবির প্রয়োজনে বারবার এখানে ছুটে আসতেন রায়বাবু।

satyajit ray birthday feluda colt revolver to sword of shataranj ki khiladi rays film tool by this shop in kolkata

শুরুটা অবশ্য বেশ টালমাটাল ছিল এ দোকানের। সময়টা ১৮৩৫ সাল। হুগলি বাঁকুড়ার সীমান্তে এক গ্রাম কোতুলপুরে বেড়ে নরসিংহচন্দ্র দাঁ ব্যবসা করতে এলেন কলকাতায়। কীসের ব্যবসা? বন্দুকের, তাও আবার পুরনো।কলকাতা এসে প্রথমে ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওল্ড চিনে বাজার স্ট্রিটে খুলে বসলেন তাঁর গাদা বন্দুক ও গুঁড়ো বারুদের দোকান। পরে যদিও ব্যবসার খাটিয়ে ঠিকানা বদল করে সে দোকান। বাজার স্ট্রিট থেকে পরে সরে আসে ৬৪ এ হেমন্ত বসু সরণিতে। দেখতে দেখতে পাঁচ প্রজন্মের হাত বদল হতে আজ ষষ্ঠ প্রজন্মের হাতে দোকানের দায়ভার। দোকানের শুরু যে ১৮৩৫ সালেই তা নিশ্চিত বলা না গেলেও নথিপত্র যা পাওয়া যায় কোনওটিই তার আগের নয়। ফলে ধরে নেওয়া হয় প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন এই দোকান ১৮৩৫ সালেই তার বারুদের যাত্রা শুরু করে কলকাতার বুকে।

satyajit ray birthday feluda colt revolver to sword of shataranj ki khiladi rays film tool by this shop in kolkata

তৎকালীন কলকাতায় গোলা, বারুদ বন্দুক! ভাবতে অবাক লাগলেও এই ব্যবসার কারণ খুঁজতে গেলে উঠে আসে সেই আমলের জমিদারদের কথা। তাদের সখ সৌখিনতার মধ্যে অন্যতম ছিল শিকারে যাওয়া। ফলে সে যুগে তাদের পাহাড়প্রমাণ বিষয়সম্পত্তি আগলে রাখার জরুরি হয়ে উঠেছিল বন্দুকের কেনা বেচা। জানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সারা ভারত জুড়েই গজিয়ে উঠতে শুরু করে এইসব দোকান। প্রথমে বারুদ গুঁড়ো, ছিটে অর্থাৎ পেলেট বা লেড শট ও ক্যাপ বিক্রি করতেন তাঁরা। এরপর ধীরে ধীরে আসে একনলা ও দোনলা বন্দুক। আসে ‘মাজল লোডিং গান’। আদ্যিকালের সেইসব বন্দুকে গুলি বেরোবার মুখ দিয়েই ভরা হত বারুদ, লোহার টুকরো, টিকলি এবং ভুসি। তারপর লক্ষ্যে তাক করে ট্রিগার টানলেই ছুটে যেত গুলি।

আরও পড়ুন - সত‍্যজিতের চিত্রনাট‍্য চুরি করে সোজা অস্কার মঞ্চে! স্বীকৃতিতেও ঢাকেনি যে আঁধার

শুধু গোলা, বারুদ, বন্দুকই নয় এ দোকানের কর্তৃপক্ষ দায় নিতে শুরু করে লাইসেন্স দেওয়ারও। ক্রমেই বড়ো হতে থাকে ব্যবসা। ফের ঠিকানা বদলে দোকান চলে আসে ডালহৌসি স্ক্যোয়ারে। আজও এখানেই রয়েছে প্রাচীন দোকানের অস্তিত্ব। নরসিংহ দাঁ-এর পর তাঁর তিন ছেলে আশুতোষ, নীলমাধব ও নন্দলাল দায়িত্ব নেন ব্যবসার। পরবর্তীতে চাহিদা এতোই বাড়তে থাকে যে বড় ছেলে আশুতোষ ধর্মতলা মোড়ের কাছে খুলে বসেন আরও একটি দোকান। সেটির নাম এ টি দাঁ অ্যান্ড কোম্পানি।

satyajit ray birthday feluda colt revolver to sword of shataranj ki khiladi rays film tool by this shop in kolkata

সাধারণ গোলাবারুদ থেকে শুরু করে সিপাহী বিদ্রোহে ব্যবহৃত সেই বিখ্যাত ‘ব্রিচ লোডিং গান’, সবই রাখা হতো এখানে। সঙ্গে থাকতো টোটা, কার্তুজ এবং বারুদও। তবে এসবের মধ্যে এই দোকানের সিগনেচার বলতে ছিল একপ্রকার ছোটো কামান, নাম ‘উইনচেস্টার রিপিটিং’, আর্মস কোম্পানির তৈরি এই কামানের দৈর্ঘ্য মাত্র ১৭ ইঞ্চি। আজও দাঁ বাড়ির বিখ্যাত দুর্গাপুজোর সূচনা হয় এই দোকানের কামান দেগেই। আর সেই শব্দেই যেন বছরের পর বছর কলকাতা স্মরণ করে নেয় পুরনো এই ঐতিহ্যকে।

* ছবিগুলি দোকানের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত।

More Articles