পাকিস্তানে বৈঠকে জয়শঙ্কর! কেন ভারতের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ এসসিও-সম্মেলন?

S Jaishankar in Pakistan: এসসিওর ২৩তম শীর্ষ সম্মেলনটি এ বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে ইসলামাবাদে। এই সম্মেলনে যাতে কোনও হিংসার ঘটনা না ঘটে, তার জন্য ইসলামাবাদকে কার্যত সেনা দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল।

ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও-র বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন পাকিস্তান। মঙ্গলবার সেই বৈঠক হয়ে গিয়েছে। প্রায় এক দশক পরে ভারতের কোনও বিদেশমন্ত্রী পাকিস্তান সফরে গেলেন। এর আগে ২০১৫ সালে ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ 'হার্ট অব এশিয়া' সম্মেলনের জন্য ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন। তার কিছু দিনের মধ্যেই আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আচমকা লাহৌরে যান। গত বছর পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন(এসসিও) বৈঠকে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন। কার্যত সেটা ছিল ১২ বছর পর পাকিস্তানের কোনও বিদেশমন্ত্রীর ভারতে আগমন। এর মাঝে দুই দেশের মধ্যে বিবাদের কারণে পাকিস্তানের কোনও মন্ত্রী বা নেতা ভারত আসেননি এবং ভারতের কোনও মন্ত্রী পাকিস্তান যাননি। ৯ বছর পর ভারতের বিদেশমন্ত্রী আবার পাকিস্তান গেলেন। কী কথা হল বৈঠকে? কেন ভারতের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ এসসিও বৈঠক?

আগেই বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছিলেন, জয়শঙ্করের এই সফর এসসিও বৈঠকের জন্যই। এর থেকে বেশি কিছু নয়। যেহেতু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার এখনও সমাধান হয়নি, তাই ক্ষমতায় এখন কারা রয়েছে, তা-ও পরিষ্কার নয়। ফলত এই মুহুর্তেই হয়তো কোনও সরাসরি আলোচনায় যাবে না ভারত, এমনটাই মনে করেছিলেন ওয়াকিবহাল মহলের একটা বড় অংশ। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নিজে পাকিস্তানে না গিয়ে বিদেশমন্ত্রীকে পাঠানোর ক্ষেত্রেও ইঙ্গিত এটাই ছিল যে, পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করবে না ভারত। জয়শঙ্কর নিজেও জানিয়েছিলেন, "এসসিও বৈঠক বহুপাক্ষিক ইভেন্ট। আমি সেখানে ভারত-পাকিস্তান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছি না। আমি এসসিও সদস্য দেশের প্রতিনিধি হিসাবে যাচ্ছি।" পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, "ভারত বা পাকিস্তানের কেউই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জন্য কোনও অনুরোধ করেনি।"

আরও পড়ুন: ইমরানের মুক্তির দাবিতে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ! বাংলাদেশের পথে এবার পাকিস্তান?

তবে বৈঠকের পর অনেকেই মনে করছেন, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এসসিও মঞ্চকে কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। জয়শঙ্কর এসসিও মঞ্চ থেকে বলেছেন, "যদি পুরোপুরি বিশ্বাস না থাকে, যথেষ্ট সহযোগিতা না করা হয়, বন্ধুত্বে খামতি থাকে, প্রতিবেশী সত্তায় ফাঁকি পড়ে যায়, তাহলে তো অবশ্যই পর্যালোচনা এবং অন্তঃসমীক্ষা করে দেখতে হবে।" তিনি আরও বলেন, "তিনটি অশুভ শক্তিকে আপসহীনভাবে দমন করতে হবে। সেগুলি হল সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ। যদি সীমান্তের বিভিন্ন কার্যক্ষেত্রে এই তিন অশুভ শক্তি ঢুকে পড়ে, তাহলে তা বাণিজ্য, শক্তির চলাচল এবং দু'দেশের মানুষের মধ্যে আদানপ্রদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।" বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান আর চিনের নাম না নিলেও এই কথাগুলি যে ওই দুই দেশকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে, তা কার্যত স্পষ্ট।

মনে রাখতে হবে, গত পাঁচ বছর ধরে পূর্ব লাদাখে চিনা সেনাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে চিন্তায় ভারত সরকার। সম্মেলনে জয়শঙ্কর সরাসরি জানান, ভারত-চিনের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)-এর সম্প্রসারণ নিয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বক্তব্যের সমালোচনা করে বিদেশমন্ত্রী স্পষ্ট বলেন, "সিপিইসি-র একাংশ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।" তাঁর বক্তৃতায় খাদ্য, জ্বালানি ও সারের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। বৈঠকের বেশ কিছু দিন আগে সাবেক কূটনীতিক অশোক সাজ্জানহার এনডিটিভি-তে বলেছিলেন, "ভারত পাক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে বল এখন পাকিস্তানের কোর্টে। ভারত স্পষ্ট করে বলেছে, ২০১৯ সালে পুলওয়ামা এবং তার পরে বালাকোটের ঘটনার পর আলোচনা ও সন্ত্রাসবাদ একসঙ্গে চলতে পারে না। কিন্তু এরপর পাকিস্তান কোনও গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়নি।" তিনি আরও বলেন, "৩৭০ ধারা বিলোপের পর পাকিস্তান হাইকমিশন প্রত্যাহার করে নেয়। ভারতও একই কাজ করে। পাকিস্তানের সঙ্গে ৩৭০ ধারার কোনোও যোগাযোগ নেই।"

 

এসসিওর ২৩তম শীর্ষ সম্মেলনটি এ বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে ইসলামাবাদে। এই সম্মেলনে যাতে কোনও হিংসার ঘটনা না ঘটে, তার জন্য ইসলামাবাদকে কার্যত সেনা দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআই বিক্ষোভের কথা জানিয়েছিল। এরপর ইমরানের দলের বহু সমর্থককে গ্রেফতারও করা হয়। পরে দল জানিয়ে দেয়, বৈঠক চলাকালীন তাঁরা কোনও বিক্ষোভ দেখাবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তান সরকার তিন দিনের ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করে। একই সঙ্গে পার্লামেন্ট, দূতাবাস, বৈঠকস্থল, বিদেশি অতিথিদের থাকার জায়গায় নিরাপত্তার দায়িত্ব সেনাদের হাতে দেওয়া হয়েছিল। ইসলামাবাদে শরিফের আমন্ত্রণে নৈশভোজেও যোগ দেন জয়শঙ্কর। বলে রাখা দরকার, এর আগে যখন রাজনাথ সিং পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, সে সময় পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান রাজনাথের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। গত বছর পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভারতে এসে যা বক্তব্য রেখেছিলেন, তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি একরত্তিও।

 

এসসিও একটি বহুপাক্ষিক সংগঠন। বিভিন্ন দেশে এই বৈঠকের আয়োজন হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে ভারত প্রতিটি বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। এই সম্মেলনে ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিবারই বিদেশমন্ত্রী গিয়েছেন, শুধু একবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী গিয়েছিলেন। এ বার ইসলামাবাদের এসসিও বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন - চিন, বেলারুশ, কাজখস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীরা। এ ছাড়াও ছিলেন কিরঘিজস্তানের মন্ত্রিসভার চেয়ারম্যান, ইরানের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রী। সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, মঙ্গোলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং তুর্কেমেনিস্তানের বিদেশমন্ত্রীকে।

আরও পড়ুন: এবার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত! দেনায় ডোবা পাকিস্তানের জন্যে কী অপেক্ষা করছে?

বিশ্বের প্রায় ৪০% জনসংখ্যাই এসসিও-ভুক্ত দেশের। বিশ্বের জিডিপিরও ২০% এসসিও সদস্যের দেশ। এই দেশগুলোতেই ২০% বিশ্বের জ্বালানি তেল মজুত রয়েছে। এর জন্যই এসসিও-ভুক্ত দেশগুলির উপর নজর রাখে গোটা বিশ্ব। সে ক্ষেত্রে এসসিও বৈঠকের জন্য ভারতের বিদেশমন্ত্রীর এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈঠকে অংশগ্রহণ করে ভারত বার্তা দিতে চেয়েছে, এসসিও-তে তারা সম্পূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং ইতিবাচক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বৈঠকে যেন ইঙ্গিত ছিল ভারত নিজের স্বার্থকে এগিয়ে রেখে নিজের শর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভাববে।

চিন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান একত্রে ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এসসিও গঠন করে। ২০১৭ সালে তাতে যোগ দেয় ভারত ও পাকিস্তান। এসসিও-র নেতৃত্ব দেয় রাশিয়া আর চিন। এই দুই দেশের সাথেই পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো। পাকিস্তানের জন্য এসসিও বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ব্যবসা, সংযোগ এবং শক্তি খাতগুলিতে সহযোগিতা বাড়াতে চায় পাকিস্তান। আবার ভারতের জন্যেও এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রতিবেশী দেশ এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি করতে চায় ভারত। বর্তমানে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সংযোগ সীমিত। এই সকল করণের জন্য অনেকেই এই সফরকে বহুপাক্ষিক মঞ্চে ভারতের অংশগ্রহণের দিককে দেখা উচিত বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তবে এসসিও বৈঠকের মাধ্যমে অন্যান্য দেশে ভারতের উপস্থিতি ও যথাযথ ভূমিকা বজায় রাখা গেল কিনা, সেই উত্তর মিলবে ভবিষ্যতেই।

More Articles