কোনও উৎসব নয়! সাহিত্যে নোবেল জিতেও কেন এমন সিদ্ধান্ত লেখিকা হ্যান কাংয়ের?

Han Kang Nobel Prize 2024: হ্যানের বাবা ভেবেছিলেন এই কৃতিত্ব উদযাপনের জন্য বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন করবেন সকলকে নিয়ে।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন তিনি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সম্মান তাঁর ঝুলিতে। অথচ আনন্দের কোনও উদযাপন নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার লেখিকা হ্যান কাং পুরস্কারের মায়ায় পড়ে নিজের রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ ভুলে যাননি। লেখক তো সাহিত্যের দ্বীপে হারিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন সত্তা নন, লেখক তো এক রাজনৈতিক সত্তা! তিনি এই বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর অংশ। তিনি কীভাবেই বা বিচ্ছিন্ন থাকবেন বিশ্বরাজনীতি থেকে! ২০১৬ সালে ডেবোরা স্মিথ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন হ্যান কাংয়ের উপন্যাস হিউম্যান অ্যাক্টস-এর। হিংসার প্রতি হ্যানের অনন্য এবং তীব্র দৃষ্টিভঙ্গি সেই লেখাতে স্পষ্ট। স্মিথ হ্যানের উপন্যাসের ভূমিকায় জিওনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভ সম্পর্কে লিখেছেন। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে কোরিয়ার পঞ্চম রাষ্ট্রপতি, সেনা জেনারেল এবং সামরিক স্বৈরশাসক, চুন ডো-হওয়ানের স্বাধীনতার দমন সামরিক আইন সম্প্রসারণে বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। একে গোয়াংজু বিদ্রোহ বলা হয়। রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী নিরস্ত্র নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আক্রমণ শুরু করে। গণহত্যা করে।

এই ঘটনা চিনের কমিউনিস্ট শাসনে ১৯৮৯ সালের বসন্তে তিয়ানানমেন স্কোয়ারে ছাত্রদের আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অতি সম্প্রতি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি ছাত্রদের আন্দোলনকে হিংসা দিয়েই দমন করতে চেয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে ১৫ বছরের শাসনের অবসান! নাগরিকের বিদ্রোহে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন হাসিনা। কম্বোডিয়ায় খেমার রুজ, চিনের ইয়াং শাংকুন, লি পেং এবং দেং জিয়াওপিং, দক্ষিণ কোরিয়ার চুন ডু-হোয়ান এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এই সব দেশের ইতিহাসকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে।

আরও পড়ুন- পেলব অথচ নৃশংস! কেন পড়তেই হবে নোবেলজয়ী হ্যান কাং-এর লেখা?

হাজারে হাজারে মানুষ নিজেদের সমস্ত অতীতকে ফেলে, নামহীন লাশে পরিণত হয়ে গিয়েছে। একজন লেখক এই সত্যের থেকে পালাবেন কীভাবেই বা! হ্যান কাং বর্তমান অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নোবেলজয়ের কৃতিত্ব উদযাপন করাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলেই মনে করেন তিনি। হ্যানের বাবার বয়স ৮৫। তিনিও লেখক। হ্যানের বাবা হান সিউং-ওন, দক্ষিণ জিওলা প্রদেশে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁর মেয়ের ইচ্ছা সকলের সঙ্গে ভাগ করেছেন। হ্যান তাঁর বাবাকে বলেছেন, "যখন যুদ্ধ চারদিকে তীব্রতর হচ্ছে, প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে, আমরা কীভাবে উদযাপন করব, কীভাবে সংবাদ সম্মেলন করব?" মেয়ের বাবা হিসেবে তো বটেই, একজন লেখক হিসেবেও সেউং-ওন অনুভব করেছিলেন, তাঁর মেয়ের দৃষ্টিকোণ কোরিয়ান লেখক থেকে বিশ্বব্যাপী লেখকের চেতনায় পাল্টে গিয়েছে।

ইউক্রেন এবং গাজার যুদ্ধ স্পষ্টতই হ্যানকে ছিন্নভিন্ন করেছে। তাই তো করার কথা! কোথাও কারও মৃত্যু অন্যত্র জীবিত মানুষের মনকে তো প্রভাবিত করেই। বিশ্বের কোথাও সংঘটিত গণহত্যা যদি আমাদের বিবেককে প্রভাবিত না করে তবে আমাদের চেতনা লাশ হয়ে গিয়েছে কিনা শঙ্কা জাগে। তাই হ্যানের জন্য, এ এক শোকের সময়, ব্যক্তিগত অর্জন উদযাপন করার সময় নয়। গাজা থেকে প্রতিদিন মানুষ ও শিশুদের মৃত্যুর টাটকা খবর আসছে একদিকে, আর অন্যদিকে নোবেল জয়ের উৎসব চলছে এই বৈপরীত্য একজন সংবেদনশীল মানুষের জীবনে ঘটতে পারে না।

হ্যানের বাবা ভেবেছিলেন এই কৃতিত্ব উদযাপনের জন্য বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন করবেন সকলকে নিয়ে। বাবার এই ইচ্ছা জানতে পেরে হ্যান তাঁকে ইউক্রেন আর গাজার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, "এই দুঃখজনক ঘটনাগুলির সাক্ষী হওয়ার সময় দয়া করে উদযাপন করো না। সুইডিশ আকাডেমি আমাকে এই পুরস্কার উপভোগ করার জন্য দেয়নি বরং আরও স্পষ্ট হওয়ার জন্য দিয়েছে।” চারদিকে অশান্তি, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা দেখছি সকলেই। যুদ্ধ মানুষকে প্রাণে মারে, মনেও মারে। মৃত মন নিয়ে উদযাপন কি লেখকের সাজে!

More Articles